টিকা নিয়ে কাড়াকাড়ি

করোনাভাইরাসের টিকা অনুমোদন দিয়েছে রাশিয়া। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসের টিকা অনুমোদন দিয়েছে রাশিয়া। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বজুড়ে পরীক্ষাধীন কোনো টিকা এখন পর্যন্ত ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় কার্যকারিতা দেখাতে না পারলেও এর আগাম ফরমাশ ৫৭০ কোটি ডোজ পার হয়ে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর পরীক্ষাগারে থাকা কোভিড-১৯–এর টিকার প্রথম চালানের সব কটি ডোজই নিজেদের ঘরে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

বার্তা সংস্থা এএফপির তথ্য অনুযায়ী, তিনটি পশ্চিমা ও দুটি চীনা টিকা নিয়ে ইতিমধ্যে কার্যকারিতা পরীক্ষা তৃতীয় ধাপে হাজারো মানুষের ওপর পরীক্ষা চলছে। এরই মধ্যে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গতকাল মঙ্গলবার তাঁর দেশের হয়ে করোনাভাইরাসের টিকার অনুমোদন দেওয়ার কথা জানালেন। এর নামকরণ করা হয়েছে সোভিয়েত কৃত্রিম উপগ্রহের নামে। রাশিয়ায় অনুমোদন পাওয়া করোনার টিকাটির নাম ‘স্পুটনিক-৫’।

রুশ কর্মকর্তারা বলেছেন, টিকাটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এটি মানবদেহে প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে পেরেছে। টিকাটি উদ্ভাবন করেছে রুশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান গামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সহযোগিতা করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পরীক্ষাগারে টিকা তৈরির জোর প্রচেষ্টা চলছে। কে সবার আগে টিকা বাজারে আনতে পারবে, তার প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে গেছে। টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ সাহায্য করছে বিভিন্ন দেশের সরকার। সবার লক্ষ্য, আগামী বছরের শুরুতে বা এ বছর শেষ হওয়ার আগেই টিকা হাতে থাকতে হবে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সুইডিশ-ব্রিটিশ ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপ অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে মিলে একটি টিকা তৈরিতে কাজ করছে। তারা আগামী সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ টিকার ফলাফল জানার আশা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রতিষ্ঠান মডার্না ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথের (এনআইএইচ) সঙ্গে যৌথভাবে যে টিকা তৈরি করছে, তা এ বছরের মধ্যেই বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করছে। তাদের টিকা আনার সম্ভাব্য সময় আগামী নভেম্বর মাস।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্রুত টিকা আনার জন্য ‘অপারেশন র‌্যাপ স্পিড’ নামে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এর আওতায় সব মার্কিন নাগরিকের জন্য কোভিড-১৯–এর টিকা উৎপাদন ও বিতরণকাজ আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

দ্রুত টিকা পেতে কয়েক শ কোটি মার্কিন ডলার টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে খরচ করছে দেশটি। এর মধ্যে জনসন অ্যান্ড জনসন আগামী মার্চ মাসের মধ্যে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার পাচ্ছে। অন্য দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। তারা আশা করছে, শিগগিরই হয়তো করোনাভাইরাসের টিকা আনা সম্ভব হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই করোনার টিকা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকতে পারে বলে আশ্বস্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ৩ নভেম্বরের আগেই টিকা হাতে থাকা সম্ভব। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, করোনার টিকা আসার সময় নিয়ে হোয়াইট হাউসের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যে পূর্বাভাস দিয়েছেন, ট্রাম্প এর চেয়েও বেশি আশার কথা শুনিয়েছেন।

ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ৯৪০ কোটি মার্কিন ডলার সাতটি টিকা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৭০ কোটি ডোজ টিকা পেতে চুক্তিও করা হয়ে গেছে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে জনসন অ্যান্ড জনসন, মডার্না, অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা, নোভাভ্যক্স, ফাইজার ও বায়োএনটেক, সানোফি ও জিএসকে, মের্ক শার্প ও ডোম।

