তাঁরই হাত ধরে

আইবিএম ১৬২০ কম্পিউটার ব্যবহার করছেন হানিফউদ্দিন মিয়া l ছবি: সংগৃহীত
আইবিএম ১৬২০ কম্পিউটার ব্যবহার করছেন হানিফউদ্দিন মিয়া l ছবি: সংগৃহীত

হানিফউদ্দিন মিয়া। নামটি বললেই যে সবাই চিনে যাবেন এমন নয়। তবে তাঁর কাজটি আমাদের জন্য গৌরবের। তিনি দেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার। আর তাঁর কারণেই দেশে এসেছিল প্রথম কম্পিউটারটি। ঢাকায় সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপোতে হানিফউদ্দিন মিয়াকে দেওয়া হলো মরণোত্তর সম্মাননা। নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামে ১৯২৯ সালের ১ নভেম্বর জন্ম হানিফউদ্দিন মিয়ার। মারা যান ২০০৭ সালের ১১ মার্চ।
প্রথম কম্পিউটারের গল্প
দেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে হানিফউদ্দিন মিয়ার অবদান পতুলে ধরা হয় ১৯৯৭ সালে, বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে। সে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মোস্তাফা জব্বার জানালেন হানিফউদ্দিন মিয়া ও দেশের প্রথম কম্পিউটারের গল্প। ১৯৬৪ সালে জাহাজে করে বিশাল আকারের কম্পিউটার আসবে পাকিস্তানে। আইবিএম মেইন ফ্রেম ১৬২০ কম্পিউটার। সমস্যা হলো এই কম্পিউটার চালাবে কে? তখন মিলল মো. হানিফউদ্দিন মিয়ার খোঁজ। তিনি ছিলেন অ্যানালগ ও ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁকে পাকিস্তানের লাহোরে গিয়ে এই কম্পিউটার ব্যবহার করতে বলা হলো। কিন্তু বেঁকে বসেন হানিফউদ্দিন মিয়া। নিজের দেশ ছেড়ে কোথাও যাবেন না, সরাসরি জানিয়ে দিলেন। এ কারণেই ঢাউস আকারের কম্পিউটারটি এল ঢাকার আণবিক শক্তি কমিশনে। আর হানিফউদ্দিনের হাতেই শুরু হলো সেই কম্পিউটারের ব্যবহার।
বর্ণাঢ্য এক জীবন
হানিফউদ্দিন মিয়া বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের কম্পিউটার সার্ভিস বিভাগের পরিচালক ছিলেন। জানা গেল তাঁর ছেলে শরীফ হাসানের কাছ থেকে।
হানিফউদ্দিন মিয়া পড়াশোনা করেছিলেন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও গণিতে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে স্বর্ণপদকসহ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন হানিফউদ্দিন। তিনি ১৯৬০ সালে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন থিওরি অ্যান্ড অটোমেশন এবং চেকোস্লোভাক একাডেমি অব সায়েন্স থেকে অ্যানালগ ও ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) কম্পিউটার সেন্টার থেকে সিস্টেম অ্যানালিসিস, নিউমারাল ম্যাথমেটিকস, অ্যাডভান্স কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের প্রশিক্ষণও নেন। আর ১৯৭৫ সালে লন্ডনের আইবিএম রিসার্চ সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নেন অপারেটিং সিস্টেম ও সিস্টেম প্রোগ্রামিংয়ের। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ আন্তর্জাতিক পরমাণুশক্তি সংস্থায় (আইএইসি) সিস্টেম অ্যানালিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন।
মো. শরীফ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন প্রথম কম্পিউটার এ দেশে এসেছে তখন আমরা অনেক ছোট। বাবা ডেকে কম্পিউটারের পাশে বসাতেন আর সেই কম্পিউটারে বড় বড় বাটন ছিল।’

১৯৭৬ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় স​পরিবারে হানিফউদ্দিন মিয়া (বাঁয়ে) l ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম
১৯৭৬ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় স​পরিবারে হানিফউদ্দিন মিয়া (বাঁয়ে) l ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম

পেশায় প্রকৌশলী শরীফ হাসান ঢাকায় থাকেন তাঁর মা ফরিদা বেগমের সঙ্গে। হানিফ-ফরিদা দম্পতির আছে আরও দুই মেয়ে—ডোরা শিরিন ও নিতা শাহীন।
শরীফ হাসান বলেন, ‘কম্পিউটার ও কম্পিউটার শিক্ষার প্রতি তাঁর তীব্র ভালোবাসা থাকায় ২০০০ সালে বাবা আমাদের হুলহুলিয়া গ্রামের হাইস্কুলে দুইটি কম্পিউটার দান করেন। ২০১৪ সালে সরকারি উদ্যোগে এখানে একটি কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৯৭ সালের কথা। বাংলাদেশ টেলিভিশনে “কম্পিউটার” নামে সাপ্তাহিক একটি অনুষ্ঠান শুরু হলো। আমি ঠিক করলাম যাঁর হাত ধরে দেশে এসেছিল কম্পিউটার, তাঁকে দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করব। বিটিভির এটাই ছিল তার জীবনের প্রথম এবং শেষ সাক্ষাৎকার।’
হানিফউদ্দিনের ব্যবহৃত দেশের প্রথম সেই মেইনফ্রেম কম্পিউটারটি এখন প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে ঢাকার জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে।