আমার রেসিংয়ের পূর্ণাঙ্গ গল্প

অভিক আনোয়ারসংগৃহীত

আমার রেসিং যাত্রা শুরু হয়েছিল তখন, যখন আমি ছিলাম ছোট একটি ছেলে। ছোটবেলা থেকেই যখন বুঝতে শিখলাম গাড়ি আসলে আমার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তখন থেকেই আমি গাড়ি নিয়ে খেলা শুরু করি। সেই সময় আমাদের অবস্থা খুব একটা সচ্ছল ছিল না—আমি বলব না আমরা গরিব ছিলাম, তবে পরিপূর্ণও ছিলাম না। তাই খেলনা গাড়ি না পেয়ে আমি আর আমার বড় ভাই একসঙ্গে শার্পনার আর রাবার দিয়ে গাড়ির মতো করে খেলা করতাম।

ধীরে ধীরে বড় হতে হতে আমি টেলিভিশনে রেস দেখা শুরু করি। তখন টেলিভিশন মানেই ছিল স্টার স্পোর্টস আর ফর্মুলা ওয়ান দেখা। তবে শর্ত ছিল একটাই—আমার পড়ালেখার ফল ভালো হতে হবে, তাহলে তবেই আমাকে রেসিং দেখতে দেওয়া হতো।
আমার যখন আট বা নয় বছর বয়স, তখন থেকেই গাড়ি চালানো শেখা শুরু করি। আর দশ বছর বয়সে আমি পুরোপুরি ম্যানুয়াল গিয়ার গাড়ি চালাতে পারতাম। আমি যে গাড়িটিতে গাড়ি চালানো শিখি, সেটি ছিল ১৯৯১ সালের টয়োটা করোনা ইএক্স–ফোর।
আমার বাবা গাড়ির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই বাসায় নতুন মডেলের গাড়ি আসা-যাওয়া করত নিয়মিত। এটা আমার গাড়ির প্রতি আগ্রহকে আরও বাড়িয়েছিল। যখন আমি ও-লেভেলস এবং এ-লেভেলস করছিলাম, তখন আমি বুঝতে পারি যে গাড়ি আমার একান্ত ভালোবাসা, আর আমি এটা নিয়ে ভবিষ্যতে পেশাগত কিছু করতে চাই।
কিন্তু সেই সময় বাংলাদেশে রেসিংয়ের তেমন কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না। তাই বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিলেন, আমি যেন অর্থনীতিতে পড়ি। আমি তাঁদের কথা রাখি এবং কানাডায় উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাই। সেখানে বিভিন্ন খণ্ডকালীন কাজ করি—বিউটি প্রোডাক্ট ডেলিভারি, লাইব্রেরি সহকারী, লাইন কুক, কল সেন্টার—সবই করতাম, যাতে নিজের প্রথম ট্র্যাক কার কিনতে পারি। আমি একটি হোন্ডা সিভিক হ্যাচব্যাক কিনি, টাইপ আর ছিল না। মডিফাই করে তা দিয়ে রেসিং শুরু করি এবং পারফরম্যান্স দেখে সবাই মুগ্ধ হতো।

কানাডার রেসিং স্কুলে
সংগৃহীত

২০১২ সালে দেশে ফিরে এসে ব্যবসায় মনোযোগ দিই। ২০১৪ সালে প্রথম বাংলাদেশে র‍্যালিক্রস চ্যাম্পিয়নশিপ হয়, আমি মিৎসুবিশি ইভল্যুশন ১০ নিয়ে অংশ নিই এবং ‘আন্ডারডগ’ হয়েও টানা তিন বছর (২০১৪-২০১৬) চ্যাম্পিয়ন হই।

২০১৭ সালে কানাডায় গিয়ে জিম রাসেল রেসিং স্কুল থেকে রেসিং লাইসেন্স নেই এবং ভারতীয় ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপে অংশ নিই। প্রথম দুই বছর ৪র্থ স্থান ছাড়াতে পারিনি, কিন্তু ২০১৯ সালে কারিমোটর স্পিডওয়েতে প্রথম আন্তর্জাতিক রেস জয় করি। এরপর মাদ্রাজ মোটর ট্র্যাকে তৃতীয় হই।

এরপর মালয়েশিয়ার মালয়েশিয়া চ্যাম্পিয়নশিপ সিরিজে অংশ নিয়ে তৃতীয় স্থান পাই এবং একই বছর সেপাং ১০০০ কিমি এন্ডুরেন্স রেস ক্লাসে ৪র্থ হই—যা ছিল কোনো বাংলাদেশির জন্য প্রথম।

কোভিড মহামারির সময় ঘরে বসে দিনে ৭–৮ ঘণ্টা অনুশীলন করি, তারপর সংযুক্ত আরব–আমিরাতে (ইউএই) গিয়ে এনজিকে প্রো কার চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম রাউন্ডেই জয় পাই এবং শুধু তিনটি রাউন্ডে অংশ নিয়ে পুরো চ্যাম্পিয়নশিপে তৃতীয় হই। পরের বছর পূর্ণ চ্যাম্পিয়নশিপ করে চ্যাম্পিয়ন হই—প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করি। এই সময়ে ভক্সওয়াগন পোলো কাপে একটি রেস জয় এবং একাধিক পডিয়াম অর্জন করি, চ্যাম্পিয়নশিপে ৪র্থ হই।