শিগগিরই টিকা পরীক্ষা শেষ করবে অক্সফোর্ড। ছবি: রয়টার্স
শিগগিরই টিকা পরীক্ষা শেষ করবে অক্সফোর্ড। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের মতো টিকা পেতে মরিয়া ইউরোপ। তারাও বিনিয়োগে পিছিয়ে নেই। টিকা প্রস্তুতকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও সানোফি-জিএসকের সঙ্গে চুক্তি সই করার পাশাপাশি আগাম আলোচনা করে রেখেছে ইউরোপিয়ান কমিশন। তারা ৭০ কোটি ডোজ টিকা আগে পেতে চায়।

ব্রেক্সিটের কারণে আলাদা থাকা ব্রিটেন আলাদা করে ২৫ কোটি ডোজের জন্য চারটি টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে আগাম ফরমাশ দিয়ে রেখেছে।

জাপানের পক্ষ থেকে ৪৯ কোটি ডোজ টিকা পেতে তিনটি টিকা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নোভাভ্যাক্সের কাছে ২৫ কোটি ডোজ টিকার ফরমাশ দিয়েছে দেশটি। জাপানের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি তেকদা জাপানের জন্য টিকা তৈরিকে নোভাভ্যাক্সের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে টিকা তৈরি করবে। ব্রাজিলেও জাপানের মতো মডেল গ্রহণ করা হয়েছে। তারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছ থেকে ১০ কোটি ডোজ টিকা নিচ্ছে। এ ছাড়া চীনের সিনোভ্যাকের কাছ থেকে ১২ কোটি ডোজ টিকা তৈরির সহযোগী হচ্ছে। সিনোভ্যাকের টিকাটি ব্রাজিলে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চলছে।

চীনা টিকা প্রস্তুতকারক সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের দুটি টিকার ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চলছে। তবে তারা মাত্র কয়েকটি আন্তর্জাতিক অংশীদারের নাম ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে একটি ব্রাজিল ও অন্যটি ইন্দোনেশিয়া।

রাশিয়া ঘোষণা করেছে, ২০টি দেশ তাদের তৈরি ‘স্পুটনিক-৫’ টিকাটি পেতে ১০০ কোটি ডোজের আগাম ফরমাশ দিয়েছে। বিদেশি সহযোগীদের নিয়ে এক বছরে তারা পাঁচটি দেশে ৫০ কোটি ডোজ টিকা তৈরি করতে সক্ষম হবে।

২০১৭ সালে নরওয়ে গৃহীত কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (সিইপিআই), ভারত, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও ওয়েলকাম ট্রাস্ট মিলে ভবিষ্যৎ টিকার সমবণ্টন নিশ্চিত করার জন্য কাজ করা হচ্ছে। দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের সঙ্গে যৌথভাবে তারা বিশ্বের কয়েক ডজন উন্নয়নশীল দেশের জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছে ৩০ কোটি ডোজ টিকার আগাম ফরমাশ দিয়েছে।

বিশ্বের বৃহত্তম টিকা প্রস্তুতকারক ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও অন্যান্য দেশের জন্য কয়েক শ কোটি ডোজ টিকা তৈরি করবে। নোভাভ্যাক্স ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে পৃথকভাবে স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর জন্য টিকা ছাড়তে শর্ত সাপেক্ষে পৃথক চুক্তি করেছে। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় টিকাগুলো কার্যকর প্রমাণিত হলেই তবে তা বাজারে ছাড়া হবে।

রাশিয়ার টিকার অনুমোদন
রাশিয়ায় করোনার টিকা অনুমোদনের খবরে বিশ্বজুড়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গতকাল মঙ্গলবার বলেন, তাঁর এক মেয়ের শরীরে এরই মধ্যে টিকাটি প্রয়োগ করা হয়েছে। পুতিন বলেন, ‘আজ (গতকাল) সকালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো নতুন করোনার একটি টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমি জানি, এটি অত্যন্ত কার্যকর। এটি টেকসই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সক্ষম।’ মেয়ে টিকাটি গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে পুতিন বলেন, ‘সে টিকার পরীক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। টিকাটির দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের পর তার হালকা জ্বর এসেছিল। (পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বলতে) এটুকুই।’

