সিলিকন ভ্যালির বিচিত্র জীবন

>যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির বাসিন্দারা নিজেদের ভিনগ্রহী হিসেবে দাবি করলে অবাক হবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার এই প্রযুক্তি শহরের প্রতিবেশীরাও নিজেদের অন্য গ্রহের প্রাণী ভাবতে পারেন। তাঁদের শরীরেও যে দোলা দিয়ে যায় সিলিকন ভ্যালির ‘আউলা বাতাস’। এই শহর এমনই ‘আউলা’ যে কেউ কেউ দৈনিক ঘণ্টা দশেকের পথ পাড়ি দিয়ে এখানে আসেন অফিস ধরতে। কেউ কেউ এমন সব গাড়ির ফরমাশ দেন, যার কিনা কেবল নকশা হয়েছে। আবার অনেকেই বাস করেন ‘মাত্র এক মিলিয়ন ডলারে’ কেনা ফ্ল্যাটে। দুনিয়ার বাঘা বাঘা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের আঁতুরঘর হিসেবে খ্যাত সিলিকন ভ্যালির বিচিত্র জীবনযাপনে একটু উঁকি মারা যাক। লিখেছেন মাহফুজ রহমান 

১. ডুবন্ত বাড়ির দাম ১০ লাখ ডলার
২০০৯ সালে সান ফ্রান্সিসকোর বে এরিয়ার মাটি ফুঁড়ে দাঁড়ায় মিলিনিয়াম টাওয়ার। ৫৮ তলার অট্টালিকাটি দাঁড়াতে না–দাঁড়াতেই তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বছরে ২ ইঞ্চি করে অধঃগমন হচ্ছে এর। গত বছরের হিসাব অনুযায়ী ১৭ ইঞ্চি তলিয়েছে, আর এক পাশে ঝুঁকে গেছে ৪ ইঞ্চির বেশি! অথচ এর একেকটি ফ্ল্যাটের দাম আকাশছোঁয়া—কমপক্ষে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার! সান ফ্রান্সিসকোর বে এরিয়াতেই গড়ে উঠেছে সিলিকন ভ্যালি। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ধনী হর্তাকর্তাদের চাহিদাই মূলত মিলিনিয়াম টাওয়ারের দাম আকাশে উঠিয়েছে। এ নিয়ে বে এরিয়ার পুরোনো বাসিন্দাদের বিরক্তির অন্ত নেই।

২. রাত কাটে গাড়ি আর কনটেইনারে
সান ফ্রান্সিসকোতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের বেতন গড়ে ১ লাখ ২৪ হাজার ডলার। চোখ কচলাচ্ছেন? একই এলাকার বাসাভাড়ার খবরটাও জেনে রাখুন। কর–টর দেওয়ার পর বেতনের যা থাকে, তার প্রায় অর্ধেকই গুনে দিতে হয় এক বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্টের জন্য! যেমন হাঁড়ি তেমন সরা। তাই সিলিকন ভ্যালির তুলনামূলক ‘দরিদ্র’ চাকরিজীবীরা অফিসের গাড়ি রাখার জায়গাগুলোকেই মাথা গোঁজার ঠাঁই বানিয়েছেন। সেখানে তাঁরা ঘুমান রিক্রিয়েশনাল ভ্যানে—বাইরে থেকে গাড়ি কিন্তু ভেতরে ঘরের মতোই। গত কয়েক বছরে অফিসের বাইরে ভ্যানে দোকানও খুলে বসেছেন অনেক কর্মী। এঁদের বড় অংশের ঠিকানা আবার গুগলের প্রধান কার্যালয়ের পার্কিংয়ে। যাঁরা গাড়িতে রাত কাটাতে নারাজ, তাঁরা আবার ভিন্ন ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। পাশের শহর অকল্যান্ডে প্রচুর শিপিং কনটেইনার মেলে। সস্তায় একটা কিনে ফেললেই ঘর হিসেবে দিব্যি চলে যায়।

৩. মাত্র ১০ ঘণ্টার অফিসযাত্রা
সিলিকন ভ্যালির ২০ শতাংশ কর্মী সান ফ্রান্সিসকোর বাইরে থাকেন। স্টকটন বা মডেস্টোর মতো শহরগুলো থেকে এই কর্মীরা সিলিকন ভ্যালিতে আসেন দেড় ঘণ্টায়। কিছু কর্মী আরও কয়েক কাঠি সরেস। বেন্ড ও অরিগনের মতো থাকা–খাওয়ায় তুলনামূলক সস্তা শহরে থাকেন এঁরা। সিলিকন ভ্যালিতে আসতে গাড়িতেই তাঁরা বসে থাকেন ১০ ঘণ্টা! এত ধৈর্য কোথায় পান কে জানে! আকাশপথে অবশ্য লাগে ৭০ মিনিট। এই সুবাদে বেন্ড ও অরিগন শহর দুটিতে বেডরুম ভাড়া দেওয়ার ব্যবসাও জমে উঠেছে।