ক্লিও কাপ চ্যাম্পিয়নশিপে তৃতীয় স্থান অর্জনের ট্রফি হাতে অভিক আনোয়ার
সংগৃহীত

চ্যাম্পিয়নশিপ জয় সহজ ছিল না। মাঝপথে আমাকে অন্য ক্লাসে উঠিয়ে দেয়া হয় কম শক্তিশালী গাড়ি নিয়ে। আমি ফেসবুকে লাইভে প্রতিবাদ করি, মিডিয়ায় বিষয়টি ওঠে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের সহায়তায় আমি ইন্টেরিয়র মিনিস্টারের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করি—শেষ পর্যন্ত সমাধান হয়।

এরপর আমি টিপি ক্লাসে মালয়েশিয়া চ্যাম্পিয়নশিপ সিরিজের সম্পূর্ণ সিজনে অংশ নিই, একাধিক রেস জয় করি ও পডিয়ামে থাকি। আমি হই প্রথম বাংলাদেশি, যে মালয়েশিয়ায় রেস জেতে এবং চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় হয়। একই বছরে ইউএইতে দ্বিতীয় এবং ভারতে পোলো কাপে তৃতীয় হই।

২০২২ সালে আমি আমার পছন্দের এবং দীর্ঘদিন দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া মানুষ আরমানি মাওয়িশ নাওমিকে বিয়ে করি। তিনি আমার ক্যারিয়ারে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন, সব সময় পাশে থেকেছেন। সাফল্য অর্জনের চেয়েও তা ধরে রাখতে একজন শক্তিশালী সঙ্গীর প্রয়োজন হয়  তিনিই সেই শক্তি।

২০২৩ সালে আমি আমার দাদিকে হারাই, যার সঙ্গে ছিল খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাঁর মৃত্যুর ঠিক পরেই মালয়েশিয়ায় একটি রেস জিতি। জুলাইয়ে বাবাকে হারাই এবং তাঁর মৃত্যুর পরের রেসটিও জিতি এবং তাঁকে উৎসর্গ করি।

মালয়েশিয়ায় প্রথম জয়ের পর
সংগৃহীত

২০২৩ সালে মালয়েশিয়ান রাউন্ড ২-এ এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুখোমুখি হই। এক অ্যাকুয়াপ্ল্যানিং দুর্ঘটনায় আমার জীবন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তখন আমরা সন্তান প্রত্যাশা করছিলাম। ভাগ্য ভালো ছিল, অক্ষতভাবে বেঁচে ফিরি। সন্তান জন্মের জন্য আমরা কানাডায় যাই, কিন্তু ততদিনে আমি ইউএইর গালফ প্রো কার এবং রেনল্ট ক্লিও কাপের অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি। স্ত্রী অন্তঃস্বত্ত্বা অবস্থায় ও সন্তানের জন্মের পরও বারবার যাতায়াত করি। এ সময় একটি বড় দুর্ঘটনায় পড়ে পাঁজরে ইনজুরি হয়, ৩–৪ মাস রেস করতে পারিনি।

ইনজুরি থেকে কিছুটা সেরে উঠে গালফ প্রো কার চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল রাউন্ডে অংশ নিয়ে দুটি রেসেই জয় পাই এবং চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় হই। এরপর মালয়েশিয়ায় ইনজুরি নিয়েই রেস করি — সফল হইনি, তবে ভারতের ২০২৪ পোলো কাপে একটি পডিয়াম অর্জন করি।

২০২৪ সালের সেই হতাশাজনক মৌসুমের পর, আমি নিজেকে মানসিকভাবে রিসেট করি এবং বছরের শেষ দিকে আবার গালফ প্রো কার ও রেনল্ট ক্লিও কাপে অংশ নিই। আবারও গালফ প্রো কারে দ্বিতীয় এবং রেনল্ট ক্লিও কাপে তৃতীয় হই—যেটি একটি ঐতিহাসিক অর্জন, কারণ এই চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবারের মতো কোনো বাংলাদেশি পডিয়ামে উঠেছে।

এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক রেসে অংশ নিয়েছি। ২০২৪ সালের এফআইএ মোটরস্পোর্ট গেমসে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়া এবং ৮৫টির বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জনের পর, আমি রেসিং থেকে কিছু সময়ের জন্য বিরতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

রেসে প্রথম জয়ের পর
সংগৃহীত

বাংলাদেশ থেকে যারা রেসিংয়ে আসতে চায়

তরুণ হোক বা যেকোনো বয়সী, এখন তাঁরা একটি বড় সহায়তা পাচ্ছে অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এএবি) থেকে। তারা সম্প্রতি পুরোদমে মোটরস্পোর্টসে কার্যক্রম শুরু করেছে এবং জাতীয় পর্যায়ে দক্ষ রেসার তৈরির লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

একটি বিষয় অবশ্যই বুঝে নিতে হবে — রেসিং এমন একটি খেলা যা মানসিক ও শারীরিকভাবে অন্য যেকোনো খেলাধুলার চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং। এখানে শুধু প্রতিভা নয়, প্রয়োজন অসংখ্য ঘণ্টা অনুশীলন, দৃষ্টিশক্তির ক্ষিপ্রতা, মানসিক দৃঢ়তা এবং দেহ-মন দুটোরই সীমাহীন সহনশীলতা।

তাই যাঁরা এই পথে আসতে চান, তাঁদের হতে হবে চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত। কারণ রেসিংয়ে টিকে থাকতে পারে কেবল তাঁরাই, যাঁরা সত্যিকার অর্থে সেরা এবং সবচেয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।