উদ্ভাবনের আনন্দযাত্রায় স্বাগত

বিজ্ঞান জয়োৎ​সব ২০১৫
বিজ্ঞান জয়োৎ​সব ২০১৫

হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের ছোট্ট মৎস্যকুমারী রাজকুমারের জন্য নিজের লেজের পরিবর্তে এক জোড়া পা চেয়ে তা পেয়েছিল। তবে, প্রকৃতিতে কি এমন অদ্ভুত ব্যাপার হতে পারে? লেজ খসে গিয়ে পা জন্মানো? হাতির বাচ্চা কিন্তু একটা ছোট হাতিই। মানে তার হাত, পা, শুঁড় সবই থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু আনুপাতিক হারে বাড়ে। মানুষের বেলায়ও তাই। তার মানে লেজ খসে পা নিশ্চয়ই হবে না। যাঁদের দেখার চোখ আছে তাঁরা অবশ্য ধরে ফেলেছে! এমনটা তো ব্যাঙের বেলায়ও ঘটে। ছোটবেলার ব্যাঙ হলো ব্যাঙাচি, লেজ থাকে, কানকো থাকে। কিন্তু ব্যাঙ হতে হতে লেজ খসে পড়ে, জন্মায় পা।
এই ব্যাপারগুলো নতুন নয়। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ পর্যবেক্ষণ করে সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে। আর এভাবেই জন্ম হয় বিজ্ঞানের। গ্যালিলিও এসে অবশ্য ব্যাপারটাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি দেখালেন কেবল পর্যবেক্ষণ নয়, ইচ্ছে করলে একটি বিশেষ পরিিস্থতি তৈরি করে কিছু ঘটনা ঘটানো যায়, যা থেকে নিজের অনুমানের সত্যাসত্যি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন সেটিকে পোশাকি আবরণে ঢেকে দিলেন। জন্ম হলো পর্যবেক্ষণ, তত্ত্ব, পরীক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিশেষ জ্ঞানের আধুনিক বিজ্ঞানের।
আর প্রকৃতিকে ভালোভাবে জানার এই পদ্ধতির প্রয়োগে বিকশিত হলো প্রযুক্তি। এভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হয়ে উঠল আমাদের নতুন সভ্যতার ক্রীড়নক।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করেই এগিয়ে যাবে সভ্যতা—এই সহজ সত্যটা বুঝে ফেলেছে বেশির ভাগ জাতি। তাই সব জায়গায় আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হলো বিজ্ঞানশিক্ষাকে। কিন্তু হটাৎ করে আমাদের দেশে বিজ্ঞানশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থী কমে যেতে শুরু করে। এ থেকে উত্তরণের কাজ একটাই। শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনের আনন্দময় যাত্রায় শরিক করা। আর এই কাজটা করার জন্যই সিটি ব্যাংক-প্রথম আলো বিজ্ঞান জয়োৎসবের আয়োজন।
কুইজ, প্রজেক্ট কত–কী
বিজ্ঞান জয়োৎসবের মূল বিষয় হলো শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের মূল বিষয়, কার্যপদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, যাতে তারা উদ্ভাবনের আনন্দযাত্রায় শরিক হতে পারে। এর কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ১৫টি আঞ্চলিক জয়োৎসব, যেখানে থাকবে বিজ্ঞান প্রকল্প ও বিজ্ঞান কুইজ প্রতিযোগিতা। বিজ্ঞান প্রকল্প প্রতিযোগিতা হবে জুনিয়র (ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী) আর সিনিয়র (দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি) এই দুই গ্রুপে। একা বা সর্বোচ্চ তিনজনের একটা দলে প্রকল্প প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া যাবে। মোট চারটি বিষয়ের যেকোনো একটি বিষয়ে প্রকল্প জমা দেওয়া যাবে, ভৌত বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, জীববিজ্ঞান, কৃষি ও পরিবেশ। অন্যদিকে বিজ্ঞান কুইজ প্রতিযোগিতা হবে প্রাইমারি, জুনিয়র ও সেকেন্ডারি গ্রুপের শিক্ষার্থীদের জন্য। জয়োৎসবের কুইজ ও প্রকল্প প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করতে হবে নির্ধারিত সময়ে। জয়োৎসব প্রাঙ্গণে হবে আনন্দময় বিজ্ঞান শিক্ষা শীর্ষক মুক্ত সেমিনার, থাকবে বিজ্ঞানের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে একটা বড় আকারের প্রদর্শনী, থাকবে বিজ্ঞান গবেষণাবিষয়ক প্রশ্নোত্তর পর্ব এবং সবশেষে পুরস্কার বিতরণী।
১৫ অঞ্চলের বিজয়ীরা যোগ দেবে ঢাকার জাতীয় জয়োৎসবে। সেখানে কুইজ আর প্রকল্প ছাড়াও থাকবে বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন, দেয়ালিকার প্রতিযোগিতা। এরপর বিজয়ীদের নিয়ে আয়োজন করা হবে ক্যাম্পের, যেখানে তাদের গুগল বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করা হবে। তবে পুরস্কারের পালা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বরং খুদে বিজ্ঞানীরা সুযোগ পাবে একজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীর সঙ্গে সময় কাটানোর, নৈশভোজের।
কেমন বিজ্ঞান প্রকল্প চাই
বিজ্ঞান জয়োৎসবে আমরা সব ধরনের বিজ্ঞান প্রকল্পকে স্বাগত জানাব। তবে, যাচাইয়ের সময় দেখা হবে সেখানে বিজ্ঞান আছে কি না। কেউ যদি একটা গ্রামীণ ফ্রিজ তৈরি করে, তাহলে তাকে বলতে হবে ভেতরের তাপমাত্রা কত? প্রকল্পের ধারাবাহিক কার্যক্রমগুলো ঠিকভাবে তুলে ধরা, হিসাব নিকাশগুলো দেখাতে হবে। অন্যদিকে যেসব প্রকল্প শূন্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে কিংবা একবার চালিয়ে দেওয়ার পর চলতেই থাকবে, সেগুলোর কোনো আশা মনে হয় নেই।
উদ্ভাবনের আনন্দযাত্রায় স্বাগত
বিজ্ঞানের মূল আনন্দ কিন্তু আবিষ্কার আর উদ্ভাবনে। সেটা কেবলই আনন্দের নয়; বরং এ হলো মানবজাতির জীবনযাত্রাকে পাল্টে দেওয়ার হাতিয়ার। এককালে গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন, মেরি কুরিরা যে কাজটি করেছেন, এখন সে কাজটি করেন আবেদ চৌধুরী, জাহিদ হাসানের মতো বিজ্ঞানীরা। আবার বিল গেটস বা মার্ক জাকারবার্গের মতো প্রযুক্তিপ্রেমীরা বদলে দেন আমাদের প্রতিদিনকার জগৎটাকে। আমাদের আছে বিশ্ববিজ্ঞানের গৌরবময় উত্তরাধিকার। উদ্দীপনায় উদ্ভিদও প্রাণীদের মেতা সাড়া দেয়, তা জানার জন্য মানবসভ্যতাকে একজন জগদীশচন্দ্র বসুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। দুনিয়ার সব বস্তুকণার অর্ধেককে বলা হয় বসু কণা বা বোসন। এ আমাদের সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে। ঢাকার শেওড়াতলীর মেঘনাদ সাহাকে বলা হয় জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের জনক। সিলিকন ভ্যালির পরের ধাপে টপোলজিক্যাল ভ্যালির গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের জাহিদ হাসান। দিদারুল ইসলামের হাতে বিকশিত হয়েছে তৃতীয় প্রজন্মের সৌরপ্রযুক্তি। এসবেরই উত্তরাধিকার আমাদের নতুন প্রজন্ম। তারাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? বিশ্বজয়ের নেশায় তারাও মেতে উঠুক সৃষ্টিসুখের উল্লাসে।
উদ্ভাবনের আনন্দযাত্রায় সবাইকে স্বাগত জানাই।