৪. বক্তৃতার দাম ১০ হাজার ডলার
দুনিয়ার প্রযুক্তি, বিনোদন আর ডিজাইনের ভূত–ভবিষ্যৎ নিয়ে বছরে একবার সম্মেলন হয়—যাকে বলে টেড কনফারেন্স। আর সেখানে বিশেষজ্ঞদের বক্তৃতা শোনার মঞ্চ তৈরি করে দেয় টেড টকস। সিলিকন ভ্যালির টেড এলএলসি নামের প্রতিষ্ঠানটির এই আয়োজনে কথা বলতে আসেন বাঘা বাঘা পণ্ডিত। ফলে তাঁদের বক্তৃতায় কান দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহীর সংখ্যা অনেক। সুবিধা হলো, বক্তৃতাগুলোর ভিডিও শুয়ে, বসে, খেতে খেতে আরামসে দেখে নেওয়া যায় একদম বিনা মূল্যে। কিন্তু টেড টকসের বক্তৃতা সরাসরি শোনার খরচা কত জানেন? ১০ হাজার ডলার মাত্র। তা–ও আবার আপনি যদি সেখানে যাওয়ার অনুমতিপত্র পান! দরখাস্ত দিয়ে এবং গাঁটের পয়সা খরচ করে বক্তৃতা শোনার এই আয়োজনকে কী বলা যায়? ভাষণবিলাস!

৫. রাস্তায় না নামাতেই গাড়ি বিক্রি
সিলিকন ভ্যালির গাড়ি প্রসঙ্গ এলে ইলন মাস্কের নাম আসবেই। নতুনত্ব এবং পাগলামো—এই নিয়েই তাঁর টেসলা সিরিজ। টেসলার মডেল থ্রি নিয়েই কী ধুন্ধুমার ঘটে গেল! নকশা করে কেবল ঘোষণা দেওয়া শেষ, মানুষ রীতিমতো পাগল হয়ে গেল আগাম ফরমাস দেওয়ার জন্য। ‘গায়ের মূল্য’ ধরা হয়েছিল ৩৫ হাজার ডলার। যা কি না টেসলার সব মডেলের মধ্যে তুলনামূলক সস্তা। যা হোক, টেসলা মডেল থ্রি আসছে শোনার পর সাড়ে চার লাখ মানুষ আগাম ফরমাশ দিয়ে রেখেছিল। আগাম ফরমাশে দিতে হয়েছিল আড়াই হাজার ডলার করে। আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছিল দুই বছরের বেশি সময়! এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্লাগ–ইন ইলেকট্রিক কারের সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া গাড়ির রেকর্ড গড়েছে টেসলা মডেল থ্রি।

৬. সাধারণ পানিকে ‘না’
খাবারদাবার নিয়েও পাগলামো আছে সিলিকন ভ্যালিতে। বিশেষ করে পানি নিয়ে ‘জলঘোলা’ হয় প্রায়শই। এখানকার কিছু বাসিন্দা সাধারণ সুপেয় পানি পান করতে নারাজ। তাঁদের দরকার ঝরনার অপরিশোধিত পানি। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ওতে পেটের বারোটা বাজিয়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট ব্যাকটেরিয়াই থাকে। কে শোনে কার কথা! দুপুরের খাবার নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। এ বিষয়ে দুটি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে সিলিকন ভ্যালিতে—হিউয়েল এবং সয়লেন্ট। নিত্যদিনের দুপুরের খাবারের চেয়ে নাকি তাঁদের বোতলভর্তি খাবার ‘অধিক ক্রিয়াশীল’।

৭. যাতায়াত মানেই ইলেকট্রিক স্কুটার
আগেই জেনেছেন, বে এরিয়ার পুরোনো বাসিন্দারা সিলিকন ভ্যালির কর্মকাণ্ডে তিতিবিরক্ত। বে এরিয়াটি ছিল ভাবুক মানুষদের স্বর্গ। জীবন বিলাসবহুলই ছিল, আবার ভবঘুরে এক শিল্পীও সেখানে দিব্যি হাওয়া খেয়ে বেড়ানোর সুযোগ পেত। কিন্তু সিলিকন ভ্যালির যান্ত্রিক এবং কাঁচা টাকার জীবনযাপনের প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে। সবকিছুর দাম বেড়েছে, ভিড় বেড়েছে। শিল্পীজীবনে যা ভীষণ দুঃস্বপ্নের মতো। বিশেষ করে বে এরিয়ার রাস্তায় ইলেকট্রিক স্কুটারগুলো রীতিমতো উপদ্রব তাঁদের কাছে। বার্ড, লাইম এবং স্পিন নামের ভেঞ্চার ফান্ডেড প্রতিষ্ঠানগুলোই এর শুরু করেছিল। সিলিকন ভ্যালির লোকজনের প্রধান বাহন এখন এটাই।

সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার