রান্না শিখিয়ে সফল ইউটিউবার উম্মি

উম্মি সেলিমের ইউটিউব চ্যানেলের গ্রাহকসংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়েছে। ছবি: স্মার্ট সময়
উম্মি সেলিমের ইউটিউব চ্যানেলের গ্রাহকসংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়েছে। ছবি: স্মার্ট সময়
>উম্মি রাঁধেন, চুল বাঁধেন, সে সঙ্গে শেখান রন্ধনপ্রণালি। আর তা ইউটিউবে। ‘কুকিং স্টুডিও বাই উম্মি’ নামের ইউটিউবে নিজের চ্যানেল আছে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী উম্মি সেলিমের। বর্তমানে চ্যানেলটির গ্রাহকসংখ্যা ১২ লাখের বেশি। ২৮ জুন প্রথম আলোকে শুনিয়েছেন তাঁর ইউটিউবার হয়ে ওঠার গল্প। নতুনদের জন্যও দিয়েছেন পরামর্শ।

বাঙালিরা নিজে খেতে যেমন ভালোবাসে, তেমনই অন্যকে খাইয়েও আনন্দ পায়। ভোজনরসিকের তকমা তো এমনি এমনি মেলেনি। সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েও সে কথা ভোলেননি উম্মি সেলিম। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইউটিউবের মাধ্যমে গোটা বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন নানা পদের রান্নার কলাকৌশল।

উম্মি রাঁধেন, চুল বাঁধেন, সে সঙ্গে শেখান রন্ধনপ্রণালি। মানে রান্নার ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেন ‘কুকিং স্টুডিও বাই উম্মি’ নামের ইউটিউব চ্যানেলের লাখো দর্শকের কাছে। বর্তমানে উম্মির চ্যানেলটির গ্রাহকসংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়েছে। সম্প্রতি দেশে এসেছেন তিনি। ২৮ জুন ঢাকায় বসে প্রথম আলোকেশুনিয়েছেন রন্ধনশিল্পী হিসেবে তাঁর ইউটিউবার হয়ে ওঠার গল্প। 

রাঁধেন ভালোবেসে

রান্নার প্রতি উম্মির ভালোবাসার জন্ম অল্প বয়সেই। বললেন, ‘ঈদের সময় ডেজার্টগুলো আমি আর আমার বোন মিলে বানাতাম। আম্মু যখন রান্না করতেন, তখন রান্নাঘরে উঁকিঝুঁকি দিতাম।’ ঈদ ছাড়া অন্যান্য সময়ে অবশ্য রান্না মা-ই করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে পাঁচ-ছয় মাস ঘরেই ছিলেন। তখন প্রতিদিন বিকেলে কিছু না কিছু বানাতেন। সবাই খুব প্রশংসা করত। জানালেন, ‘প্রশংসা শুনে পরদিন ভাবতাম আরও ভালো কিছু বানাই। যেন সবাই আরও বেশি পছন্দ করে।’ 

প্রবাসে সঙ্গী রান্না

বিয়ের পরে ২০১২ সালে স্বামীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে যান উম্মি সেলিম। সেখানে রান্না নিজেই করতেন। নিয়মিত রান্না করার সেটাও একটা কারণ। উম্মি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে সাহায্য করার কোনো লোক ছিল না। সব কাজ নিজেকেই করতে হতো। তা ছাড়া আমার বর খেতে খুব পছন্দ করেন। আমারও রান্না করতে ভালো লাগত। তাই ওই দেশে রান্নাই ছিল আমার অবসরের সঙ্গী।’ 

শুরু করেন আলুভাজি দিয়ে

প্রতিদিন বিভিন্ন স্বাদের পদ রান্না করতে করতে একরকম আগ্রহ তৈরি হয়। সে থেকে উম্মির স্বামী আসিব আদিদ ইউটিউব চ্যানেল খুলে দেন ২০১৫ সালে। সে সময় বাংলায় রান্নার খুব বেশি চ্যানেল ছিল না বলে উল্লেখ করেন উম্মি।

চ্যানেল খোলার পর প্রথম তিন মাস রান্নার কোনো ভিডিও দেননি উম্মি সেলিম। কারণ জানাতে গিয়ে বলেন, ‘আমার খুব লজ্জা লাগত। চ্যানেলে রান্না দেব, সেটা মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবে—এই বিষয়টা ভাবিয়ে তুলত।’ মাস তিনেক পর প্রথম আলুভাজির রেসিপি দেন তিনি। এরপর মুরগির রোস্ট। ‘আলুভাজির রান্না খুব বেশি মানুষ দেখেনি। প্রথম দিনে ৫০ কি ৬০ জনের মতো দেখেছিল। তবু তা দেখেই আমার খুব ভালো লেগেছিল। মানুষ যে দেখবে, তা-ই ভাবিনি।’ ওই ভালো লাগা থেকেই নিয়মিত ইউটিউব চ্যানেলে রান্নার ভিডিও দেওয়া শুরু করেন উম্মি। সাবস্ক্রাইবার বা গ্রাহক বাড়ল কি না, সেটা তাঁর চিন্তা ছিল না। 

ইউটিউব থেকেও আয়!

প্রথম এক বছর জানতেনই না যে ইউটিউব থেকে আয় করা যায়। বললেন, একদিন বেশ রাতে গুগল অ্যাডসেন্সসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে পারি ওয়েবসাইট থেকে। তখন অ্যাডসেন্সের বিষয়ে খোঁজখবর নিই। আমার চ্যানেলে গুগল অ্যাডসেন্সের কোনো অ্যাকাউন্ট ছিল না। মানে আমার চ্যানেলটা অ্যাডসেন্সের সঙ্গে যোগ করাই ছিল না। এরপর আমি আমার চ্যানেলটা অ্যাডসেন্স অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত করি। তখন থেকে জানলাম ইউটিউবে রান্নার ভিডিও দেখিয়েও আয় করা যায়।’ 

মাসিক আয় ওঠানামা করে

ইউটিউবে আয়ের কারিকুরি ব্যাখ্যা করলেন উম্মি। বললেন, ‘ইউটিউবে ভিডিও থেকে আয় নির্ভর করে বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) কতটুকু ভালো তার ওপর। কনটেন্ট ভালো হলে ভিউ বেশি হয়। আর ভিউ বেশি হলে বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। আয়টা হয় মূলত বিজ্ঞাপন থেকে। যার চ্যানেলে যত বিজ্ঞাপন, তার আয় তত বেশি।’

আয়ের ধরাবাঁধা হিসাব নেই ইউটিউবে। উম্মি মনে করেন, মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা আছে যে যত বেশি মানুষ দেখবে (ভিউ), তত বেশি আয় হবে। তবে বেশি ভিউ হলে বিজ্ঞাপন বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর বিজ্ঞাপন বেশি হলে আয়ও বেশি হয়। কোনো চ্যানেলের মালিক চাইলেই কিন্তু বিজ্ঞাপন আনতে পারবে না। বিজ্ঞাপন ইউটিউব কর্তৃপক্ষই দেয়। উম্মি সেলিম জানান, বর্তমানে আমি মাসে এক হাজার ডলারের মতো আয় করতে পারি। তবে সেটা কোনো কোনো মাসে কমবেশি হয়। 

ভিডিওর মান ভালো হতে হবে

উম্মি সেলিম জানান, প্রথমত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কনটেন্ট। কনটেন্ট যদি ভালো না হয়, তাহলে দর্শক দেখবে না। আর দর্শক না দেখলে আপনার আয়ও হবে না। এরপর আসে উপস্থাপনা। ধরুন একটা পরিষ্কার হাঁড়ির মধ্যে রান্না করা আর ময়লা হাঁড়ির মধ্যে রান্না করার মধ্যে অনেক তফাত আছে। বিষয়টা সুন্দর করে দেখাতেও হবে। আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী। তাই কনটেন্ট যদি দেখতে ভালো না হয়, তাহলে মানুষ সেটা দেখবে না। রান্নাঘর বা সেটও গুরুত্বপূর্ণ। ইউটিউবের ক্ষেত্রে কনটেন্টের শব্দও (অডিও) গুরুত্বপূর্ণ। সরাসরি কণ্ঠ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় বাইরের শব্দ চলে আসে। সে ক্ষেত্রে ভিডিও ধারণ করার পর অডিও যোগ করা যেতে পারে।

শেখেন সবার কাছেই

নিজে ভালো রান্না করেন। তবে তাঁর কার রান্না বেশি পছন্দের? উম্মি সেলিম বলেন, ‘আমি আসলে নির্দিষ্ট কারও রান্না পছন্দ করি না। তবে সবার রান্নাই ভালো লাগে। আমার কাছে রান্নার ব্লগ পড়তে খুব ভালো লাগে। রান্না বিষয়ে আমার জানতে ভালো লাগে। রান্নার যে কত বই আমার কাছে আছে, সেটা বলে শেষ করা যাবে না। আমি প্রতিনিয়ত শিখি। যে নতুন ইউটিউবার, তার কাছেও শিখি আবার যে বড় ইউটিবার, তার কাছেও শিখি।’

তবে উম্মির সবচেয়ে পছন্দ মায়ের রান্না। নিজে হালকা নাশতা বানাতে পছন্দ করেন। এর পাশাপাশি আছে বাঙালি খাবার। মানে মাছ-ভাত-ডাল রান্না করতেও ভালো লাগে তাঁর। 

ইউটিউবের স্বীকৃতি

আগেই লেখা হয়েছে, কুকিং স্টুডিও বাই উম্মি চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। এক লাখ সাবস্ক্রাইবার পার করে ইউটিউবের তরফ থেকে পেয়েছেন ‘সিলভার বাটন’। আর ১০ লাখ অতিক্রম করে পেয়েছেন ‘গোল্ড বাটন’। এখন তাঁর লক্ষ্য এক কোটি সাবস্ক্রাইবার অতিক্রম করে ডায়মন্ড বাটন পাওয়া। 

ভিডিও সম্পাদনা করেন নিজেই

রান্না করার জন্য উম্মি সেলিম স্টুডিও তৈরি করেছেন। দুটি ক্যামেরা দিয়ে সাধারণত রান্নার ভিডিও ধারণ করেন। ভিডিওগুলোর দৈর্ঘ্য সাধারণত ৫ থেকে ৬ মিনিট হয়ে থাকে। তবে মূল রান্না করতে উপকরণের ওপর সময় নির্ভর করে। মাংস হলে সময় এক রকমের, ডেজার্ট তৈরিতে আরেক রকমের সময় লাগে। উম্মি সেলিম ভিডিওগুলো নিজেই সম্পাদনা করেন, নিজেই অডিও যোগ করেন বলে জানান। 

টাকা আয় যেভাবে

অ্যাডসেন্স অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ তোলার জন্য কমপক্ষে ১০০ ডলার জমা হতে হবে। এটাকে বলে থ্রেশহোল্ড অ্যামাউন্ট। অতিক্রম করলে অ্যাডসেন্স থেকে আপনাকে একটি ই-মেইল পাঠানো হবে।

টাকা উত্তোলনের দুটি নিয়ম আছে। প্রথমত গুগল কর্তৃপক্ষ আপনার ঠিকানা যাচাই করবে। এ জন্য আপনার ঠিকানায় গুগল থেকে একটা চিঠি পাঠানো হবে। ওই চিঠিতে একটি গোপন নম্বর থাকবে। ওই নম্বর হাতে পাওয়ার আগে আপনি আয় করলেও টাকা উত্তোলন করতে পারবেন না।

চিঠি এলে এবং নম্বরটি অ্যাডসেন্স অ্যাকাউন্টে বসানোর পর আবার একটা ফরম পূরণ করতে হবে অনলাইনে। ওই ফরমে আপনি যে ব্যাংকে টাকা আনবেন সেই ব্যাংকের তথ্য দিতে হবে। চ্যানেলে মালিকের বয়স যদি ১৮ বছরের নিচে হয়, তাহলে ব্যাংকের তথ্যটা বাবা বা মায়ের নামে দিতে হবে।

অ্যাডসেন্সের ফরমটা যে নাম দিয়ে পূরণ করা, ব্যাংকের অ্যাকাউন্টটা অবশ্যই সেই নামে হতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্টের নামটাও একই হতে হবে। যদি নাম এক না হয়, তাহলে আপনি টাকা পাবেন না। সব ঠিকঠাক থাকলে ব্যাংকে টাকা আসা শুরু করবে।

টাকা আয় যেভাবে
টাকা আয় যেভাবে

নতুনদের জন্য পরামর্শ

প্রথমে ইউটিউব চ্যানেল খুলতে হবে। চ্যানেলের নাম দেওয়ার আগে ঠিক করতে হবে কোন ধরনের ভিডিও দেবেন। সে অনুযায়ী নামটা ঠিক করলে ভালো হয়। মানুষ যেন নাম দেখলেই বুঝে যায় চ্যানেলে এ ধরনের বিষয় পাওয়া যাবে। তারপর কয়েকটি ভিডিও দিয়ে চ্যানেলটা সাজাতে হবে।

চ্যানেল থেকে আয় বা মানিটাইজেশনের ক্ষেত্রে ইউটিউবে কিছু নিয়মকানুন আছে। যেমন আবেদনের জন্য বর্তমানে চ্যানেলে চার হাজার ঘণ্টা ওয়াচ টাইম (মোট ভিডিও দেখার সময়) আর এক হাজার সাবস্ক্রাইবার থাকতে হবে। আবেদন অনুমোদন করলে এরপর আপনার চ্যানেলে বিজ্ঞাপন আসা শুরু হবে। আর বিজ্ঞাপন আসার জন্য আপনার চ্যানেলটা অ্যাডসেন্স অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। আয়ের টাকা জমা হয় গুগলের এই সেবায়।

চ্যানেলের মালিক তাঁর জিমেইল ঠিকানা দিয়ে অ্যাডসেন্স অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। চ্যানেলটা ভালো কি না বা চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় কি না, এ সবকিছু পর্যালোচনা করে দেখে গুগল কর্তৃপক্ষ। যখন দেখবে চ্যানেলটি চার হাজার ঘণ্টা ওয়াচ টাইম এবং এক হাজার সাবস্ক্রাইবার অতিক্রম করছে, তখন অ্যাডসেন্স চ্যানেলের মালিককে ই-মেইলে জানানো হবে যে তাঁর অ্যাকাউন্টটি বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য উপযুক্ত এবং আয়ের যোগ্য। এরপর বিজ্ঞাপন দেখানো শুরু করবে।