এই গাড়িতে গতির সঙ্গে মিলবে স্বাচ্ছন্দ্য

বিওয়াইডি সিল পারফরম্যান্স
ছবি: প্রথম আলো

বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চীনের বিল্ড ইয়োর ড্রিমস বা বিওয়াইডি অন্যতম। ২০২৩ সালে বিখ্যাত বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলাকে পেছনে ফেলে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণে বিওয়াইডি শীর্ষস্থানে জায়গা করে নিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি সারা পৃথিবীতে এক বছরে ৩০ লাখ বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি করে সাড়া ফেলে দিয়েছে। সম্প্রতি দেশের বাজারে বিওয়াইডি সিল এক্সটেন্ডেড ও পারফরম্যান্স মডেলের দুটি গাড়ি দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে।

বিওয়াইডি সিল পারফরম্যান্স সংস্করণের গাড়িটি অল হুইল ড্রাইভ (এডব্লিউডি)। গাড়িটি সম্পর্কে হাতে–কলমে জানতে গতকাল রোববার এই প্রতিবেদক টেস্ট ড্রাইভে অংশ নেন। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বিওয়াইডির প্রদর্শনী কেন্দ্র থেকে গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পূর্বাচল ৩০০ ফিট মহাসড়কে। বৈদ্যুতিক এই গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে এই প্রতিবেদন।

গাড়িতে আছে বড় টাচস্ক্রিন ডিসপ্লে
ছবি: সংগৃহীত

প্রদর্শনী কেন্দ্রে বিওয়াইডি সিল পারফরম্যান্স গাড়িটির রং কালো (কসমস ব্ল্যাক)। এটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয়। সামনের দিক ‘এক্স’ আকৃতির নকশা। দ্বৈত ‘ইউ’আকৃতির পেছনের আলো (ব্যাকলাইট) গাড়ির দৃশ্যমানতা প্রকাশে ভূমিকা রেখেছে। স্পোর্টস সেডান ধারার এই গাড়ির কাঠামো অ্যারোডাইনামিক নকশায় তৈরি। এ জন্য বাতাসের প্রতিকূলে গাড়িটির ছুটে চলা আরও সাবলীল।

বিজয় সরণি থেকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ধরে যাত্রা শুরু হয়। গাড়িটির তাৎক্ষণিক গতি (ইনস্ট্যান্ট এক্সিলারেশন) মুগ্ধ করার মতো। মাত্র ৩ সেকেন্ডে গাড়ির ড্যাশবোর্ডে স্পিডোমিটারে গতি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার দেখা গেল। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গতিসীমা থাকায় ক্রুজ কন্ট্রোল (নির্ধারিত গতিতে চালনা) সুবিধা ব্যবহার করে নির্ধারিত গতিতে গাড়ি চালানো হয়। কুড়িলে নেমে চলে আসি ৩০০ ফিট সড়কে। গতির পরীক্ষায় এখানে গাড়ির গতি পাওয়া যায় ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার।

মসৃণ রাস্তা হওয়ার কারণে গাড়ির গতি এখানে অনুভব করা যায় না। এত গতিতেও মনে হচ্ছিল গাড়িটি ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার বেগে চলছে। গাড়ির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একেবারেই শব্দহীন। শব্দরোধী (সাউন্ড প্রুফ) ক্যাবিনেট থাকার কারণে বাইরের কোনো শব্দ ভেতরে আসছিল না।

পাশ থেকে বিওয়াইডি সিল পারফরম্যান্স
ছবি: প্রথম আলো

অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় দেখা গেল সামনের সারিতে চারটি এসি ভেন্ট রয়েছে। এই ভেন্টগুলোর শীতল বাতাসের দিকনির্দেশনা (এসি ভেন্ট ডিরেকশন) মাল্টিমিডিয়া ডিসপ্লে থেকে আঙুলের ছোঁয়ায় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রয়েছে ১৫.৬ ইঞ্চির মাল্টিমিডিয়া টাচ স্ক্রিন। পর্দাটিকে সোজাসুজি এবং আড়াআড়ি দুভাবেই রাখা যায়। কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ বা ভয়েস কন্ট্রোলের মাধ্যমেও গাড়িটিকে নির্দেশ দেওয়া যায়। এই গাড়িতে ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা রয়েছে। পাশাপাশি কোনো গাড়ি যদি কাছাকাছি চলে আসে, তবে ক্যামেরাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়, ডিসপ্লেতে দেখা যায়। এ ছাড়া ডানে বা বাঁয়ে সিগন্যাল লাইট জ্বালালেও ক্যামেরায় গাড়ির চাকার অবস্থা এবং আশপাশের দৃশ্য ধরা পড়ে। পর্দায় তা দেখা যায়। গাড়ি ডানে–বাঁয়ে অথবা সামনে–পেছনে চালানোর সময় বিশাল ডিসপ্লেতে গাড়ির চাকার সীমা দেখার সুবিধা রয়েছে। পুরো গাড়িতে রয়েছে ‘মিউজিক সেন্সড অ্যাম্বিয়েন্ট লাইট’। গানের সুরে সুরে আলোর রং বদলায়। গাড়ির সব আসনে পা রাখার প্রশস্ত জায়গা রয়েছে। এককথায় ৬ ফুট উচ্চতার মানুষও আরামসে বসতে পারবে।

