সাইবার বুলিং: সচেতন থাকুন

ইন্টারনেটের এই সময়ে এসে সাইবার অপরাধ জটিল এক মনস্তাত্ত্বিক উপদ্রব। যার শিকার হচ্ছে কমবেশি সব বয়সের মানুষ। তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরীরা এবং নারীরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন সাইবার আক্রমণে। এই অপরাধের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সাইবার বুলিজম’। বুলিং বলতে আমরা বুঝি দুইজন ব্যক্তির মধ্যে তর্ক বা কথা–কাটাকাটির জের ধরে একজন ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে সবার সামনে দোষারোপ বা খারাপ ভাষায় আক্রমণ করা। আবার একজনের ছবি বা ভিডিও বিকৃতি করে অনলাইনে তুলে ধরাও বুলিংয়ের মধ্যে পড়ে। এটি একধরনের সাইবার অপরাধ। তবে এসব অপরাধ দমনে আইনও রয়েছে দেশে। দরকার শুধু সচেতন থাকা।

ঘটনা: ১

সামান্থা (ছদ্মনাম) পঞ্চম শ্রেণি থেকেই বিভিন্ন নাচের অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এখন সে নবম শ্রেণিতে পড়ে। সাবলীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের জন্য স্কুলের জনপ্রিয় মুখ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুও অনেকে। মেয়েদের একটি গ্রুপের সক্রিয় সদস্য সামান্তা। একদিন এক আড্ডায় বন্ধুরা তাকে নিয়ে নানা গুজব ছড়ায়। তার নামে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে চ্যাট করে চ্যাট হিস্ট্রির স্ক্রিনশটও বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। স্কুলে যাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় সামান্তার জন্য। ইনবক্সে আসতে থাকে অশ্লীল সব বার্তা। মেয়েটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কাউকে বিশ্বাস করাতে পারে না মেসেজগুলো তার নয়। ঘর থেকে বের হওয়া ছেড়ে দেয়। শেষমেশ তার বাবা-মা তাকে নিয়ে শহর ছেড়ে চলে যায়। কী নির্মম অভিজ্ঞতা!

ঘটনা: ২

অনলাইনে একটি বুটিক চালান বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এক তরুণী। তাঁর বিক্রি দেখে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীরা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন। শুরু হয় তাঁর নামে ভিন্ন ভিন্ন পেজ খুলে নানা রকম অফার ও মেসেজ করা। কখনো বাজে পণ্যও বিক্রি করা হয়। কখনো অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য দেওয়া হয় না। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার প্রভাব তাঁর উদ্যোগেই শুধু নয়, পারিবারিক জীবনেও পড়ে। মেয়েটি তাই আজ প্রবাসী।

ঘটনা: ৩

মোহনা (ছদ্মনাম) তিনি পেশাদার ডিজিটাল বিপণনকর্মী ও ফ্রিল্যান্সার। তাঁর ফেসবুক আইডি নিষ্ক্রীয় (ডিজেবল) করে দিয়ে মোহনার নামে ভুয়া আইডি ও পেজ খোলা হয়। তাঁর ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে তাঁকে বাজেভাবে উপস্থাপন করে কিছু অসাধু ব্যক্তি। এর জন্য তাঁকে নানা ধরনের বিপদের সম্মুখীনও হতে হচ্ছে।

এগুলো তো ক্ষুদ্র ঘটনা। এমন অনেক ঘটনাই প্রতিদিন ও প্রতিনিয়ত ঘটছে আমাদের চারপাশে। সম্মান হারাচ্ছে নির্দোষ মানুষ। ব্যবসায়িক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে। একটা সময় ছিল, যখন তাঁরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন না। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন সাইবার বুলিজমে আক্রান্ত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

নিরাপত্তার স্বার্থে

● প্রথমেই নিজেকে বোঝাতে হবে, এটি আপনার দোষ নয়৷ কেউ যদি খুব খারাপভাবে আক্রমণ করে এবং এই নিষ্ঠুর আচরণের জন্য আপনি নিজেকে দোষী ভেবে কষ্ট পাবেন না। অন্যের আচরণের দায় আপনার নয়।

● সাইবার বুলিংয়ে আক্রান্ত হলে কখনোই আপনি সাড়া দেবেন না এবং নিজেও পাল্টা আক্রমণ করবেন না।

● আপনাকে বুলিং করা হয়েছে বা আপনি আক্রমণের শিকার হয়েছেন, এর সপক্ষে যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করবেন।

● প্রাথমিকভাবে যে বা যার দ্বারা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন এবং আপনার সপক্ষে যুক্তিগুলো গুছিয়ে জানাতে পারেন। আপনি না পারলে আপনার বন্ধু বা আত্মীয়কেও এই আলোচনাটুকু করতে অনুরোধ করতে পারেন।

● বুলিংয়ের শিকার যেহেতু নারীরা বেশি হন এবং তাঁরা তাঁদের সমস্যাগুলো এখনো পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, তাই বুলিংয়ের শিকার হলে অবশ্যই একজন বন্ধু, আত্মীয়, ভাই বা বোনকে জানাতে হবে।

● সব সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টেই ব্লকের অপশন থাকে। প্রাথমিক বুলিং হলে বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অসংলগ্ন কথা বললে তাকে ব্লক করে দিতে পারেন।

● যদি বুলিং থেকে সেটি বড় ধরনের হুমকিতে পরিণত হয়, যা শারীরিক আক্রমণ, জীবননাশের হুমকি বা বড় ধরনের মানসম্মানহানির কারণ হতে পারে, সেই ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে কাছের থানার সাহায্য নিতে হবে।

অভিভাবকদের জন্য

● নিজের সন্তানদের প্রতি আস্থা হারাবেন না। আপনারাই তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসের আশ্রয়।

● সন্তানের প্রতি মনোযোগী হন, তাদের কথাকে গুরুত্ব দিন, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন।

● কোনো ঘটনা শুনেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। ইতিবাচক সমাধানে আসুন, পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও আত্মসম্মান বজায় রাখুন।

● যেকোনো ধরনের আক্রমণ বা বুলিংয়ের শিকার হলে জরুরি পুলিশ সেবার জন্য ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ৯৯৯–এ কল করতে পারবেন। এটি বিনা মূল্যের।

লেখক: প্রেসিডেন্ট, ক্রাইম রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ফাউন্ডেশন—ক্র্যাফ ও প্রশিক্ষক ৯৯৯