ইন্টারনেটে নারীদের জন্য আয়ের প্রশিক্ষণ

গাজীপুরে ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ প্রকল্পে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন নারীরা। ছবি: সংগৃহীত।
গাজীপুরে ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ প্রকল্পে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন নারীরা। ছবি: সংগৃহীত।

ইন্টারনেট সুবিধা থাকলে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঘরে বসেও আয় করা যায়। বাংলাদেশের অনেক নারী এখন প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মহিলা সংস্থা ও কমজগৎ টেকনোলজিস মিলে নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও আয়ের জন্য বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। এ কর্মসূচির নাম ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’। দেশের ৬৪টি জেলায় এ কর্মসূচি পরিচালনা করে ২ হাজার ৩০৪ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায় এ কার্যক্রম।

দুই বছর মেয়াদি এ কার্যক্রম প্রসঙ্গে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মমতাজ বেগম বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে আমরা বহু পথ পাড়ি দিয়েছি। প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে ইন্টারনেট এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন দেশের তরুণ প্রজন্ম আয়-উপার্জন করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। উন্নয়নের অগ্রযাত্রার মহাসড়কে আমাদের মেয়েরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে, তাই বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় আমরা মেয়েদের কম্পিউটার শিখিয়েছি। যেসব মেয়ে কম্পিউটার শিখে কারিগরি সনদ গ্রহণ করেছে, তারা যাতে তাদের কম্পিউটার শেখাকে কাজে লাগিয়ে ঘরে বসেই ইন্টারনেট থেকে আয় করে স্বাবলম্বী হতে পারে, সে জন্য আমরা আমার ইন্টারনেট আমার আয় কর্মসূচি শুরু করি। কর্মসূচির আওতায় দেশের ৬৪টি জেলায় ২ হাজার ৩০৪ জন নারীকে ইন্টারনেট বিষয়ে দক্ষ করে তোলা হয়। একদল দক্ষ প্রশিক্ষক ভার্চ্যুয়াল এবং অফলাইন ক্লাসের মাধ্যমে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেন। মেয়েরা যাতে আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারে, সে জন্য চার মাসব্যাপী প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে সার্বক্ষণিক অনলাইন সেবা দেওয়া হয়।’

মমতাজ বেগম আরও বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকার নারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কেউ পড়ালেখা শেষ করে বেকার হয়ে আছেন, কেউ পড়ালেখা চলাকালে কাজের কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না, আবার কেউ সংসার ও সন্তান দেখভাল করতে গিয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করার বা আয় করার সুযোগ পাচ্ছেন না। এ পরিস্থিতিতে নারীদের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঘরে বসেই কাজ শিখে আয় করা সম্ভব। নারীকে ডিজিটালি সক্ষম করে গড়ে তোলার মাধ্যমে কার্যকর জনশক্তিতে পরিণত করার মাধ্যমে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করাও সম্ভব। ডিজিটাল বাংলাদেশ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিপুলসংখ্যক নারীদের তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে আরও বেশি মানানসই করে স্বাবলম্বী করে তুলতে দেশব্যাপী নারীদের ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং দেওয়ার কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন মেয়েরা স্বাবলম্বী হচ্ছে।

কমজগৎ টেকনোলজিসের তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে ফ্রিল্যান্সিং এখন অনেক জনপ্রিয় একটি পেশা। আউটসোর্সিং করে হাজারো তরুণ-তরুণী নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলছেন। কিন্তু বাংলাদেশের নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে। বৈশ্বিক এ পেশা থেকে নারীদের দূরত্ব কমাতেই বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় জাতীয় মহিলা সংস্থা প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগের ফলে নারীরা নতুন দিনের ডিজিটাল পেশাগুলো সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। নিজেরাই ঘরে বসে ফ্রিল্যান্সিং করে গ্লোবাল মার্কেটপ্লেসে প্রতিযোগিতা করছেন এবং এর মাধ্যমে আয় করার জন্য যোগ্য হয়ে উঠেছেন। কর্মসূচি বাস্তবায়নে জাতীয় মহিলা সংস্থার সঙ্গে সহযোগী ভূমিকা পালন করছে কমজগৎ টেকনোলজিস। কর্মসূচিতে ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন ডেটা এন্ট্রি, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিকস ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং ই-কমার্স বিজনেসের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর কর্মসূচিটি উদ্বোধন করা হয়। ৬ নভেম্বর থেকে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়। প্রথম ধাপে একসঙ্গে আটটি জেলায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল। এভাবে পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলায় এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অনলাইন-অফলাইন প্রশিক্ষণ এবং প্রজেক্ট সাপোর্টের পাশাপাশি এই কর্মসূচির অধীনে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী একটি করে ফ্রিল্যান্সিং গাইড বই এবং সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইনে ক্লাস করার জন্য ভাতা পেয়েছেন। এ ছাড়া এই কর্মসূচির আওতায় আন্তর্জাতিক মানের ফ্রিল্যান্সিং ওয়েবসাইটগুলোর মতো করে একটি ওয়েবসাইট (http://womenfreelancer.gov.bd/) তৈরি করা হয়েছে। ওয়েবসাইটটি মূলত ফ্রিল্যান্সিং জগতে শুধু বাংলাদেশি নারীদের জন্য মার্কেটপ্লেস হিসেবে কাজ করবে। এখানে কাজ দেওয়া এবং নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কর্মসূচি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সবার প্রোফাইল রয়েছে ওয়েবসাইটিতে।

