ব্ল্যাক হোলের রহস্যময় জগৎ

(গত দুই মাস ব্যক্তিগত কিছু ব্যস্ততার কারণে প্রথম আলোর জন্য আমার ধারাবাহিক লেখাটা লিখতে পারিনি। তবে এখন থেকে আবার নিয়মিত লিখতে চেষ্টা করব। আর প্রথম অংশ শুরু করছি রহস্যময় ব্ল্যাক হোল দিয়ে।)

চল্লিশোর্ধ্ব কার্ল শোয়ার্জশিল্ড প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন জার্মানির পক্ষে। যদিও মাত্র বছরখানেক পরে ১৯১৫ সালে অসুস্থতার জন্য পল্টন ছাড়তে বাধ্য হন এবং পরের বছরই মারা যান। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে ওই অল্প সময়েই তিনি অমরত্ব লাভ করার মতো একটা কাজ করে ফেলেন। না, তা যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বসংক্রান্ত কিছু না, তিনি সেই সময় সদ্য প্রস্তাবিত সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের একটা অদ্ভুত সমাধান বের করেন। কথিত আছে, তিনি আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধক্ষেত্রের পরিখার ভেতর বসে এই সমাধান বের করেন। আর এই সমাধান হচ্ছে ব্ল্যাক হোলের একটা গাণিতিক (তাত্ত্বিক) প্রমাণ, যা ‘শোয়ার্জশিল্ড মেট্রিক’ নামে পরিচিত। নিঃসন্দেহে ব্ল্যাক হোল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও রহস্যময় বিষয়গুলোর অন্যতম।

এখন থেকে ১০৪ বছর আগে, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আপেক্ষিকতাবাদের সাধারণ তত্ত্বটি প্রস্তাব করেন। পাঠক লক্ষ করুন, মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯০৫ সালে প্রস্তাব করা বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ কিন্তু আসলে আইনস্টাইনের মাস্টারপিস না। তার জন্য আইনস্টাইনকে আরও ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৯১৫ সালে তাঁর প্রস্তাব করা সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিঃসন্দেহে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট তত্ত্ব। মাত্র গত মাসে প্রথমবারের মতো যে ব্ল্যাক হোলের ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তার অস্তিত্ব কিন্তু শোয়ার্জশিল্ড গাণিতিকভাবে অনুমান করেছিলেন সেই ১০৪ বছর আগে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ব্যবহার করেই। এখানে শোয়ার্জশিল্ড মেট্রিক সমাধানটা দিয়ে দিচ্ছি, কেবলই পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রদের কৌতূহলী করার জন্য। 

শোয়ার্জশিল্ড মেট্রিক
শোয়ার্জশিল্ড মেট্রিক

বলে রাখা ভালো, ব্ল্যাক হোলের ধারণা কিন্তু আরও পুরোনো। জন মিচেল নামের এক ব্রিটিশ জ্যোর্তিবিদ ১৭৮৪ সালে প্রথম ব্ল্যাক হোলের সম্ভাবনার কথা বলেন। মিচেল এদের নাম দেন অন্ধকার নক্ষত্র। উনি দেখান যে যদি এমন নক্ষত্র থাকে, যার ঘনত্ব প্রায় সূর্যের মতো, কিন্তু যা আকৃতিতে সূর্যের ৫০০ গুণ বড়, তাহলে তার পৃষ্ঠের ‘এসকেপ ভেলোসিটি’ আলোর গতির থেকে বেশি হবে। ‘এসকেপ ভেলোসিটি’ হলো এমন একটা গতিবেগ, যাতে কোনো গ্রহ বা নক্ষত্রের পৃষ্ঠের ওপর থেকে কোনো বস্তুকে ছুড়ে দিলে তা আর ওই গ্রহ বা নক্ষত্রে ফিরে আসবে না। মানে গতিবেগ এতটাই বেশি যে গ্রহ বা নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় বল ও তাকে পৃষ্ঠে ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট না। এখন ‘এসকেপ ভেলোসিটি’ আলোর গতির থেকে বেশি হওয়ার মানে হলো আলোও ওই বস্তুর পৃষ্ঠ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। তার মানে মূলত কিছুই বের হয়ে আসতে পারবে না। কারণ, আলোর গতি হলো সর্বোচ্চ গতিবেগ। তবে সেটা আমরা জানতে পারি আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ থেকে আরও অনেক পরে। জন মিচেলের সময় ব্যাপারটিকে কৌতূহলোদ্দীপক ভাবা হতো এই কারণে যে এমনটা হওয়ার মানে হচ্ছে—এমন বহু নক্ষত্র থাকতে পারে, যা আমদের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে আছে।

ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবি (Event Horizon Telescope) ও কার্ল শোয়ার্জশিল্ড
ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবি (Event Horizon Telescope) ও কার্ল শোয়ার্জশিল্ড

সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে ভাবা যায় ভর অথবা শক্তির উপস্থিতিতে স্থান–কালের একধরনের চলমান প্রতিক্রিয়া হিসেবে। সহজভাবে বললে বস্তু অথবা পদার্থের উপস্থিতির প্রভাবে স্থান–কালের বক্রতা তৈরি হয়। বস্তুর ভর যত বেশি হয়, বক্রতাও তত বেশি হয়। এখন পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাতেই সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ব্যর্থ হয়নি। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ মূলত মহাকর্ষীয় বলের কিছু গাণিতিক সমীকরণ। এই সমীকরণের অনেক ধরনের সমাধান হতে পারে। সমাধানগুলো কেমন হবে, তা নির্ভর করে কী ধরনের বস্তু আছে তার ওপর। একটা খুব মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ স্থান-কালের একটা অতি বিচিত্র সমাধান অনুমোদন করে। বিচিত্র এই কারণে যে সমাধানগুলো কোনো একটা ক্ষেত্রে গিয়ে সিঙ্গুলার হয়ে যায় বা গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য থাকে না। এই সমাধানগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে স্থান–কালের বক্রতা অতিরিক্ত বেশি। এটা শুধু গাণিতিক খেলা না, আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বেই এ ধরনের স্থান–কালের অস্তিত্ব আছে। এই বিশেষ স্থান–কালের উপস্থিতি দেখা যায় ব্ল্যাক হোলের ভেতর। তবে পদার্থবিজ্ঞান এ ধরনের সিঙ্গুলার সমাধান পছন্দ করে না। তার কারণ হলো, সিঙ্গুলারিটিতে আমাদের পরিচিত স্থান-কালের গাণিতিক ধারণাটা কাজ করে না। তবে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, প্রকৃতি এই অদ্ভুত ব্যাপারটা বাইরের observer অর্থাৎ আমাদের কাছ থেকে event horizon দিয়ে আড়াল করে রাখে। Event Horizon হলো ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি এমন একটা এলাকার সীমারেখা যেখান থেকে আলোকরশ্মি ফিরে আসতে পারে না।

ব্ল্যাক হোল ব্যাপারটা আসলে কী, গণিত বাদ দিয়ে এটাকে কীভাবে চিন্তা করা যেতে পারে—একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। ধরা যাক, এক টুকরা আয়তাকার কাপড়ের চারটা কোনাকে চারটা পোলের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে ভূমির সঙ্গে সমান্তরালভাবে। এখন এর ওপর একটা ভারী বল রাখলে তা কাপড়ের মধ্যভাগকে একটু নিচের দিকে বাঁকিয়ে দেবে। বলের ভর যত বেশি হবে এই বাঁকানোর পরিমাণও তত বেশি হবে। গ্রহ ও নক্ষত্ররা স্থান ও কালকে অনেকটা এভাবেই বাঁকায়। কিন্তু যদি এমন হয় যে বলটার ভর অতিরিক্ত বেশি, তাহলে সেটা স্থান-কালকে অতিরিক্ত পরিমাণে বাঁকিয়ে দেবে। ব্ল্যাক হোলের ক্ষেত্রে এমনই হয়। এ ক্ষেত্রে ব্ল্যাক হোল স্থান–কালকে এত পরিমাণ বাঁকিয়ে দেয় যে সেটা থেকে আর কেউ বের হয়ে আসতে পারে না। এটা ছিল ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে পদার্থবিদদের সাধারণ ধারণা।

নক্ষত্র স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয় ও ব্ল্যাক হোল স্থান-কালকে খুব বেশি বাঁকিয়ে দেয়
নক্ষত্র স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয় ও ব্ল্যাক হোল স্থান-কালকে খুব বেশি বাঁকিয়ে দেয়

সত্তরের দশকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ও জ্যাকব বেকেনস্টাইন প্রমাণ করেন যে ব্ল্যাক হোল পুরোপুরি ব্ল্যাক না, অর্থাৎ ব্ল্যাক হোল থেকেও বের হয়ে আশা সম্ভব। আরও পরিষ্কার করে বললে ব্ল্যাক হোল থেকেও শক্তির বিকিরণ হয়। হকিংয়ের নাম অনুসারে একে ‘হকিং বিকিরণ’ বলে। এই ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্য হকিং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ব্যবহার করেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় শূন্যতা (vacuum) বলে একটা বিশেষ ধারণা আছে। ব্যাপারটি এ রকম, কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় শূন্য থেকে একটা কণা এবং প্রতি-কণার জোড়া তৈরি হতে পারে। ধরা যাক এমনই একটা কণা এবং প্রতি-কণার জোড়ার কথা, যেখানে কণাটি ব্ল্যাক হোল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিন্তু প্রতি-কণাটি ব্ল্যাক হোলের ভেতর পতিত হচ্ছে। ব্যাপারটি একটু অন্যভাবে ব্ল্যাক হোলের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। যেহেতু প্রতি কণা ব্ল্যাক হোলের ভেতর পতিত হচ্ছে, তাই কার্যকরীভাবে এর মানে হচ্ছে ব্ল্যাক হোল ভর হারাচ্ছে ‘হকিং বিকিরণ’ হিসেবে। আর যদি এই প্রক্রিয়া ক্রমাগত চলতে থাকে, তাহলে একসময় ব্ল্যাক হোল হয়তো পুরোপুরি উবে যাবে।

