জাপানি, না অন্য গাড়ি

গাড়ি
গাড়ি

দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে গাড়ির চাহিদা। গাড়ি বিক্রেতা-প্রতিষ্ঠানগুলোও নিয়ে আসছে নিত্যনতুন মডেলের গাড়ি। বাংলাদেশের রাস্তায় চলে এমন গাড়ির সিংহভাগই জাপানের তৈরি। রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বাজার জমজমাট। তবে নতুন গাড়ির (ব্র্যান্ড নিউ) বাজারও একেবারে পিছিয়ে নেই। জাপানের অভ্যন্তরীণ বাজারে যেসব গাড়ি পাওয়া যায়, তা জাপানে ব্যবহারের পর আফ্রিকা এবং বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করে। এতে গাড়িগুলো কম মূল্যে দেশের বাজারে পাওয়া যায়। এর বাইরে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশের গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠানের গাড়িও পাওয়া যায় দেশে।

গাড়ির বৈশিষ্ট্য ও নিরাপত্তার দিক থেকে ইউরোপীয় গাড়িগুলো বেশ এগিয়ে। তবে সমস্যা হলো ইউরোপের গাড়িগুলোর দামও বেশ চড়া। বেশির ভাগ গাড়ি আসে ব্র্যান্ড নিউ হিসেবেই। ওই সময় উচ্চ মূল্যে কেনা হলেও পরবর্তী সময়ে বিক্রির সময় এই গাড়িগুলোতে ভালো দাম পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রকম গাড়ির ক্রেতারা ব্র্যান্ড ভ্যালুকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। নিরাপত্তা, আরাম অথবা ভ্রমণের তৃপ্তির চেয়েও বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জ অথবা অডির গাড়িগুলো বেশি বিক্রি হয়।

জাপানের বেশ কয়েকটি অটোমোবাইল নির্মাতা-প্রতিষ্ঠানের গাড়ি দেশের বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। টয়োটা যাদের মধ্যে অন্যতম। নাভানা লিমিটেড দেশের বাজারে টয়োটা ব্র্যান্ড নিউ গাড়িও বিক্রি করে। নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত সব ধরনের গ্রাহকের কথা মাথায় রেখে টয়োটা গাড়ি উৎপাদন করে। দেশের বাজারে টয়োটা ভিটজ, প্রোবক্স, একুয়া, এক্সিউ, ফিল্ডার (হ্যাচবেক), এলিয়ন, প্রিমিও, সিএইচআর, র‌্যাব ফোর, অ্যাভানজা, প্রিয়াস, ইয়ারিস, আইএসটিসহ টয়োটার রয়েছে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় মডেল। টয়োটা গাড়ির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো যন্ত্রাংশের সহজলভ্যতা। যেকোনো যন্ত্রাংশ সারা দেশেই সহজে মেলে।

ইউরোপীয় গাড়িগুলোর মধ্যে বিএমডব্লিউ ও মার্সিডিজ বেঞ্জের জনপ্রিয়তা লক্ষণীয়। কোটি টাকার বেশি মূল্যের গাড়িগুলোর ফিচার এবং নিরাপত্তার দিকগুলোও বেশ জোরালো। বিএমডব্লিউ ৭ সিরিজে রয়েছে স্মার্ট ট্যাব। এই ট্যাব দিয়ে পেছনের সিট থেকেই গাড়ির অভ্যন্তরীণ ফিচারগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্লাগ ইন হাইব্রিডের এই গাড়িগুলো ফুয়েলসাশ্রয়ী। এ ছাড়া বিএমডব্লিউর স্পোর্টস একটিভিটি ভেহিক্যাল (এসএভি) রয়েছে। দেশের বাজারে বিএমডব্লিউ গাড়ির পরিবেশক এক্সিকিউটিভ মোটরস লিমিটেড আর মার্সিডিজ বেঞ্জ নিয়ে আসছে র‌্যাংগস লিমিটেড।

জাপানি ব্র্যান্ডের মধ্যে অন্যতম আরেকটি অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠান হলো মিতশুবিশি। অ্যাট্রাজ, ল্যান্সার, পাজেরো স্পোর্টস, এল২০০, ইকলিপস ক্রস, এক্সপেন্ডার, আউটল্যান্ডারসহ মিতশুবিশির বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গাড়ি রয়েছে। র‌্যাংগস  লিমিটেড দেশের বাজারে ব্র্যান্ড নিউ মিতশুবিশি আমদানি করে। চলতি বছর এই প্রতিষ্ঠানটি প্লাগ ইন হাইব্রিড ২০১৯ মডেলের আউটল্যান্ডার দেশের বাজারে নিয়ে আসবে। গাড়িটি দুই লিটার জ্বালানি খরচ করে ১০০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে সক্ষম।

