রোবট বানিয়ে সোনা জয়

লংকাভির প্রতিযোগিতায় বুয়েটের দিশারি দলের তিন সদস্য (বাঁদিক থেকে)—ধীমান সরকার, মো. জাকারিয়া চৌধুরী ও মৃন্ময় সরকার l ছবি: সংগৃহীত
লংকাভির প্রতিযোগিতায় বুয়েটের দিশারি দলের তিন সদস্য (বাঁদিক থেকে)—ধীমান সরকার, মো. জাকারিয়া চৌধুরী ও মৃন্ময় সরকার l ছবি: সংগৃহীত

‘রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে যখন আটকে থাকা মানুষদের উদ্ধারের কাজ চলছিল, তখন আমাদের মন কেঁদে ওঠে। ভাবি, একটি আধুনিক যন্ত্র কেন আমাদের নেই, যা ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া মানুষের অবস্থান শনাক্ত করতে পারবে। তাঁর কাছে কিছু জরুরি সরঞ্জাম পৌঁছে দিতে পারবে। সেই ইচ্ছা থেকে জরুরি প্রয়োজনে কাজে লাগানো যায় এমন একটি রোবট তৈরির চিন্তা আমাদের মাথায় আসে।’ বলছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র মো. জাকারিয়া হায়দার। জাকারিয়া, ধীমান চৌধুরী ও মৃন্ময় সরকার—বুয়েটের এই তিন শিক্ষার্থীর তৈরি রোবট সোনার পদক জিতেছে মালয়েশিয়ার লংকাভিতে গত মাসে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক রোবটিক প্রতিযোগিতায়।
সোনাজয়ী দলটির নাম ‘টিম দিশারি’। দলের তিনজনই পড়ছেন বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগের শেষ বর্ষে। এই প্রতিযোগিতার নাম ছিল ‘আইইইই-আরএএস ইন্টারন্যাশনাল রোবট প্রাইড কম্পিটিশন-২০১৫’। আয়োজনে ছিল মালয়েশিয়ার রোবটিকস অ্যান্ড অটোমেশন সোসাইটি।
জাকারিয়া হায়দার বলেন, ‘গত মে মাসের দিকে একটি রোবট তৈরির কাজ শেষ করি আমরা। ব্যবহারিক ক্লাসের চূড়ান্ত প্রকল্প হিসেবে এটা বানাই। আর এটাকেই সেরা প্রকল্প হিসেবে নির্ধারণ করেন শিক্ষকেরা। প্রকল্পটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন অধ্যাপক শেখ আনোয়ারুল ফাত্তাহ।’ গত জুন মাসে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত আইসিটি এক্সপো-২০১৫ মেলায় এই রোবট দেখানো হয়। এরপর দলটি আন্তর্জাতিক রোবটিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন করে। প্রাথমিক বাছাই শেষে তাঁরা আমন্ত্রণ পান মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য।
ধীমান চৌধুরী ও মৃন্ময় সরকারের কাছ থেকে জানা গেল এই রোবটের কাজ সম্পর্কে। ‘ম্যাপ এক্সপ্লোরার’ নামের রোবটটি ধ্বংসস্তূপের ভেতরে আটকে পড়া মানুষের অবস্থান বের করতে সহায়তা করবে। একে দুইভাবে পরিচালনা করা যায়—নিয়ন্ত্রণযন্ত্র দিয়ে (ম্যানুয়াল) এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে (অটোমেটিক)। কিপ্যাড বা জয়স্টিক দিয়ে একে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। নিয়ন্ত্রণযন্ত্র (কন্ট্রোলার) ব্লুটুথের মাধ্যমে রোবটকে দিকনির্দেশনা দেয়। রোবটের সঙ্গে লাগানো আছে ক্যামেরা, ফলে তাৎক্ষণিক ভিডিও দেখা যায়। ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে উদ্ধারকাজের এই ভিডিও একাধিক কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও স্মার্টফোনেও দেখা যাবে। রোবটটি চলাচল করার সময় সেই রাস্তার মানচিত্র পাঠাবে। ফলে সুনির্দিষ্ট দূরত্ব ও অবস্থান বের করা যায় সহজেই। পরবর্তী উদ্ধারকাজে ব্যবহারের জন্য এই মানচিত্র সংরক্ষণ করে রাখা হয়। এ ছাড়া রোবটিক হাত দিয়ে পানির বোতল, শুকনো খাবারসহ দরকারি জিনিস আটকে পড়া মানুষদের কাছে পৌঁছানো যাবে।
স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করার সময় রোবটের মাইক্রোকন্ট্রোলারে কোনো জায়গার মানচিত্র কম্পিউটারের মাধ্যমে দিয়ে দিলে সেটি অনুসরণ করে উদ্ধারকাজে সাহায্য করবে রোবটটি। কাজের সময় যদি কোনো কারণে কন্ট্রোলারের সঙ্গে রোবটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে রোবটটি একা একই অতিক্রম করা মানচিত্র অনুসরণ করে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে। এতে রোবটটি হারিয়ে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকবে না।
‘প্রতিযোগিতার চারটি বিভাগের মধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগে অংশ নিয়েছিলাম। আমাদের বিভাগে প্রতিযোগী ছিল ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়ার ১৭টি দল। তাঁরা সাবমেরিন, কোয়াডকপ্টার, নজরদারির রোবট, প্রোস্থেটিক হ্যান্ড, মানবাকৃতির রোবট ইত্যাদি প্রদর্শন করে—প্রতিযোগিতা নিয়ে বলেন জাকারিয়া হায়দার। ১৭ ও ১৮ অক্টোবর হয়েছে এই প্রতিযোগিতা।
মৃন্ময় বলেন, ‘মোট পাঁচটি বিষয় বিবেচনায় ধরেন বিচারকেরা। আমরা স্বর্ণপদক পাব ভাবিনি। তবে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। আমাদের রোবটটির আকার একটু বড় আর তাতে ছোটখাটো কিছু ত্রুটি ছিল। এটি পরবর্তী সময়ে আবার নতুন করে তৈরি করেছি।’
দিশারি দলের তিনজনই নটর ডেম কলেজ থেকে ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করে। এরপর তিনজনই বুয়েটে ভর্তি হন। রোবট প্রতিযোগিতার পাশাপাশি অ্যাপ তৈরি, ধারণা উপস্থাপন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করেন তাঁরা। স্বল্পমূল্যের একটি ব্রেইল প্রিন্টারের মডেলও বানিয়েছিলেন তাঁরা।
দিশারির তিন সদস্যের ভাষ্য, দেশে যন্ত্র নিয়ে কাজ করার সমস্যা হচ্ছে যন্ত্রাংশের স্বল্পতা ও আর্থিক সামর্থ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে গবেষণার জন্য আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায় না। ফলে ভালো প্রকল্প শুধু প্রকল্পেই থেকে যায়, বাস্তবজীবনে ব্যবহারের উপযোগী হয় না। প্রকল্পগুলো যেন মানুষের কাজে লাগে, সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন বুয়েটের এই তিন ছাত্র।