করোনাভাইরাস সংক্রমণে দায়ী কোন জিন

করোনার গতিপ্রকৃতি বুঝতে জিন গবেষণা চলছে। ছবি: রয়টার্স
করোনার গতিপ্রকৃতি বুঝতে জিন গবেষণা চলছে। ছবি: রয়টার্স

দুজনই করোনায় সংক্রমিত। একজনের শরীরে উপসর্গ নেই, অন্যজনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অনেককে কৃত্রিমভাবে শ্বাস দিতে হচ্ছে। ভর্তি হওয়া লোকজনের একটা বড় অংশ কৃত্রিম শ্বাস ছাড়াই সুস্থ হচ্ছেন। রোগীভেদে করোনার উপসর্গের কিছু তারতম্য দেখা যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। আবার একই ধরনের চিকিৎসায় রোগীরা ভিন্নভাবে সাড়া দিচ্ছেন। ভাইরাসের সংস্পর্শে এসে অনেকে সংক্রমিত হচ্ছেন, অনেকে হচ্ছেন না। অন্য অনেক রোগের মতো আমাদের জিনবৈচিত্র্য এর পেছনে কিছুটা প্রভাব ফেলছে। সারা বিশ্বের জিনবিজ্ঞানীরা এর কারণ খুঁজতে শুরু করেছেন।

আমাদের শরীরে ২৫ হাজারের মতো জিন রয়েছে। এর মধ্যে এক বা একাধিক জিনের তারতম্য করোনার ভিন্ন মাত্রার বা ভিন্ন ধরনের উপসর্গের পেছনে একটা ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য প্রমাণের জন্য দরকার বড় ধরনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা এমন একটি গবেষণার কথা ঘোষণা করেছেন এ সপ্তাহে। করোনায় সংক্রমিত ৩৫ হাজার মানুষের জিনের গঠন পরীক্ষা করা হবে। এসব মানুষের মধ্যে ২০ হাজার মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হয়েছিলেন এবং ইনটেনসিভ কেয়ারে তাঁদের নিতে হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজারের সামান্য উপসর্গ ছিল। এ গবেষণার জন্য ২ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ড বরাদ্দ দেওয়া হয়।

সংক্রমিত রোগীদের জিনবৈচিত্র্য নিয়ে কয়েকটি গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। বলে রাখা ভালো, এসব ফলাফল এখনো প্রতিষ্ঠিত গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। এমন একটি গবেষণা হয়েছে লন্ডনের কিংস কলেজে। ২ হাজার ৬০০ যমজ ব্যক্তি গবেষণায় অংশ নেন। এই যমজেরা দুই ধরনের। একদল যমজের মধ্যে জিন সাদৃশ্য শতভাগ। অন্যদলের ৫০ শতাংশ । দেখা গেছে, শতভাগ জিন সাদৃশ্য আছে এমন যমজদের করোনার সংক্রমণের উপসর্গগুলো একই ধরনের। গবেষকদের এই দলটি বলছে, উপসর্গের ভিন্নতার জন্য জিন হয়তোবা ৫০ শতাংশ দায়ী।

কোন জিন দায়ী হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে কিছুদিন। মার্কিন গবেষকদের ধারণা, অন্তত দুটি জিনের ভূমিকা থাকতে পারে। আমাদের শরীরের কিছু জিন গোয়েন্দাদের মতো কাজ করে। এইচএলএ হলো এ রকম একটি জিন।

জীবাণু শরীরে ঢুকলে তাকে শনাক্ত করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন হয় এক ধরনের প্রোটিন। এইচএলএ জিন আমাদের শরীর কীভাবে জীবাণু শনাক্ত করার প্রোটিন তৈরি করবে, তার নির্দেশনা দেয়। মানব শরীরে এ জিনের ভিন্নতা অতীতে সারস ভাইরাসের উপসর্গের মাত্রার ভিন্নতার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে ধারণা করা হয়।

সন্দেহ রয়েছে আরেকটি জিনের দিকেও। টিএমপিআরএসএস২ নামের এ জিনটি এক ধরনের প্রোটিন তৈরি করে। করোনাভাইরাস এই প্রোটিনের সঙ্গে সখ্য তৈরি করে আমাদের শরীরে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে। যদি প্রমাণ করা যায় যেসব মানুষের শরীরে এই প্রোটিন কম তৈরি হয়, তাদের উপসর্গের মাত্রাও কম, তাহলে নতুন ওষুধ তৈরি করার পথ সহজ হবে।

এসিই২ জিনেরও প্রভাব আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট জিনের সঙ্গে রোগের সংক্রমণ এবং উপসর্গের সম্পর্ক নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা এর আগে অনেকবার ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যেমন ধরুন হেপাটাইটিস সির সংক্রমণ। আইএল২৮বি নামের জিনের ভূমিকা কোনো বিজ্ঞানীর ধারণার বাইরে ছিল। এ জন্য এবারের গবেষণাগুলোতে সব জিনকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

রোগের বিস্তার প্রতিরোধ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য জিন গবেষণা অত্যন্ত জরুরি। মানবদেহে রোগের সংক্রমণ এবং উপসর্গ কে প্রভাবিত করে, এমন জিন এবং তার বৈচিত্র্যের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রত্যেক রোগীর জন্য টেস্টের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ফলাফলের ভিত্তিতে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। ধরা যাক, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে এমন জিনের উপস্থিতি রয়েছে, যা উপসর্গগুলোকে ভবিষ্যতে আরও জটিল করে তুলতে পারে। এ ধরনের লোকজনকে নিয়মিত নজরদারির মধ্যে আনা সম্ভব।

নতুন ওষুধ আবিষ্কারের জন্য এই জিন গবেষণা জরুরি। রোগের প্রভাব বিস্তারকারী জিনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন ওষুধ তৈরির প্রযুক্তি মানুষের রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, মানবদেহের রোগের সঙ্গে জিনবৈচিত্র্য বা তারতম্যের সম্পর্ক সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া। অধিকাংশ জিন গবেষণা সম্পর্কে নিশ্চিত করতে পারে না। প্রচুর সংখ্যার রোগী গবেষণার জন্য না পাওয়াটা একটা বড় কারণ। যুক্তরাজ্যে প্রচুর সংক্রমণের কারণে প্রয়োজনীয়সংখ্যক রোগীকে এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অপেক্ষাটা সময়ের। সেই পর্যন্ত ভালো থাকবেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মানবেন। 

সুব্রত বোস: প্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়ালস অ্যানালিটিকসের গ্লোবাল প্রধান।
subratabose01@yahoo.com
লেখকের আরও লেখা
করোনার ভ্যাকসিন যেভাবে তৈরি হচ্ছে
করোনা ভ্যাকসিন: গবেষণার পাশাপাশি উৎপাদন নিয়েও ভাবাটা জরুরি
করোনার ওষুধ তৈরিতে কোমর বেঁধে নেমেছে কোম্পানিগুলো
করোনার ভ্যাকসিন তৈরির প্রযুক্তি মানুষের আয়ত্তে, সময়ের অপেক্ষা মাত্র