২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেলেন হপফিল্ড ও হিন্টন

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জিওফ্রে ই হিন্টন ও জন জে হপফিল্ড (ডানে)রয়টার্স

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চলছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) জয়জয়কার। সহজে বিভিন্ন কাজ করার সুযোগ থাকার পাশাপাশি সহজলভ্য হওয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়ছে দ্রুত। আর তাই এআই প্রযুক্তি তথা মেশিন লার্নিংয়ের জন্য কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের মৌলিক ভিত্তি উদ্ভাবনের জন্য এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জন জে হপফিল্ড ও কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জিওফ্রে ই হিন্টন। তাঁদের আবিষ্কার ও উদ্ভাবন মেশিন লার্নিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করে নোবেল কমিটি।

নোবেল কমিটি যা বলছে

জন জে হপফিল্ড একটি কাঠামো তৈরি করেছেন যা তথ্য সংরক্ষণ ও পুনর্গঠন করতে পারে। আর জিওফ্রে হিন্টন এমন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন যা স্বাধীনভাবে ডেটার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করতে ভূমিকা রাখে। এই দুই উদ্ভাবনই বর্তমানে ব্যবহৃত বৃহৎ কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও নিয়ম ব্যবহার করে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ককে প্রশিক্ষণও দিয়েছেন এই দুই বিজ্ঞানী। তাঁদের উদ্ভাবিত পদ্ধতি আজকের শক্তিশালী মেশিন লার্নিংয়ের ভিত্তি তৈরি করেছে। জন হপফিল্ড একটি সহযোগী মেমরি তৈরি করেছেন যা বিভিন্ন ধরনের ছবি ও তথ্যাদির প্যাটার্ন সংরক্ষণ করে ও পুনর্গঠন করতে পারে। অন্যদিকে, জিওফ্রে হিন্টন এমন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যা স্বায়ত্তশাসিতভাবে ডেটার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেতে পারে। বিভিন্ন ছবি থেকে নির্দিষ্ট উপাদান শনাক্ত করার মতো কাজ সম্পাদন করে।

মস্তিষ্ক থেকেই সব অনুপ্রেরণা

আমরা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে যেসব কথা বলছি, তা মূলত কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কযুক্ত মেশিন লার্নিং। এই প্রযুক্তি মূলত মস্তিষ্কের জটিল গঠন দেখে তৈরি করা হয়েছে। একটি কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কে মস্তিষ্কের নিউরনের মতো বিভিন্ন নোড দ্বারা সংযুক্ত করা হয়, যাদের বিভিন্ন মান রয়েছে। আর্টিফিশিয়াল নিউরনকে নোড বলে। বিভিন্ন নোডে সংযোগের মাধ্যমে একে অপরকে প্রভাবিত করে যা মস্তিষ্কের সিন্যাপসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এই সংযোগ শক্তিশালী বা দুর্বল করে তৈরি করা যায়। এই নেটওয়ার্ককে প্রশিক্ষিত করা যায়। উচ্চ মানের ডেটা দিয়ে বিভিন্ন নোডের মধ্যে শক্তিশালী সংযোগের বিকাশ ঘটানো যায়। এ বছরের নোবেল বিজয়ীরা ১৯৮০–এর দশক থেকে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কসংযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ করছেন।

এআই কাঠামো তৈরি

জন হপফিল্ড ১৯৮২ সালে হপফিল্ড নেটওয়ার্কের ধারণা প্রকাশ করেন। আর ২০০০ দশকে প্যাটার্ন শনাক্ত করে নতুন প্যাটার্ন তৈরির জন্য বোল্টজম্যান মেশিনের ধারণাও দেন তিনি। বিজ্ঞানী জন হপফিল্ড বিশেষ একটি নেটওয়ার্ক উদ্ভাবন করেছেন। এই নেটওয়ার্ক বিভিন্ন তথ্যের নমুনা সংরক্ষণ করে আবার তৈরি করার জন্য বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে। আমরা নেটওয়ার্কের নোডকে পিক্সেল হিসেবে কল্পনা করতে পারি। হপফিল্ড নেটওয়ার্ক পদার্থবিজ্ঞানের কৌশল ব্যবহার করে। কণার পারমাণবিক ঘূর্ণনের বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে নেটওয়ার্ক কাজ করে। যখন হপফিল্ড নেটওয়ার্ককে কোনো বিকৃত বা অসম্পূর্ণ চিত্র দেওয়া হয়, তখন তা পদ্ধতিগতভাবে নোডের মাধ্যমে কাজ করে। তাদের মান আপডেট করে নেটওয়ার্কের শক্তি হ্রাস পায়। নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যা খোঁজা হচ্ছে, তার মতো সংরক্ষিত চিত্র খুঁজে পেতে ধাপে ধাপে কাজ করে পুরো কাঠামো।