চালকের পাশের দরজা খুলতেই আসনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেছনে চলে গিয়ে গাড়িতে ঢোকার জায়গা বাড়িয়ে দিল। এই গাড়িতে ‘সিট মেমোরি’ রয়েছে। চালক নিজের পছন্দমতো লেগস্পেস এবং স্টিয়ারিং হুইলের অবস্থান বের করে মেমোরিতে সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন। পরে গাড়িতে ঢোকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসন ও স্টিয়ারিং এই অবস্থানে চলে যাবে। গাড়িটির গিয়ার প্যানেলটা বেশ নান্দনিক। এই অংশটার নাম বিওয়াইডি হার্ট। গাড়িটি চালু বা বন্ধ, হ্যাজার্ড, অটো হোল্ড, শব্দ নিয়ন্ত্রণ, ড্রাইভিং মোড পরিবর্তনসহ প্রায় সব কাজ এই অংশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

গিয়ার পরিবর্তনের হাতলটি (গিয়ার শিফটার) স্ফটিক স্বচ্ছ। পেছনে আলোও (ব্যাকলিট) রয়েছে। গিয়ার শিফটারের সামনে দুটি স্মার্টফোন একসঙ্গে তার ছাড়া চার্জ করার কুইক চার্জার। আমার ফোনটি ট্রেতে রাখার সঙ্গে সঙ্গে কুইক চার্জ নেওয়া শুরু করেছিল। যখন গাড়ি চালানো শুরু করলাম, দেখলাম গাড়িতে ৩৫ শতাংশ চার্জ রয়েছে। এই চার্জে এটি ১৯০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারবে।

সিটবেল্ট লাগিয়ে ফাঁকা রাস্তায় গতির স্বাদ নিতে চাইলাম। এক্সিলারেটরে পা দিতেই গতি উঠল ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার। ৩০০ ফিটের নিচে নেমে যাওয়া রাস্তায় হঠাৎ ব্রেক ধরে গাড়িকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। তখন বুঝলাম শুধু গতি নয়, গতি থামাতে এই গাড়ির চার চাকাতেই রয়েছে ডিস্ক ব্রেক। গাড়িতে অতিরিক্ত কোনো ঝাঁকি নেই। মসৃণ রাস্তা ছেড়ে এবার পূর্বাচল লেডিস ক্লাবের সরু রাস্তায় প্রবেশ করলাম। এই রাস্তা বন্ধুর।

প্রচুর উঁচু–নিচু ও ভাঙাচোরা। গাড়িতে চালকসহ আমরা পাঁচজন। ভাঙা সড়কে ইচ্ছা করেই একটু জোরে চালালাম। তারপরও গাড়ির মূল কাঠামো চেসিসের সঙ্গে রাস্তার ঘর্ষণ হলো না। অ্যাডাপটিভ সাসপেনশন থাকায় অমসৃণ রাস্তাতেও কেবিনের অভ্যন্তরে যাত্রীরা কোনো ঝাঁকি টের পাননি। গাড়িটির যাত্রী আসনের সারিতেও রয়েছে আলাদা এসি ভেন্ট। হাতল (হ্যান্ডরেস্ট) থাকায় চারজন যাত্রী বেশ আরামসে পথ পাড়ি দিতে পারবেন।

টেস্ট ড্রাইভে প্রতিবেদক
ছবি: সংগৃহীত

হোম থিয়েটারের মতো গাড়িতে থিয়েটারের অনুভূতি পেতে বিওয়াইডি সিলে রয়েছে হাই–ফাই ডাইন অডিও প্রিমিয়াম সাউন্ড বুস্টসমৃদ্ধ ১২টি স্পিকার। বৈদ্যুতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত গাড়ির সামনের আসনগুলোতে রয়েছে হিটেড এবং কুলিং সিট অপশন। দীর্ঘ পথে অথবা অতিরিক্ত ঠান্ডায় চালক বা যাত্রীর ক্লান্তি দূর করতে এই সুবিধাটি বেশ উপকারী।

