বন্ধ হয়ে গেল গুগল প্লাস

বন্ধ হয়ে গেল গুগলের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুগল প্লাস। গতকাল মঙ্গলবার থেকে গুগল প্লাসের ব্যবহারকারীরা আর এটি ব্যবহার করতে পারছেন না।

ফেসবুক ও টুইটারকে টেক্কা দিতে আট বছর আগে সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গুগল প্লাস চালু করেছিল গুগল। সাইটটি জনপ্রিয় করার নানা প্রচেষ্টায় ব্যর্থতা এবং গত বছরের শেষ নাগাদ নিরাপত্তা ত্রুটি ধরা পড়ার পর এটি বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। দ্য ভার্জ ও বিবিসির খবরে এ কথা বলা হয়েছে।

গুগল প্লাস তার ব্যবহারকারীদের তথ্যে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানিয়ে এক বিবৃতিতে গুগল বলেছে, গুগলের কোনো সেবায় তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কিন্তু অ্যাপ ডেভেলপারদের ত্রুটির কারণে গুগল প্লাস ব্যবহারকারীদের তথ্যের সুরক্ষায় অনিশ্চয়তা ধরা পড়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো ব্যবহারকারীর তথ্যের অপব্যবহার হয়েছে বলে কোনো প্রমাণ পায়নি গুগল। কিন্তু প্রায় ৫ কোটি ২৫ লাখ ব্যবহারকারীর তথ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল।

২০১১ সালে চালু হয় গুগল প্লাস। চালুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কয়েক লাখ ব্যবহারকারী এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাইনআপ করে। কিন্তু সাইনআপ করা অল্পসংখ্যক মানুষই এটি ব্যবহার করত। সে সময়ই অনেক বিশ্লেষক মাধ্যমটির অন্তিমযাত্রা নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। যদিও তখন আশা ছাড়েনি গুগল। নানা পরিবর্তন ও সংযোজন করে এসেছে নিয়মিত। কিন্তু ২০১৮ সালে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের পর হতাশ হয়ে পড়ে গুগল কর্তৃপক্ষ। প্ল্যাটফর্মটি বন্ধ করে দেওয়া সিদ্ধান্ত নেয়। গত সেপ্টেম্বর–অক্টোবর মাসের দিকে গুগল প্লাস বন্ধ করে দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে গুগল। সে সময় বলা হয়, ২ এপ্রিল থেকে ব্যবহারকারীদের তথ্য মুছে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হবে।

তবে গুগল প্লাসের সব তথ্য স্থায়ীভাবে মুছে ফেলা হবে না। গুগলের ইন্টারনেট অ্যান্ড আর্কাইভ টিম জানিয়েছে, গুগল প্লাস ব্যবহারকারীর পাবলিক পোস্টগুলো মুছে ফেলার আগে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করছে তারা।

অবশ্য গুগল প্লাসের সব কনটেন্ট আর্কাইভ করা হবে না। প্রাইভেট করে রাখা এবং ব্যবহারকারী মুছে ফেলেছেন, এমন কনটেন্ট সংরক্ষণের আওতায় থাকছে না। এ ছাড়া কোনো পোস্টের কমেন্ট থ্রেডে ৫০০-এর বেশি কমেন্টও সংরক্ষিত হচ্ছে না। তবে ফটো ও ভিডিও কনটেন্টের রেজল্যুশন কমিয়ে তা সংরক্ষণ করা হবে।

গত বছরে ফেসবুকের নিরাপত্তাত্রুটি কাজে লাগিয়ে তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার খবর জানা যায়। এরপর অ্যালফাবেটের অধীনে থাকা আরেক সামাজিক যোগাযোগের সাইট গুগল প্লাসের তথ্য বেহাত হওয়ার বিষয়টিও নজরে আসে। তখন রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, গুগল প্লাস থেকে পাঁচ লাখ ব্যবহারকারীর তথ্য বেহাত হয়েছে। এর জের ধরে গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট তাদের গুগল প্লাস সেবা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

গুগল প্লাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাইরের শত শত ডেভেলপারের কাছে পাঁচ লাখের বেশি গুগল প্লাস ব্যবহারকারীর তথ্য চলে গেছে। তাই গুগল প্লাসের গ্রাহক সংস্করণ (কনজিউমার ভার্সন) বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। গুগল প্লাস থেকে তথ্য বিনিময়বিষয়ক নীতিমালা আরও কঠিন করা হচ্ছে।