প্রতিটি জেলায় মোট তিন ধাপে ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’-এর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রথম ধাপে প্রশিক্ষণার্থীরা ফেসবুকের মাধ্যমে অনলাইনে ২২টি লাইভ ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছেন। অনলাইন ক্লাস শেষে ট্রেইনাররা প্রতিটি জেলায় গিয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের ছয়টি মুখোমুখি (ফেস টু ফেস) ক্লাস নিয়েছেন। মুখোমুখি ক্লাসে মূলত অনলাইন ক্লাসের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর পরের চার মাস প্রশিক্ষণার্থীদের পছন্দ অনুযায়ী প্রজেক্ট দেওয়া হয়েছে। এই চার মাসের মধ্যে প্রশিক্ষণার্থীরা তাঁদের প্রজেক্ট সাবমিট করেছেন। প্রজেক্ট সম্পন্ন করার সময় তাঁরা যেকোনো সমস্যায় প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে নিয়মিত অনলাইন সাপোর্ট পেয়েছেন। যেসব প্রশিক্ষণার্থী মনোযোগসহকারে প্রতিটি প্রজেক্টের কাজ করেছেন এবং কাজ করতে গিয়ে সমস্যাগুলো প্রশিক্ষকদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন, তাঁরাই পরবর্তী সময়ে ফাইভার, আপওয়ার্ক কিংবা ফ্রিল্যান্সার ডটকমের মতো আন্তর্জাতিক মানের ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসগুলো থেকে কাজ করে অর্থ উপার্জন করার মতো দক্ষতা অর্জন করেছেন। ফেসবুকে প্রতিটি জেলার জন্য আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি করে সেই গ্রুপে লাইভ ক্লাসগুলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের কথা বিবেচনা করে ফেসবুক গ্রুপে এই ডিজিটাল ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে ভিডিওর নিচে কমেন্ট করেছেন এবং প্রশিক্ষকেরা কমেন্ট দেখে এর উত্তর দিয়েছেন। ভিডিও টিউটরিয়ালগুলো গ্রুপেই সেভ করে রাখা হয়েছে। তাই যখন-তখন ক্লাসের ভিডিওগুলোতে চোখ বুলিয়ে তাঁরা নিজের শেখাকে আরও ঝালাই করতে পেরেছেন। নির্দিষ্ট ফেসবুক চ্যাট গ্রুপে প্রশিক্ষণার্থীরা তাঁদের প্রজেক্ট ও কাজসংক্রান্ত আলোচনা করেছেন। এতে প্রতিটি জেলায় ফ্রিল্যান্সিং জানা নারীদের একটি কমিউনিটি তৈরি হয়েছে।

মমতাজ বেগম বলেন, ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের ফলে বহু মেয়ে এখন আর ঘরে বেকার বসে না থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আয় করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মেয়েরা যেন পিছিয়ে না থাকেন, বরং ডিজিটাল বাংলাদেশের এই যাত্রায় তাঁরা যেন অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন, সেটিই তাঁদের প্রত্যাশা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বেসিসের জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি পুরস্কার পেয়েছে তাঁদের কর্মসূচিটি। প্রকল্পটিতে ইতিমধ্যে আরও পাঁচ হাজার জনের মতো নারী আগ্রহ দেখিয়েছেন। প্রকল্পটি দ্বিতীয় পর্যায়ে বর্ধিত হবে বলে আশা করছেন তাঁরা।