অন্যদিকে জিওফ্রে হিন্টন হপফিল্ড নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নতুন নেটওয়ার্কের ভিত্তি তৈরি করেছেন। বোল্টজম্যান মেশিন নামের ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেন তিনি। এই পদ্ধতিতে ডেটার ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপাদান চিনতে পারে মেশিন। হিন্টন পরিসংখ্যানগত পদার্থবিজ্ঞান থেকে ধারণা নেন। যন্ত্রকে এমন উদাহরণ দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয় যা মেশিন চালানোর সময় উত্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। বোল্টজম্যান মেশিন বিভিন্ন চিত্র শ্রেণিবদ্ধ করতে বা যে ধরনের প্যাটার্নের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তার নতুন উদাহরণ তৈরি করতে ব্যবহার করা যায়। হিন্টন এই কাজের ওপর ভিত্তি করে কাজ করেন। তাঁর এই কাজের ভিত্তিতেই মেশিন লার্নিংয়ের বর্তমান ধারা দেখা যাচ্ছে।

হপফিল্ড ও হিন্টনের আবিষ্কার ও উদ্ভাবন যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

নোবেল কমিটির তথ্যমতে, কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে মেশিন লার্নিং বিকশিত হচ্ছে। এর শুরু হয়েছিল ১৯৪০ দশকে। দৈনন্দিন ও বৈজ্ঞানিক ব্যবহারের সঙ্গে নিউরাল নেটওয়ার্ক এখন একটি শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এমন নেটওয়ার্ক মস্তিষ্কের নিউরন দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই নেটওয়ার্ক সংযুক্ত নোড বা নিউরন দ্বারা গঠিত হয়। এসব নোড পূর্বনির্ধারিত নির্দেশাবলি অনুসরণ না করে নতুন কাজ সম্পাদন করার জন্য প্রশিক্ষিত। এদের গঠন পদার্থবিজ্ঞানের স্পিন মডেলের মতো। এ বছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক পদ্ধতিকে অগ্রসর করার গবেষণাকে সম্মানিত করেছে।

জন জোসেফ হপফিল্ডের পরিচয়

বিজ্ঞানী জন জোসেফ হপফিল্ডের জন্ম ১৯৩৩ সালের ১৫ জুলাই। তাঁর বাবা ছিলেন পোলিশ-আমেরিকান বিজ্ঞানী জন জে হপফিল্ড। জন হপফিল্ড সোয়ার্থমোর কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রি লাভ করে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল তত্ত্ব ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়। বেল ল্যাবে দুই বছর কাজ করে তিনি শিক্ষকতায় যুক্ত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি ক্যালটেকে কম্পিউটেশন অ্যান্ড নিউরাল সিস্টেমে পিএইচডি চালু করতে ভূমিকা রাখেন। ১৯৮২ সালে নিউরোসায়েন্স বিষয়ে তাঁর প্রথম গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, এখানেই তিনি হপফিল্ড নেটওয়ার্কের প্রস্তাব দেন।

জিওফ্রে এভারেস্ট হিন্টনের পরিচয়

ব্রিটিশ-কানাডিয়ান বিজ্ঞানী জিওফ্রে হিন্টনের পুরোনাম জিওফ্রে এভারেস্ট হিন্টন। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। একধারে কম্পিউটারবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানী হিন্টনকে ‘গডফাদার অব এআই’ বলা হয়ে থাকে। ১৯৭০ সালে তিনি এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজিতে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পরে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে ১৯৭৮ সালে পিএইচডি করেন। এরপর দীর্ঘদিন সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ডিয়াগো, কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শেষে ২০১৩ সালে গুগলে যোগ দেন তিনি। ১৯৮৫ সালে তিনি ডেভিড অ্যাকলে ও টেরি সেজনোস্কির সঙ্গে যৌথভাবে বোল্টজম্যান মেশিন নামের নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। ২০১৮ সালে কম্পিউটার দুনিয়ার নোবেল প্রাইজখ্যাত টুরিং পুরস্কারও পেয়েছেন হিন্টন।

সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গ