রাশিয়ার বিনিয়োগ তহবিল রাশিয়ান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (আরডিআইএফ) টিকা উদ্ভাবন কার্যক্রমে অর্থায়ন ও সমন্বয় করেছে। এই সংস্থার প্রধান কিরিল দিমিত্রিয়েভ গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, টিকাটির তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা আজ বুধবার শুরু হবে। এই ধাপে বড় সংখ্যায় স্বেচ্ছাসেবীরা অংশ নেবেন। তিনি আরও বলেন, টিকার ব্যাপক উৎপাদন শুরু হবে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে। ২০টি দেশ এরই মধ্যে ১০ কোটি ডোজের বেশি টিকা সরবরাহের প্রাথমিক ‘আবেদন’ দিয়ে রেখেছে।

এ বছরের শেষ নাগাদ টিকা ছাড়তে পারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ছবি: রয়টার্স
এ বছরের শেষ নাগাদ টিকা ছাড়তে পারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ছবি: রয়টার্স

তবে রাশিয়ার অনুমোদিত করোনার এই টিকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। অন্যান্য দেশের গবেষকেরা বলছেন, যে দ্রুততায় টিকাটি উদ্ভাবন করা হয়েছে, তাতে এটা নিশ্চিত যে রুশ গবেষকেরা তাড়াহুড়ো করেছেন। শুধু তা-ই নয়, এই টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার খসড়া তালিকায়ও নেই।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম টাইম জানায়, ৭৬ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর গত ১৭ জুন থেকে টিকাটির প্রাথমিক পরীক্ষা শুরু হয়। আর গতকাল রুশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, টিকাটির তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষায় দুই হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবী অংশ নেবেন।

তবে রাশিয়ার এই টিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সংশয়ে রয়েছে। খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, তারা টিকাটির ব্যাপারে খুঁটিনাটি পর্যালোচনা না করে অনুমোদনই দেবে না। জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র তারিক জানারেভিচ বলেন, ‘আমরা রুশ স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ ও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’

উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার খসড়া তালিকায় নেই রাশিয়ার এই টিকা। গত সোমবার পর্যন্ত হালনাগাদকৃত এই খসড়া তালিকায় ১৬৭টি সম্ভাব্য টিকার নাম রয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি টিকা মানবদেহে পরীক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। বাকিগুলো এখনো উদ্ভাবন পর্যায়ে রয়েছে। ওই ২৮টি টিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকা। এ ছাড়া চীনের সিনোভ্যাক, যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না ও ফাইজার, জার্মানির বায়োএনটেকের টিকাগুলোও আলোচনায় রয়েছে। এই টিকাগুলো মানবদেহে পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে রয়েছে।

টাইমের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন যে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার আগেই কোনো টিকা গণহারে প্রয়োগ হিতে বিপরীত হতে পারে। তাঁদের আশঙ্কা, রুশ বিজ্ঞানীরা হয়তো কর্তৃপক্ষের চাপে পড়ে টিকা উদ্ভাবনের ধাপগুলো কমিয়ে এনেছেন। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার আগেই টিকাটি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। তা ছাড়া টিকাটি নিয়ে কোনো পরীক্ষার ফলাফলও কোনো সুপরিচিত সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। উল্লেখ্য, গত মাসে রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁরা আগস্টেই বিশ্বের প্রথম করোনার টিকা উদ্ভাবনে সক্ষম হবেন।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার টিকাটির প্রাথমিক ধাপের পরীক্ষা সফল হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এটি মূলত সাধারণ সর্দি–কাশি সৃষ্টিকারী অ্যাডেনোভাইরাস থেকে তৈরি করা হয়, যা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী সক্ষমতা দেখাতে পারে।