গাড়ি
গাড়ি

জার্মানির অন্য আরেকটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের নাম অডি। দেশের বাজারে অডি বিক্রি করে প্রগ্রেস মোটরস ইমপোর্ট লিমিটেড। এথ্রি, ফোর, ফাইভ, সিক্স, সেভেন, এইটসহ কিউ মডেলের কিউটু, থ্রি, ফাইভ, এইট গাড়িগুলো এসএউভি প্রকৃতির। অডির গাড়িতে হিডস আপ ডিসপ্লে, পপ আপ মাল্টিমিডিয়া প্লেয়ার, ভয়েস কমান্ড, টাচ স্ক্রিনে গাড়ির সব নিয়ন্ত্রণ, প্যানারোমিক সানরুফ, ৬-৮টি এয়ারব্যাগসহ বেশ কয়েকটি আধুনিক ফিচার রয়েছে। ভার্চ্যুয়াল ক্লাস্টারসমৃদ্ধ ড্যাশবোর্ডগুলোও গাড়ির চালকের জন্য আলাদা সুবিধা প্রদান করে। চাইলে ভেতরের ইন্টেরিয়রের লাইটিংয়ের রংও বদলে ফেলা যায়। ৬৫ লাখ থেকে ২ কোটি টাকার মধ্যে গাড়িগুলো দেশের বাজারে পাওয়া যায়।

হোন্ডা গাড়ির কথা কে না জানে? জাপানের এই গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠান সাম্প্রতিক কালে বেশ কয়েকটি মডেলে অটোমোবাইল গ্রাহকদের মন কুড়িয়েছে। হোন্ডা অ্যাকর্ড, সিটি, সিভিক, এইচআরভি, সিআরভি মডেলের গাড়িগুলো ব্র্যান্ড নিউ পাওয়া যায় দেশের বাজারে। ডিএইচএস মোটরস লিমিটেড ব্র্যান্ড নিউ হোন্ডা গাড়িগুলোর একমাত্র পরিবেশক। এ ছাড়া রিকন্ডিশন্ড মার্কেটে হোন্ডা গ্রেস এবং ভেজেল বেশ জনপ্রিয়।

সুইডেনের বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠান ভলভোর বিলাসবহুল গাড়ি মেলে দেশের বাজারে। ব্র্যান্ড নিউ এই গাড়িগুলো আমদানি করে আনোয়ার গ্রুপ। ভলভো গাড়ি সারা পৃথিবীতেই নিরাপদ এবং আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য জনপ্রিয়। ভলভো এস৯০, এক্সসি ৬০, এক্সসি ৯০সহ ভলভোর রয়েছে আধুনিক ফিচারসমৃদ্ধ আকর্ষণীয় গাড়ি। ২০১৯ মডেলের এই গাড়িগুলোর মূল্য কোটি টাকার ওপরে।

জাপানি গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিশান, সুজুকি, মাজদা, সুবারুর গাড়িগুলো নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত সব ধরনের গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করে আসছে। নানা মডেলের এই গাড়িগুলোর দেখা সহজেই মেলে রাজধানীর অলিগলিতে। হাতের নাগালে গাড়িগুলোর মূল্য, রিসেল ভ্যালু, যন্ত্রাংশগুলো সহজেই মেলে বলে সারা দেশেই এই গাড়িগুলোর চাহিদা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই ও কিয়া, ফ্রান্সের রেনল্ট, চীনের হাভাল, মালয়েশিয়ার প্রোটন, ভারতের মাহিন্দ্রার নতুন গাড়ি পাওয়া যায় দেশের বাজারে। জাপানি গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অন্যান্য গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠানের যে বিষয়টি সবচেয়ে নজরে আসে তা হলো, ইউরোপীয় বা অন্যান্য দেশের গাড়ি সচরাচর নতুন ছাড়া দেশের বাজারে প্রবেশ করে
না। ফলে মূল্যের দিক থেকে এসব গাড়ির দাম আকাশছোঁয়া হয়। একই মূল্যে জাপানের রিকন্ডিশন্ড বাজারে যে গাড়ি পাওয়া যায়, সেই গাড়ি তৈরির সাল ব্যতীত মোটামুটি সবকিছুই ফিচারসমৃদ্ধ হয়।

