মাস্ক পরব - সার্জিক্যাল না কাপড়ের

সম্প্রতি আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা দল বলেছে, লকডাউন ও অন্যান্য সতর্কতার পাশাপাশি জরুরি কাজে বাইরে চলাফেরার সময় সবাই মাস্ক ব্যবহার করলে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দুটোই ১০ শতাংশ হারে কমে। তাদের হিসাবে, প্রতিটি মাস্ক ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে আক্রান্ত বা মৃত্যু যতটা কমে, তার আর্থিক উপকারিতা ৩ হাজার থেকে ৬ হাজার ডলারের সমান। এটা কিন্তু বিরাট ব্যাপার।

ওই গবেষক দল দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশ, যেখানে সবাই মাস্ক ব্যবহারে অভ্যস্ত, তার সঙ্গে ইতালির মতো দেশে করোনার বিস্তার ও মৃত্যুহারের তুলনা করে এই ফলাফল বের করেছে। আমেরিকা বা ইউরোপের অনেক দেশের মানুষ সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে অভ্যস্ত হলেও সহজে মাস্ক ব্যবহার করতে চায় না।

আমাদের দেশেও বাইরে সব সময় মাস্ক ব্যবহারে অনীহা দেখা যায়। অন্য নিয়মগুলো কমবেশি মানি। যদিও সুযোগ পেলেই জনসমাগম ঘটাই। এমনকি এই করোনার ক্রমবর্ধমান আক্রমণের মধ্যেই কেউ কেউ ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ের আয়োজন করেছে, এমন খবরও পেয়েছি। তবে এখন কিছুটা অভ্যাস হয়েছে। আমরা যখন বাইরে বেরোই, তখন জনসমাগম এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কেনাকাটার সময় ক্রেতারা তিন-চার ফুট দূরত্ব রেখে দাঁড়াই। কিন্তু মুখে সব সময় মাস্ক ব্যবহারের অভ্যাসটা এখনো সবার হয়নি। অনেকে পরতেই চান না। এটা যে কত ক্ষতি করে, সেটা আমরা অনেকেই ভেবে দেখি না।

আমরা দেখছি প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। নতুন এলাকায় লকডাউন হচ্ছে। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। দিনের বেলায়ও জরুরি কাজ ছাড়া কারও বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ সবই করোনাভাইরাস যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে এবং করোনায় মৃত্যুহার যেন কমে, সে জন্যই করা হচ্ছে।

সেই সঙ্গে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক, এটাও বলা হচ্ছে। কিন্তু এই শর্তটা যেন একটু দুর্বলভাবে বলা হচ্ছে। ফলে অনেকে ভাবছে রাস্তাঘাটে লোকজন নেই, মাস্ক না পরলেও চলে। এটা ভুল ধারণা।

শুধু নিজেকে রক্ষার জন্য নয়, অন্য ১০ জনকে করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্যও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক হতে হবে। কারণ, অনেক সময় আমরা হয়তো জানিও না কার ভেতর কখন করোনাভাইরাস ঢুকে গেছে। টের পাই দু–তিন দিন পর। এর মধ্যে কিন্তু আমরা কথা বলার সময় বা হাঁচি-কাশির সময় ড্রপলেটের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে চলেছি। এটা বন্ধ হবে যদি আমরা ঘরের বাইরে জরুরি কাজে বের হওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করি।

এখানে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কারও হয়তো থাকতে পারে। কারণ, মাস্ক তো অনেক রকম। সাধারণ দু-তিন পরত সুতি কাপড়ের তৈরি মাস্কও আছে, আবার আছে সার্জিক্যাল মাস্ক, যেমন এন৯৫ মাস্ক। কোনটা ব্যবহার করব। যেহেতু সার্জিক্যাল মাস্ক সাধারণত হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সরা ব্যবহার করেন, তাই এটা খোলা বাজারে খুব কম পাওয়া যায়। সব মানুষ সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করতে চাইলে ডাক্তারদের মাস্কে টান পড়বে।

ইতিমধ্যে আমেরিকায়ও হাসপাতালে সার্জিক্যাল মাস্কের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশে তো বটেই। আসলে সার্জিক্যাল মাস্ক ডাক্তার-নার্সদের দরকার, কারণ এতে রোগীর চিকিৎসার সময় ডাক্তারের নিরাপত্তা শুধু নয়, রোগীরও নিরাপত্তার জন্যও বিশেষ দরকার। তাই চিকিৎসকদের চাহিদা অবশ্যই মেটাতে হবে। না হলে চিকিৎসায় রোগী-চিকিৎসক উভয়েরই বিপদের আশঙ্কা থাকবে।

এ অবস্থায় যেহেতু অনেকে মনে করেন, সার্জিক্যাল মাস্ক ছাড়া কাজ হবে না, তাই তাঁদের অনেকে মাস্কই ব্যবহার করতে চান না।

এই বিষয়ে সম্প্রতি আমেরিকার সিডিসি (সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) থেকে পরিষ্কার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সাধারণ নাগরিকেরা যেন কাপড়ের তৈরি মাস্ক ব্যবহার করে (সূত্র: ওয়েব এমডি, ডু ক্লথ ফেইস মাস্ক অ্যাকচুয়েলি ওয়ার্ক?, ১০ এপ্রিল ২০২০)। এতেই অনেক উপকার। কারণ, বাইরে থেকে বাসায় ফিরে সেই মাস্ক আমরা সাবান দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে আবার ব্যবহার করতে পারি। তাই সবার জন্য এটা সহজলভ্য। এমনকি বাসায় পরিষ্কার কাপড়ের দু-তিন পরত সেলাই করে আমরা নিজেরাও কাপড়ের মাস্ক বানিয়ে ব্যবহার করতে পারি।

মূল কথা হলো আসুন কিছুদিন ঘরে থাকি। শুধু জরুরি কাজে বাইরে যদি যেতেই হয়, কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করি। এতে করোনার আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর হার অন্তত ১০ শতাংশ কমানো যাবে।

এটা কথার কথা নয়, বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় এই ফলাফল পাওয়া গেছে।

আব্দুল কাইয়ম, মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
[email protected]