গাড়িটির আরেকটি নান্দনিক দিক হলো এর প্যানারমিক মুনরুফ। পুরো ছাদটাই মুনরুফ। দিনের বেলায় গাড়ির মধ্য থেকে পুরো আকাশ দেখার স্বাধীনতা উপভোগ করা যায়। মুনরুফটি অতি বেগুনি রশ্মি (ইউভি)  প্রতিরোধক। এতে সূর্যের আলো ঢুকলেও তাপমাত্রা বাড়ার সুযোগ নেই। আর রাতে চাঁদের আলোয় এই গাড়িটিকে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হবে।    

‘ভবিষ্যৎ এখনি’ স্লোগানে বাজারে আনা বিওয়াইডি সিল গাড়িটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা যথাক্রমে ৪৮০০, ১৮৭৫ এবং ১৪৬০ মিলিমিটার। গাড়িতে ৮২.৫ কিলোওয়াটের বিওয়াইডি ব্লেড ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে। মাত্র ৩.৮ সেকেন্ডে বিওয়াইডি সিল পারফরম্যান্স শূন্য থেকে ১০০ কিলোমিচার পর্যন্ত গতি তুলতে সক্ষম। গাড়িটির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটার।

সাধারণ গাড়িগুলোতে শুধু পেছনের ডালায় মালামাল বহন করা গেলেও সিলে রয়েছে সামনে এবং পেছনে জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা। স্বয়ংক্রিয় ট্রাঙ্ক গেটের সুবিধাসহ গাড়িটির পেছনে ৪০০ লিটার ধারণক্ষমতা। আর সামনে বনেটের নিচে ৫৩ লিটার ধারণক্ষমতা রয়েছে, যেখানে ছোটখাটো একটি লাগেজ সহজেই রাখা যাবে। বেশ কাজের জিনিস বলতেই হয়।

বিওয়াইডি সিলে প্রথমবারের মতো ‘সেল টু বডি’ অর্থাৎ সিটিবি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। স্যান্ডউইচ প্রযুক্তিতে তৈরি গাড়িটির শরীরে ব্লেড ব্যাটারি স্থাপন করা হয়েছে। সিটিবি প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্লেড ব্যাটারি নিজেই একটি শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করবে। গাড়িটিতে আইট্যাক বা ইন্টেলিজেন্স টর্ক অ্যাডাপশন কন্ট্রোল প্রযুক্তি রয়েছে। এই প্রযুক্তির কারণে পিচ্ছিল রাস্তায়ও টর্ক নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যাবে। ফলে গাড়িটি যাত্রীদের দেবে বাড়তি নিরাপত্তা। এনইভি বা নিউ এনার্জি ভেহিকেল শ্রেণিতে সিলে এআই-প্ল্যাটফর্ম ৩.০ ব্যবহার করা হয়েছে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গাড়িটিতে হিট পাম্প রয়েছে এতে। এই পাম্পের কারণে ব্যাটারি দ্রুত শীতল হবে এবং কম শক্তি খরচ করে দূরত্ব পাড়ি দেবে। স্লান্টেড রুফলাইন, শর্ট রিয়ার ডেক, ওয়াটারড্রপ মিরর, ওয়েভ ওয়েস্টলাইন ও পিএম ২.৫ ফিল্টারেশন সুবিধা গাড়িটিকে অনন্য করেছে। ভয়েস কমান্ড ও ইন্টেলিজেন্ট ককপিট সিস্টেম চালক এবং যাত্রীকে বাড়তি সুবিধা দেবে।

এবার ফেরার পালা। ফাঁকা রাস্তা ফেলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে আমরা নামি মহাখালীতে। যানজট নিয়ে এগোতে থাকি সামনের দিকে। অটো হোল্ড থাকায় গিয়ার পজিশন পরিবর্তন না করেও থ্রটল থেকে পা সরানোর সুযোগ মেলে। এত বড় ডিসপ্লেতে গাড়ির ক্যামেরাগুলোও বেশ উজ্জ্বল চারপাশের দৃশ্য দেখা যায়। ইউটার্ন নেওয়ার সময় দেখলাম গাড়িটির টায়ারের নৈপুণ্যও উল্লেখ করার মতো। ১৯ ইঞ্চির এই চাকাগুলো যাত্রাপথে আলাদা স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করে।

২ মার্চ রাজধানীর পূর্বাচলে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় গাড়ি দুটির আগাম ফরমাশের জন্য অবমুক্ত করা হয়। নেপালের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চৌধুরী গ্রুপ এবং বাংলাদেশে রানার গ্রুপের মধ্যকার একটি যৌথ উদ্যোগ ‘সিজি-রানার বাংলাদেশ’ বিওয়াইডির একমাত্র পরিবেশক।

গাড়িটির মূল্য এখনো নির্ধারিত না হলেও সম্ভাব্য মূল্য বিওয়াইডি সিল পারফরম্যান্স অল হুইল ড্রাইভের মূল্য হবে ১ কোটি ৪০ লাখের মতো। এক্সটেন্ডের মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। তবে মূল্য বাড়তে বা কমতেও পারে।