কোভিড-১৯ গবেষণা ও অ্যালকোহল: জনমনে আশার আলো না বিভ্রান্তি?

সংগীতা আহমেদ
সংগীতা আহমেদ

কোভিড-১৯-এর আগ্রাসী আক্রমণে আজ পুরো পৃথিবী পর্যুদস্ত। এই বহুরূপী ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিভিন্ন দেশে চলছে গবেষণা, কেউ কাজ করছেন দ্রুততম সময়ে এই ভাইরাস শনাক্ত করার পদ্ধতি আবিষ্কারের, কেউবা নিবেদিত আছেন একটি কার্যকর ওষুধ অথবা প্রতিষেধক উদ্ভাবনের সন্ধানে। সমগ্র পৃথিবী আজ এক বুক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে বিজ্ঞানীদের দিকে, একটা কিছু ভালো খবরের আশায়। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও কাজ করে চলেছেন একই লক্ষ্যে। কিন্তু হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, আমাদের দেশের অনেক বিজ্ঞানীই এখন পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি এই রকম তথ্য নিয়ে হাজির হচ্ছেন পাবলিক মিডিয়াতে, বিভ্রান্ত করছেন দেশের সহজ-সরল মানুষকে।

৮ এপ্রিল কয়েকটি টিভি চ্যানেলে বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী অধ্যাপক আলিমুল ইসলাম বলেছেন, ঘরে বসেই ইথানলমিশ্রিত বাষ্প নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে (সহজ বাংলায় যাকে ভাপ নেওয়া বলা হয়) অথবা ইথানলমিশ্রিত পানি দিয়ে কুলকুচি করলে কোভিড-১৯ ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হতে পারে। ইথানল ও পানির মিশ্রণের পরিমাণ, কীভাবে তার প্রয়োগ করতে হবে, সে বিষয়েও টিভি চ্যানেলে তিনি তাঁর মতামত দিয়েছেন। তিনি এই গবেষণায় জাপানের একজন পদার্থবিজ্ঞানী Tsumoru Shintake-এর অনুরূপ গবেষণাকাজের কথা উল্লেখ করেছেন।

যেহেতু কোভিড-১৯ ভাইরাসের একটি লিপিড আবরণ আছে, তাই লিপিড বা চর্বি নষ্ট করে এ রকম কিছু দিয়ে একে ধ্বংস করা সম্ভব, এই তথ্য এখন মোটামুটি আমাদের সবারই জানা। যে জন্য চর্বি নষ্ট করে ফেলে এই জাতীয় কিছু, যেমন সাবান অথবা ইথানলধারী দ্রব্য দিয়ে আমাদের হাত ধুতে বলা হচ্ছে। এই একই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই Tsumoru Shintake ও অধ্যাপক আলিমুল ইসলাম প্রস্তাব করেছেন, ইথানলমিশ্রিত ভাপ নিলে হয়তো কোভিড-১৯ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, যদিও তাঁদের কেউই এই কাজে কোভিড-১৯ নিয়ে সরাসরি কোনো গবেষণা করেননি। Tsumoru Shintake যদিও পরিষ্কারভাবে তাঁর গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, এই ধরনের কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি রোগীর ওপর প্রয়োগ করার আগে অনেক বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা দরকার এবং এটি একটি সম্ভাবনা মাত্র।

অন্যদিকে যদি অধ্যাপক আলিমুল ইসলামের গবেষণার দিকে দৃষ্টি দিই, এই গবেষণাকাজ এখনো কোনো peer reviewed journal-এ প্রকাশ হয়নি। অথচ তিনি পাবলিক মিডিয়াতে এসে রোগীকে ইথানলের ভাপ নেওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁর বক্তব্যে এই গবেষণার অনেক দিক সম্মানিত বিজ্ঞানী পরিষ্কার করেননি। তাঁর গবেষণার প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টিপাত করতে চাই।

