সরকারি কাজে গতি আনতে 'সফটওয়্যার', খরচ ৩৪ কোটি টাকা

জিআরপি প্রকল্পে কাজ করছেন দেশের তরুণ ডেভেলপাররা। ছবি: সংগৃহীত
জিআরপি প্রকল্পে কাজ করছেন দেশের তরুণ ডেভেলপাররা। ছবি: সংগৃহীত

দেশে সরকারি কাজে গতি ও স্বচ্ছতা আনতে নতুন একটি সফটওয়্যার প্রকল্প নিয়ে কাজ চলছে। এটি বাস্তবায়ন হলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ, অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন জায়গায় সহজে অপারেশন ও কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা করা যাবে।

দেশীয় কয়েকটি সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জিআরপি নামের ওই সফটওয়্যার তৈরি করছে। সরকারি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রায় ৩৪ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরের কার্যক্রম সফটওয়্যারের মাধ্যমে সহজে করা যাবে। এতে সরকারি কাজে সময় বাঁচবে এবং সরকারি সম্পদের অপচয় কমবে। সফটওয়্যারটি যুগোপযোগী প্রযুক্তিতে তৈরি হওয়ায় এটি সময়ের সঙ্গে আরও উন্নত হবে।

ইআরপি মানে এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং। অর্থাৎ মূল ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ার সমন্বিত ব্যবস্থাপনার সফটওয়্যার। এই সফটওয়্যারে তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমের বিভিন্ন তথ্য একসঙ্গে ব্যবস্থাপনা করা যায়। সরকারি কার্যক্রমে ইআরপি যুক্ত করতে নতুন উদ্যোগকে তাই জিআরপি বা গর্ভনমেন্ট রিসোর্স প্ল্যানিং বলা হচ্ছে। সরকারি কার্যক্রমে জিআরপি ইআরপির একই সুবিধা দেবে বলে জানিয়েছেন এর নির্মাতারা।

এ সফটওয়্যারে মোট ৯টি মডিউল থাকছে। এগুলো হচ্ছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ইনভেন্টরি, প্রকিউরমেন্ট মানেজমেন্ট, বাজেটিং, অ্যাকাউন্টস, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, অডিট, প্রজেক্ট মনিটরিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সরকারি অফিসে যত বিভাগ আছে, সব ধরনের বিভাগের কাজ সফটওয়্যারে সম্পাদন করা যাবে। সরকারি কাজের ধরন ভিন্ন হওয়ায় প্রচলিত ইআরপিতে তা করা সম্ভব নয়। তাই জিআরপি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

জিআরপি প্রকল্প পরিচালক ডেপুটি সেক্রেটারি অশোক কুমার রায় বলেছেন, সরকারের কাজে স্বচ্ছতা আনতে ও গতিশীল করতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর বেশ কিছু মডিউল তৈরি হয়েছে, যা সরকারের বিভিন্ন কাজে লাগবে। সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আসবে। এ ছাড়া কোন বিষয়ে বাজেট তৈরি, প্রকল্পের উদ্বৃত্ত নানা বিষয় জানা থাকলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সহজ হবে। ইতিমধ্যে এ সফটওয়্যারের কয়েকটি মডিউল তৈরি করা হয়েছে। মডিউলগুলো প্রয়োগের কাজ চলছে।

প্রকল্প সম্পর্কে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীন প্রতিষ্ঠান বিসিসি বলছে, এর সফল বাস্তবায়ন হলে সরকারের অন্য দপ্তর সংস্থায় এই প্রকল্পের অধীনে তৈরিকৃত সফটওয়্যার ব্যবহার করা যাবে। প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়ন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

সফটওয়্যার তৈরির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, সরকারের সব ক্ষেত্রে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এটি শুরু হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সঠিক এবং সহজলভ্য প্ল্যাটফর্ম এবং স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করা এবং তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং পরিকল্পনা বিভাগের জন্য একটি ইআরপি সলিউশন তৈরি করা হবে এর মাধ্যমে। অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্থানীয় আইসিটি ইন্ডাস্ট্রির দক্ষতা বৃদ্ধি করাও এর অন্যতম লক্ষ্য।