 বেশির ভাগ গাড়ি ফিচার অনুসারে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত থাকে। এই ক্যাটাগরিগুলো গাড়ির ফিচার, অভ্যন্তরীণ সুযোগ-সুবিধা, চাকা, স্টার্টের মাধ্যম, ডুয়েল জোন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রসহ বেশ কয়েকটি উপকরণের ওপর নির্ভর করে। ইউরোপিয়ান গাড়িগুলোতেও এ ধরনের গ্রেডিংয়ের ব্যাপার থাকে। এ ছাড়া গ্রাহকের পছন্দ অনুসারে গাড়ি মডিফাইড করার অপশনও রয়েছে।

গাড়ি
গাড়ি

সাশ্রয়ী মূল্যে এবং সহজ কিস্তি সুবিধায় দেশের বাজারে রয়েছে ভারতের গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠান টাটার বেশ কয়েকটি ব্যক্তিগত গাড়ি। টাটা ন্যানো, ইন্ডিগো ইএস, টিয়াগো গাড়িগুলো সহজ শর্তে কেনা যায়। ফিচারের দিক থেকে এই গাড়িগুলোতে আধুনিক অনেক সুযোগ-সুবিধা অনুপস্থিত। তবে শুধু শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কেবিনে আসা-যাওয়ার জন্য এই গাড়িগুলো বেসিক কারের অভাব পূরণ করে। এ ছাড়া টাটার নেক্সন মডেলের ডিজেল এবং অকটেনচালিত এসইউভি রয়েছে। দেশে টাটা গাড়ির পরিবেশক নিটল নিলয় মোটরস লিমিটেড।

এসইউভি নিয়ে বাংলাদেশের অটোমোবাইল বাজারে ব্যবসা করে যাচ্ছে চীনের বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠান গ্রেটওয়াল। এসইউভি ক্যাটাগরিতে এই গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডের নাম হাভাল। ১৫০০ থেকে ২০০০ সিসির মধ্যে হাভাল এইচটু, এইচসিক্স এবং এইচনাইন এই তিন ক্যাটাগরিতে হাভালের এসইউভি গাড়ি রয়েছে। হালনাগাদ বছরের এই গাড়িগুলোতে অত্যাধুনিক সব ফিচারের দেখা মিলে। প্যানারোমিক সানরুফ, ড্রাইভিংয়ে স্যান্ড মুড, তিনটি জোনে এসিসহ গাড়িগুলোর মূল্য ব্র্যান্ড নিউ হিসেবে সাশ্রয়ী। দেশের বাজারে হাভালের একক পরিবেশক এইস অটোস লিমিটেড।

জাপানি গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠান সুজুকি দেশের বাজারে নিয়ে এসেছে দুটি হাইব্রিড গাড়ি। সুজুকি সিয়াজ এবং আর্টিগা গাড়িগুলো ব্র্যান্ড নিউ মিলবে। সাত আসনবিশিষ্ট আর্টিগা ১৫০০ সিসি সেগমেন্টে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। উত্তরা মোটরস লিমিটেড দেশের বাজারে সুজুকি গাড়ি বিক্রয় করছে।

জাপানি গাড়ির চাহিদার সঙ্গে দেশের বাজারে অন্যান্য দেশের গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা আনুপাতিক হারে অনেক পিছিয়ে। ইউরোপিয়ান গাড়িগুলো মূলত উচ্চবিত্ত এবং হাই অফিশিয়ালদের প্রথম পছন্দ। গাড়িগুলোর মূল্য অনুসারে চড়তেও বেশ আরাম এবং নিরাপদ। মূলত ইউরোপিয়ান গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠানগুলো গাড়ির মানের ক্ষেত্রে আপসহীন। যেহেতু এই গাড়িগুলোর গ্রাহকেরা দামের চেয়ে মানের ব্যাপারে বেশি সচেতন, সেহেতু গাড়িগুলো বিক্রিতে চ্যালেঞ্জও কম।

গাড়িতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ব্র্যান্ড এবং গাড়ির মূল্যের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সব গাড়িতেই নিজস্ব কিছু ফিচার থাকে। মডেল অনুসারে প্রতিটি গাড়িতেই ভিন্ন কিছু সুযোগ-সুবিধা মেলে। এক গাড়িতে সব মিলে গেলে গ্রাহকেরা হয়তো অন্য মডেলের কোনো গাড়ি কিনতেন না। তাই পৃথিবীর কোনো গাড়িতেই সব সুযোগ-সুবিধা একসঙ্গে মেলে না। গ্রাহকের বিশ্বস্ততা গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।