সফলতার মূলে না পাওয়া সেই ৩ ডলার

রফিক উল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত
রফিক উল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত

রফিক উল্লাহ ২০০৯ সালে ঢাকার ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে ইংরেজিতে স্নাতক পড়ার সময় বাবা রহিম উল্লাহ মজুমদারের কাছ থেকে পেনশনের টাকা নিয়ে শেয়ার ব্যবসা শুরু করেন। মোটামুটি ভালো লাভের মুখ দেখতে পান। পরে আরও কিছু টাকা ঋণ নিয়ে শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন।

অল্প কিছুদিনের মধ্যে শেয়ার ব্যবসা খারাপ হতে শুরু করে নামে ধস। রফিক উল্লাহ পড়ে যান বিপদে। অনেক টাকার ক্ষতি, সঙ্গে আবার ঋণের টাকার জন্য ২৮ হাজার টাকা লাভ প্রতি মাসে বুঝিয়ে দিতে হয়। পুরো আকাশটা যেন মাথার ওপর ভেঙে পড়ে। এত টাকা রফিক কীভাবে পরিশোধ করবেন, কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পরিবার ও বাইরের লোকজনের বাঁকা কথা শুনতে হতো। তাঁর মনে হলো, আর কখনো মনে হয় এই টাকাগুলো পরিশোধ করতে পারবেন না। বারবার মনে হতো মরে গেলে হয়তো বেঁচে যাবেন। চাকরির বাজারও খুব খারাপ। তা ছাড়া চাকরি করেও এত টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়।

রফিক নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। ২০১১ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে জানলেন। ফ্রিল্যান্সিং করে ভালো টাকা আয় করা যায়। আর অনেকেই মাসে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা আয় করছেন। রফিক নিজেকে বোঝালেন, এটা ভালোভাবে করতে পারলে টাকাগুলো পরিশোধ করা সম্ভব।

এরপর গুগল, ইউটিউবে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং বিষয়টি জানাবোঝার চেষ্টা শুরু হলো রফিকের। তখন ইন্টারনেটে প্রচুর ব্লগ পড়তেন আর শিখতেন কীভাবে অ্যাকাউন্ট খোলা যায় আর কীভাবে কাজ পাওয়া যায়। ২০১২ সাল থেকেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু হয় রফিকের। নিজে নিজেই ওডেস্কে (বর্তমান আপওয়ার্কস) অ্যাকাউন্ট খুললেন। তখন রফিক জানতেন না কোন কাজটা তাঁর জন্য ভালো হবে, তাই সহজ সহজ কাজগুলো খুঁজতেন। আর খুঁজতে খুঁজতেই প্রথম যে কাজ পেলেন রফিক, সেটা ছিল ফেসবুকে লাইক দেওয়ার একটা কাজ। রফিক বললেন, ‘ওই কাজের বাজেট ছিল মাত্র ৩ ডলার। কাজটা নিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রথম কাজ করার পর টাকাটা পাইনি।’

হতাশ হলেন না। কিছুদিনের মধ্যে সার্জ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের (এসইও) একটা কাজ পেলেন রফিক। তাঁর গ্রাহক ছিলেন একজন মার্কিন ভদ্রলোক। ফ্রিল্যান্সিংয়ে টিকে থাকার জন্য রফিককে পরে অনেক সাহায্য করেছেন তিনি। রফিক বলেন, ‘একদিন তাঁরা আমাকে ওয়েবসাইটের কন্টেন্ট হালনাগাদ করার জন্য একটি নির্দেশিকার ফাইল দিলেন। সেটা করে আমি অনেক মজা পাই। এরপর তাঁরা আমাকে ছোট ছোট কাজ দিতেন। এদিকে প্রতিদিন কিছু না কিছু ওয়েবসাইট ডিজাইনের ভিডিও টিউটরিয়াল দেখতাম। এভাবে করতে করতে আমি ওয়েবসাইট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের কাজ শিখলাম। বর্তমানে বিগকমার্স অ্যান্ড শপিফাই থিম তৈরি নিয়ে কাজ করছি আপওয়ার্ক মার্কেটপ্লেসে।’ এভাবেই রফিকের দিন ফিরতে থাকে।

২০১৩ সাল থেকে প্রতি মাসে বাসায় ২০ হাজার টাকা দেওয়া শুরু করলেন রফিক। গত বছর বাবার পেনশনের ও ঋণের টাকা শোধ করেছেন। আবেগপ্রবণ হয়ে রফিক বলেন, ‘একটা বিষয় খুব অনুভব করি, নিজেকে শেষ করে দিলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। আমি সেই সময়টা অনেক কষ্ট করেছি। শূন্য থেকে আবার শুরু করতে হয়েছে।’

যখন কাজ শুরু করেছিলেন, তখন ১৫-১৬ ঘণ্টা সময় দিতেন রফিক। এখন আর অত সময় দিতে হয় না। গ্রাহক ডেটাবেইস তৈরি হয়ে গেছে এবং প্রতি ঘণ্টার পারিশ্রমিক (আওয়ারলি রেট) বেশি হয়েছে, তাই এখন প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা সময় দেন।

এখন রফিকের মাসিক আয় ৭ হাজার ডলার। বর্তমানে রফিক ই-কমার্স (বিগকমার্স) সাইট ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছেন আপওয়ার্ক মার্কেটপ্লেসে। বিগকমার্স একটা বেসরকারি কোম্পানি, যারা ই-কমার্স ব্যবসার জন্য সফটওয়্যার তৈরি করে। ২০১৫ সালে তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েটিভ আইটি আয়োজিত বাংলাদেশের সেরা ফ্রিল্যান্সারদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন রফিক। ২০১৯ সালে আপওয়ার্ক বাংলাদেশের সেরা ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি।

নতুনদের জন্য...
● ধৈর্য ধরতে হবে, হতাশ হলে চলবে না।
● তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে ইংরেজি যোগাযোগ, গ্রাহক ব্যবস্থাপনা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দক্ষতা।
● কাজ পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো কভার লেটার এবং তাৎক্ষণিক উত্তর দেওয়ার বা সাড়া দেওয়া।
● খুব বড় কভার লেটার লেখার দরকার নেই। গ্রাহক বা ক্লায়েন্ট কী চাচ্ছে, সেটার ওপর গুরুত্ব দিয়ে ৩-৪ লাইনের মধ্যে লিখলেই হয়।