সফটওয়্যার তৈরির সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, দেশীয় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা যাচাই ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিও সম্ভব হচ্ছে এ প্রকল্পের মাধ্যমে। মাইক্রো সার্ভিস আর্কিটেকচার নামের একধরনের প্রযুক্তি এতে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে বিবর্তিত হওয়ার সুযোগ করে দেবে। অর্থাৎ জিআরপি প্রকল্পের মাধ্যমে একদিকে দক্ষ জনবল তৈরি করা, দেশের স্থানীয় সফটওয়্যার খাতকে শক্তিশালী করার মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এটি যত ব্যবহার হবে তত বিবর্তিত হবে। ফলে ৫ বছরের মধ্যে সফটওয়্যারটি আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। নির্মাতারা দাবি করছেন, একই রকম পণ্যের ফরমাশ এখন দেশের বাইরে থেকেও আসতে শুরু করেছে। দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে জিআরপি বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে।

‘বাংলাদেশ ই-গভর্নমেন্ট ইআরপি (২য় সংশোধিত) প্রকল্প’ নামের এ প্রকল্প সম্পর্কে বিসিসির তথ্য অনুযায়ী, সরকারি সংস্থার অটোমেশনে বিচ্ছিন্ন কিছু সিস্টেম তৈরি হচ্ছে, যা বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বিনিময়ে বিশাল বাধা। সরকারের সব সংস্থার জন্য একটি একক সমাধান পদ্ধতি বিবেচনা করে ‘বাংলাদেশ ই-গভর্নমেন্ট ইআরপি’ তৈরির মাধ্যমে ই-গভর্নমেন্টের জন্য প্রতিষ্ঠিত অবকাঠামো ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। ওপেন সোর্স লাইসেন্স-ফ্রি সফটওয়্যার ব্যবহার করে বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি কাস্টমাইজড ইআরপি সেবা তৈরি হবে এতে। প্রকল্পের সময়কাল দেওয়া হয়েছে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পের ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩৪ কোটি ৫০ লাখ ৭ হাজার টাকা।

জিআরপি প্রকল্পে অংশীজন (স্টেকহোল্ডার) হিসেবে রয়েছে পরিকল্পনা বিভাগ (প্ল্যানিং ডিভিশন), তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি ডিভিশন), হাইটেক পার্ক, বিসিসি, এটুআই । এ খাতে স্পনসর মন্ত্রণালয় হিসেবে কাজ করছে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। কর্মপরিচালনাকারী সংস্থার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে রয়েছে বুয়েট।

জিআরপি উন্নয়ন ও বাস্তবায়নে কাজ করছে কোক্রিয়েটস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে, টেন্ডারের মাধ্যমে কাজটি পেয়েছিল সিনেসিস আইটি ও বিডিই কম জেভি। কোক্রিয়েটসে প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করছেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ২০১৫-১৬ সালের দিকে সরকারি পর্যায়ে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়, যাতে নিজেদের একটি দরকারি সফটওয়্যার তৈরির কথা বলা হয়। এতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ, অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন জায়গায় সহজে অপারেশন ও কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা করা যাবে।

কোক্রিয়েটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকা জাহিদুল হাসান বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে দুধরনের সুবিধা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের তরুণেরা এখান থেকে সুবিধা পাবেন। তাঁদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বাড়ানোর সুযোগের পাশাপাশি সরকারি অফিসগুলোতে শৃঙ্খলা ও আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা আসবে। এর বাইরে বিদেশেও সম্ভাবনা তৈরি হবে।

জিআরপি বাস্তবায়নে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে আবার বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনাও রয়েছে। নাম প্রকাশ না করে দুজন বুয়েটের প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেছেন, যাঁরা এ সফটওয়্যার তৈরিতে কাজ করছেন, তাঁদের কারও জিআরপি বাস্তবায়নের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। ফলে এ প্রকল্পে ব্যর্থতার ঝুঁকি রয়েছে। সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে এতগুলো টাকা নষ্টের অর্থ হয় না। বরং বিশেষজ্ঞ ও ইআরপি দক্ষ প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

জাহিদুল হাসান অবশ্য বলেছেন, তাঁদের কনসোর্টিয়ামে মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া এ প্রকল্পে বুয়েট পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। অন্য অংশীজনও রয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক অশোক কুমার বলেন, এখন পর্যন্ত চারটি মডিউল ডেভেলপমেন্ট হয়ে গেছে। এ গুলো ইতিমধ্যে প্রয়োগ করা হয়েছে। জানুয়ারির শুরু থেকেই শুরু হচ্ছে বাকি ৫টি মডিউলের কাজ। ডেভেলপমেন্টের কাজও চলছে আবার পাশাপাশি ইমপ্লিমেন্টের (বাস্তবায়ন) কাজও হবে। এ কাজের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন মেধাবী তরুণ যুক্ত হয়েছেন। ফলে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি সম্ভব হচ্ছে।