হৃদয়-ঘড়ির খবর জানে অ্যাপল-ঘড়ি

প্রতীকী ছবি। দ্য ইকোনমিস্টের সৌজন্য
প্রতীকী ছবি। দ্য ইকোনমিস্টের সৌজন্য

২৮ মার্চ, সকাল। বিশ্বের ১৯টি দেশে অ্যাপলের নব্য ঘড়ির মালিকেরা ঘুম থেকে উঠেই ঘড়ি নিয়ে ব্যস্ত। ঘড়িটি ঘড়িই আছে, নাকি চিকিৎসাযন্ত্র বনে গেছে? বিশ্বজুড়ে ঝড় তোলা অ্যাপলের এই নতুন ঘড়ি নিয়ে চলছে ব্যাপক গুঞ্জন।

ঘড়িটিতে যুক্ত হয়েছে নতুন দুটি ফিচার। একটি ফিচারের কাজ বাহকের অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের দেখভাল করা। অপরটির দায়িত্ব স্বল্প সময়ে হৃৎপিণ্ডের বিস্তারিত ইলেকট্রনিক প্রতিকৃতি বা ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফি (ইসিজি) তুলে ধরা। দ্বিতীয় ফিচারটি মূলত পরিচিত হৃদ্‌রোগ ‘হার্ট অ্যারিথমিয়া’ বা হৃৎপিণ্ডের ছন্দপতনের হদিস বের করে ‘অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন’ (অ্যাফিব) রোগ নির্ণয়ে কাজ করবে।

গত ডিসেম্বর থেকে এসব সুযোগ ছিল আমেরিকানদের হাতে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার আগে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তিটিকে আরও সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। ঘড়িটি অবশ্য নতুন এক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এই ঘড়ি অথবা এ ধরনের যন্ত্রের—যেমন অ্যালিভকোর—মাধ্যমে শনাক্ত করা অ্যাফিবের চিকিৎসা ডাক্তাররা কীভাবে করবেন, তা নিয়ে চলছে বিতর্ক।

হৃৎপিণ্ডের ছন্দপতনজনিত রোগের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত একটি নাম অ্যাফিব। হৃৎপিণ্ডের ওপরের প্রকোষ্ঠ নিয়মিত ছন্দে কাজ না করলে দেখা দেয় অ্যাফিব। এতে হৃৎপ্রকোষ্ঠের বিভিন্ন অংশে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। সাধারণত, যেকোনো মানুষের তুলনায় অ্যাফিবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্ট্রোক করার ঝুঁকি পাঁচ গুণ বেশি থাকে। রক্ত তরলীকরণের মাধ্যমে এই রোগীদের চিকিৎসা করা সম্ভব। এতে প্রাথমিকভাবে অত্যধিক রক্তপাতের ঝুঁকি থেকে যায়। বিশ্বে প্রায় ২ শতাংশ মানুষ অ্যাফিবে আক্রান্ত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে দুর্ভোগের হার। এ বিষয়ে স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে অ্যাপল। ধনবান তরুণেরা এখন এই ঘড়ির মাধ্যমে সহজেই জানতে পারবেন হৃৎপিণ্ডের হালচাল।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক তত্ত্বাবধান গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক জোনাথন ম্যান্ট ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছেন। তিনি দেখতে চেয়েছেন, অ্যাফিব পর্যালোচনার মাধ্যমে স্ট্রোকসহ অন্যান্য অসুখ, যেমন হার্ট অ্যাটাক, এমনকি ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ) পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব কি না। ড. ম্যান্টের মতে, অ্যাফিব বৈজ্ঞানিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং চিকিৎসার দাবিদার। কিন্তু ঘড়িতে পাওয়া তথ্য যে সত্য হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা সত্যিই জানি না এর ফল কী হতে যাচ্ছে।’

জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদের কয়েকজন সতর্ক করে দিয়েছেন, অ্যাফিব নির্ণয়ে সহায়তা করা এই ঘড়ি এর মধ্যে অনেক ইতিবাচক ও নেতিবাচক ফল দেখিয়েছে। গ্রাহক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই সমস্যা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রমাণনির্ভর ওষুধ বিভাগের অধ্যাপক কার্ল হেনেগান জানান, নতুন প্রযুক্তিগুলো স্বাভাবিক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাকে বাইপাস করে। এর ফলে নতুন স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম যাতে কোনো ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, তা নিশ্চিত করা যায়। তবে ভুল ইতিবাচক ফলাফলের কারণে প্রচুর অর্থহীন কাজের সৃষ্টি হবে বলে তিনিও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

সাম্প্রতিক ‘অ্যাপল হার্ট স্টাডি’ (অ্যাপলের হৃৎপিণ্ডবিষয়ক গবেষণা) পরিচালিত হয় প্রায় ৪২ হাজার রোগীর ওপর। গবেষকেরা দেখতে চেয়েছেন, হৃৎপিণ্ডর অনিয়মিত ছন্দের সমস্যার বেলায় পূর্বানুমান কতটুকু খাটছে। গোল্ড-স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতি অনুযায়ী, ঘড়িটি ৮৪ শতাংশ সঠিক ফলাফল দিয়েছে। ফিচারটির মূল লক্ষ্য, ইসিজি অ্যাপ ব্যবহার করে অবিলম্বে বাহকের রোগ নির্ণয়। অ্যাপলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত গবেষণায় জানা গেছে, অ্যাপলের অ্যালগরিদম ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ ক্ষেত্রে সঠিক ইতিবাচক এবং ৯৯ দশমিক ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে সঠিক নেতিবাচক ফল দিতে পেরেছে।

তবে পরখ করতে গিয়ে ঘড়িটির কারিকুরি সেভাবে খতিয়ে দেখা হয়নি। গতানুগতিক ধাঁচে ব্যবহারের কারণে ফলাফল একই রকম আসতে পারে। ঘড়িটি নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা চালালে হয়তো পাওয়ার সুযোগ থাকত। এবার নতুন করে পরিকল্পনা করা হচ্ছে ৬৫ বছরের কম বয়সীদের নিয়ে সমীক্ষা চালানোর। সবিরাম অ্যাফিবে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কত বেশি এবং তার ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা জানাটা ভীষণ জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে ঘড়িটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

যুক্তরাজ্যের একটি বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা সংস্থার পরিচালক ম্যাট কিয়ার্নি ঘড়িটি নিয়ে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করেছেন। তবে তাঁর দাবি, অ্যাপলের ঘড়িটি ব্যবহারকারীকে তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সুযোগ করে দেবে। অ্যাপলের ঘড়ি তরুণদের স্বাস্থ্যসেবায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে—এমনটাই প্রত্যাশা সবার।