গুগল প্লাস বন্ধ করার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিল অ্যালফাবেট কর্তৃপক্ষ। গত বছরের আগস্ট মাসে গুগল ফ্রান্সের অফিশিয়াল গুগল প্লাস পেজ বন্ধ করে দেয়।

প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা বলছেন, গুগল প্লাসকে জনপ্রিয় করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল গুগল। জি–মেইল অ্যাকাউন্ট খুললে গুগল প্লাসে অ্যাকাউন্ট খোলা বাধ্যতামূলক করেছিল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। চালু হওয়ার সাত বছরের মাথায় গুগল প্লাসের বিদায়ঘণ্টা বাজার ইঙ্গিত মেলে ২০১৮ সালের শেষের দিকে। গুগল ফ্রান্সের অফিশিয়াল গুগল প্লাস পেজ বন্ধ করার বিষয়টি থেকেই এ অনুমান করেন বিশ্লেষকেরা।

গুগলের আরও একটি সামাজিক যোগাযোগের সাইট জনপ্রিয় করার চেষ্টা ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। ফেসবুকের সঙ্গে টক্কর দিতে বেশ কয়েকবার নতুন সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট চালু করে গুগল। কিন্তু গুগলের এ সাইটও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেনি।

সাম্প্রতিক তথ্য বেহাত হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে গুগল এক ব্লগ পোস্টে লিখেছে, গত মার্চ মাসে গুগল প্লাসের ওই সমস্যা শনাক্ত করা হয় এবং তা সফটওয়্যার প্যাচের মাধ্যমে ঠিক করা হয়। তবে তা ঠিক করার আগে ডেভেলপারদের সে তথ্য নেওয়ার সুযোগ ছিল। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোনো ডেভেলপার ওই ত্রুটির অপব্যবহার করেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রাইভেসি সুরক্ষার আরেক ব্যর্থতার বিষয় প্রযুক্তি বিশ্বে আলোচনায় এল। এ ঘটনার পর অ্যালফাবেটের শেয়ারের দাম ১ শতাংশ কমে যায়।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে বলেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে আসা চাপের ভয়ে অ্যালফাবেট কর্তৃপক্ষ আগে এ নিরাপত্তাত্রুটির বিষয়টি জানায়নি। ওই সময় ফেসবুকের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি নিয়ে হইচই হচ্ছিল। গুগল প্লাসের নিরাপত্তাত্রুটির বিষয়টি কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সঙ্গে তুলনা হতে পারে—এটা ভেবেই তা চেপে যায় অ্যালফাবেট। এ বিষয়ে গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই অবগত ছিলেন। এ বিষয়ে গুগল কর্তৃপক্ষ অবশ্য কোনো মন্তব্য করেনি।

যুক্তরাজ্যের নির্বাচনী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে ফেসবুক থেকে অনৈতিক উপায়ে তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ওই তথ্য কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে কাজে লাগানো হয়। এ ঘটনা জানাজানি হলে তা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।

নিরাপত্তাত্রুটির কথা চেপে যাওয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেননি নিরাপত্তা ও প্রাইভেসি বিশেষজ্ঞরা। আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফ্রায়েডম্যান ককাজেনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জ্যাকব লেম্যান বলেছেন, কারও অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে কি না, তা জানার অধিকার ব্যবহারকারীর রয়েছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার মতো যে কেলেঙ্কারির মুখোমুখি ফেসবুককে হতে হয়েছে, এটা তার মতোই ফল বহন করবে।

প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট এনগ্যাজেট বলছে, শেষ পর্যন্ত অ্যালফাবেট স্বীকার করে নিয়েছে তাদের গুগল প্লাসের ব্যর্থতার বিষয়টি। এটি কখনোই ব্যবহারকারীদের কাছে জনপ্রিয় হয়নি এবং খুব বেশি ব্যবহার করাও হয়নি। ৯০ শতাংশ গুগল প্লাস ব্যবহারকারী এতে একবার ঢুকলে পাঁচ সেকেন্ডের বেশি থাকেন না। গুগল প্লাসের এপিআই নিয়ে নিরাপত্তাত্রুটির বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় এটি বন্ধ করে দেওয়ার পথেই হাঁটছে তারা।