অধ্যাপক আলিমুল ইসলাম নিজে এবং তাঁর কয়েকজন ছাত্র ইথানলমিশ্রিত বাষ্প নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, এর ফলে তাঁদের ঠান্ডা, কাশি ও শ্বাসকষ্টের উপসর্গ কমে গেছে। তিনি ধারণা করেছেন, তাঁদের কোভিড-১৯-এর কাছাকাছি কোনো গোত্রের বা অন্য কোনো ভাইরাসজনিত ঠান্ডা কাশি এবং শ্বাসকষ্ট হয়তো ছিল এবং যেহেতু ইথানলমিশ্রিত বাষ্প গ্রহণ করায় তাঁদের উপসর্গ কমে গিয়েছে, সুতরাং কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ থেকেও একই পদ্ধতিতে সুস্থ হওয়া হয়তো সম্ভব। কিন্তু তাঁদের উপসর্গের জন্য কোনো ভাইরাস দায়ী ছিল কি না, হলেও সেটি কোন ভাইরাস, সেটি শনাক্ত হয়েছিল কি না, সেই বিষয়ে কোনো তথ্য তিনি দেননি। সুতরাং আদৌ কোভিড-১৯ ইথানলমিশ্রিত বাষ্প দ্বারা ধ্বংস হয় কি না, সে ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। পুরো বিষয়টি তাঁর ধারণার ওপর ভিত্তি করা। আরও মারাত্মক বিষয় হলো, নিজের ও ছাত্রদের ওপর অ্যালকোহলের মতো একটি ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগের পূর্বে তিনি Ethical clearance নিয়েছিলেন কি না, তারও কোনো উল্লেখ তিনি করেননি।

কোভিড-১৯-এর যেই লিপিড আবরণ, তা সে নিজে তৈরি করে না, বরং মানব কোষে যেই লিপিড থাকে, তাকেই এই ভাইরাস নিজের আবরণ হিসেবে ব্যবহার করে। কাজেই ইথানল যদি ভাইরাসের লিপিড ধ্বংস করে, পাশাপাশি মানব কোষে থাকা লিপিডকেও সে ধ্বংস করতে পারবে। লিপিডের পাশাপাশি ইথানল প্রোটিনকেও ধ্বংস করে, যা আমাদের শ্বাসতন্ত্র এবং ফুসফুসের ক্ষতি করতে পারে। কতটুকু পরিমাণ ইথানল ব্যবহার করলে মানবদেহের ক্ষতি হবে না কিন্তু ভাইরাস ধ্বংস হবে, সেটি এই চিকিৎসা পদ্ধতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বয়স বা শারীরিক অবস্থা ভেদে অ্যালকোহলের ব্যবহার কীভাবে মানবদেহে প্রভাব ফেলতে পারে বা তার পরিমাণ কতটুকু হবে, তার ওপর আরও ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। এই বিষয়ে Tsumoru Shintakeও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই ধরনের যেকোনো নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি সুপারিশ করার আগে ব্যাপক আকারে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অত্যাবশ্যক। গুটিকয়েক ব্যক্তির ওপর পরীক্ষা করে যেকোনো চিকিৎসাপদ্ধতি সুপারিশ করা কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকেই সম্ভব নয়।

অ্যালকোহলের ব্যবহার যে আমাদের শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুসের ক্ষতি করতে পারে, অধ্যাপক আলিমুল ইসলামের বক্তব্যেও তার ইঙ্গিত আছে। তিনি বলেছেন, যাদের শ্বাসতন্ত্রের কোনো সমস্যা আছে, তাদের জন্য এই চিকিৎসাপদ্ধতি সুপারিশ করা যাবে না। আমরা জানি, কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ শ্বাসতন্ত্রেরই রোগ। সে ক্ষেত্রে কীভাবে শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত একজন রোগীকে ইথানলমিশ্রিত বাষ্প দিয়ে চিকিৎসা করা যাবে, সেই বিষয়ে অধ্যাপক আলিমুল ইসলামের বক্তব্যটি স্ববিরোধী।

অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, ইথানলমিশ্রিত তরল দিয়ে হাত যদি ধোয়া যায়, তাহলে ইথানল কেন ভাপ হিসেবে নেওয়া যাবে না? মনে রাখতে হবে, আমাদের শরীরের সব জায়গার কোষের গঠন এক নয়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ইথানলের ব্যবহার ত্বকের ওপরে সে রকম কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলে না। কিন্তু শ্বাসনালি, পরিপাকতন্ত্র প্রভৃতির মিউকোসাল স্তরের নানা রকম ক্ষতি করে। উপরন্তু, শ্বাস গ্রহণের সঙ্গে ইথানল গ্রহণের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ইথানল পানের থেকেও বহুমাত্রায় ক্ষতিকর। কারণ ফুসফুসের পাশাপাশি ওই ইথানল দ্রুত মস্তিষ্কে পৌঁছে মস্তিষ্কেরও ক্ষতি করতে পারে।

ইতিমধ্যেই এই ধরনের বিভ্রান্তকর তথ্যের কারণে ইরানে বহু মানুষ ভাইরাস ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে অ্যালকোহল সেবন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ভারতে গো-মূত্র পান করে অসুস্থ হয়েছেন বহু মানুষ। বাংলাদেশেও ইতিমধ্যেই কোভিড-১৯ ভাইরাস আক্রমণের আতঙ্কে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে আছেন এবং সংক্রমণের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে এই আতঙ্ক আর হতাশা আরও বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

কাজেই, এই পরিস্থিতিতে মানুষ যখন যেকোনো আশার বাণীকেই খড়কুটোর মতোন আঁকড়ে ধরে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছেন, তখন এই ধরনের একটি বিভ্রান্তকর তথ্য প্রচার মাধ্যমে প্রচার হলে তার ফল যে খুব ভালো হবে না, তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়। বিশেষ করে যেখানে অ্যালকোহলের মতো একটি দাহ্য ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে, যার যথেচ্ছ ব্যবহার ডেকে নিয়ে আসতে পারে ভয়াবহ পরিণতি। শুনছি অনেকেই বাজারে ইথানল কোথায় পাওয়া যাবে, সেই খোঁজও নিচ্ছেন।

পরিশেষে এটাই বলতে চাই, একজন বিজ্ঞানীর অনেক দায়িত্ব। কোনো বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে, কোনো peer reviewed journal-এ প্রকাশ না করে গণমাধ্যমে কোনো কিছু প্রচার না করাই কাম্য। মানবসভ্যতার উপকারে আমরা নিজেদের সঠিকভাবে নিয়োজিত করি, আমাদের একটি ভুল যেন একজন মানুষেরও প্রাণহানির বা ক্ষতির কারণ না হয়। আমাদের দেশের প্রচার মাধ্যমে এই ব্যাপারে আরও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। বিজ্ঞানভিত্তিক যেকোনো তথ্য প্রচার করার আগে, তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যাচাই করে নেওয়া খুবই জরুরি। তা না হলে আমরা মানুষের মঙ্গল না করে বিপদই বয়ে আনব।

ড. সংগীতা আহমেদ: অধ্যাপক, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তথ্যসূত্র:
১। Tsumoru Shintake. 2020. Possibility of Disinfection of SARS-CoV-2 (কোভিড-১৯) in Human Respiratory Tract by Controlled Ethanol Vapor Inhalation (এখনো প্রকাশিত হয়নি, প্রি–প্রিন্ট হিসেবে Research Gate-এ পাওয়া যাচ্ছে)
২। Feng L, Wang L. Effects of alcohol on the morphological and structural changes in oral mucosa. Pak J Med Sci. 2013;29(4):1046-1049. doi:10.12669/pjms.294.3696
৩। Lachenmeier DW. Safety evaluation of topical applications of ethanol on the skin and inside the oral cavity. J Occup Med Toxicol. 2008;3:26. Published 2008 Nov 13. doi:10.1186/1745-6673-3-26
৪। https://www.nytimes.com/aponline/2020/03/27/
৫। https://www.theweek.in/news/india/2020/03/18/