তবে চমৎকার এই তত্ত্ব জন্ম দিয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্যারাডক্সের। প্যারাডক্সটি বোঝার জন্য শুরুতে ব্ল্যাক হোলের গঠন নিয়ে সামান্য আলোচনা করা যাক। ব্ল্যাক হোলকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করার জন্য পদার্থ বা ঠিকভাবে বললে কণার তিনটি বৈশিষ্ট্য—ভর, কৌণিক ভরবেগ এবং চার্জ—মাত্র এই তিন উপাদানের প্রয়োজন হয়। বস্তুর অন্য সব বৈশিষ্ট্যসম্পর্কিত তথ্য ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজনের ভেতর হারিয়ে যায়। অর্থাৎ বাইরে থেকে কোনো উপায় থাকে না ওই তথ্য জানার। কিন্তু ব্ল্যাক হোলের ভেতর থেকে যে ‘হকিং বিকিরণ’ বের হয়, তা থার্মাল বিকিরণ এবং খুবই সাধারণ বৈশিষ্ট্যধারী। শুধু তা–ই নয়, এই বিকিরণ শুধু ব্ল্যাক হোলের ভেতরের পদার্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল, তাই এই বিকিরণ থেকে তেমন কিছুই জানা যায় না। তার মানে হচ্ছে যে প্রাথমিক অবস্থা ব্ল্যাক হোল তৈরির জন্য দায়ী, তার সব তথ্য হারিয়ে যায়। কিন্তু এটা একটা বিশাল সমস্যা, কারণ তা পদার্থবিজ্ঞানের একটা মৌলিক ধারণার পরিপন্থী। পদার্থবিজ্ঞান বলে, তথ্য কখনো হারিয়ে যেতে পারে না। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী আমাদের ব্ল্যাক হোল তৈরির প্রাথমিক অবস্থা পুনর্নির্মাণ করতে পারা উচিত। আর এই টানাপোড়নই হলো বিখ্যাত Black Hole Information Paradox, যা এখনো মোহাবিষ্ট করে রেখেছে পৃথিবীর বহু তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীকে।

আসলে এই সমস্যাটার কোনো সর্বজনসম্মত সমাধান এখনো নেই। গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বহু পদার্থবিজ্ঞানী এই সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন। স্টিফেন হকিংয়ের প্রবাদতুল্য খ্যাতির এটাও একটা কারণ। তবে সমস্যা হলো যে সমাধানগুলো এখন আছে, তার সবই পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক কাঠামোর কিছু পরিবর্তনের কথা বলে, যা স্বভাবতই বেশির ভাগ পদার্থবিজ্ঞানী পছন্দ করেন না বা মানতে পারেন না। পরবর্তীকালে বিষয়টিতে আবার ফিরে আসব।

ভালো একটা কবিতা বা উপন্যাস লিখতে হলে ভাষার ভালো দখল থাকা দরকার। তবে একদম শুরুতে দরকার ভাষাটা জানা। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার প্রযোজ্য। এখানে কিছু করতে হলে আগে এই ভাষাটা শিখতে হয়। নিকট অতীতে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে যেসব বিরল প্রতিভাধর ব্যক্তিকে দেখা গেছে, তাঁরা কিন্তু সবাই ভাষাটা শিখেছেন, তারপর অবদান রাখতে পেরেছেন। যাঁরা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে চান এবং বা করছেন, তাঁদের বলছি, এটা একটা আনন্দময় ভুবন। প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শেখা, সৃষ্টির রহস্যভেদের চেষ্টা—সবকিছু মিলিয়ে অসাধারণ। কিন্তু কিছু সমস্যাও আছে, এই বিষয়ে একাডেমিক চাকরি নেই বললেই চলে। তবে আশার কথা, পদার্থবিজ্ঞান সম্ভবত সবচেয়ে ভালো প্রশিক্ষণ দেয়, যা অন্য প্রায় সব ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্ররা অন্য সব বিষয়ে সাধারণত ভালো করে। কাজেই পদার্থবিজ্ঞান পড়ে পদার্থবিজ্ঞানীই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের প্রশিক্ষণটাকে ঠিকমতো ব্যবহার করা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পৃথিবীর বহু সফল ব্যক্তি যেমন আঙ্গেলা ম্যার্কেল, অ্যালন মাস্ক তাঁদের মৌলিক প্রশিক্ষণ কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানেই।

ড. সাজিদ হক: শিক্ষক ও গবেষক, স্ট্রিং থিওরি অ্যান্ড কসমোলজি, ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসর, কানাডা
ই-মেইল: [email protected]