মোটরসাইকেল বাজারের হালচাল

দুই চাকার বাহন হিসেবে মোটরসাইকেলের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কম খরচে ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর পাশাপাশি উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে মধ্যবয়সী ও তরুণদের কাছে মোটরসাইকেল হলো একটি ভরসার নাম। তবে বছরের শুরুর দিকে মোটরসাইকেল বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা কমা, মূল্যস্ফীতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০২৪ সালে বিগত বছরের তুলনায় ২ শতাংশ বিক্রি কমেছে। দামি মোটরসাইকেলগুলোর ক্ষেত্রে মিলছে ভিন্ন চিত্র। বাজেট যাঁদের সমস্যা না, তাঁরা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাইক পরিবর্তন করছেন।

 

বাজারে কার অবস্থান কী

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মোটরসাইকেল বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের বাজারেও শীর্ষে রয়েছে। দেশের মোট বিক্রীত মোটরসাইকেলের প্রায় ২২ শতাংশ শেয়ার ধরে রেখেছে ভারতের অটোমোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাজাজ। গত বছর তাদের বিক্রি ১০ শতাংশ কমলেও এখনো বাজারে তাদের নেতৃত্ব রয়েছে। প্রায় ২০ শতাংশ শেয়ার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইয়ামাহা। বিলাসবহুল এবং স্পোর্টি লুকের কারণে তরুণদের কাছে জনপ্রিয় ব্র্যান্ড সুজুকি। প্রায় ১৯ শতাংশ শেয়ার নিয়ে সুজুকির শেয়ারও ইয়ামাহার কাছাকাছি। হোন্ডার অবস্থান চতুর্থ হলেও সাশ্রয়ী মূল্যে মোটরসাইকেল বিক্রি এবং বিশ্বস্ততার দিক থেকে শহরের চেয়ে মফস্‌সল বা গ্রামে হোন্ডার কমিউটার বাইকগুলোর চাহিদা বেড়েছে। ১৫ থেকে ১৬ শতাংশের মধ্যে বাজারে হোন্ডার শেয়ার। ২০২৪ সালে কম এবং সাশ্রয়ী মূল্যে বাইক বিক্রি করার কারণে ভারতীয় বাইক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিরো ৫৮ হাজারের বেশি মোটরসাইকেল বিক্রি করে প্রায় ১৫ শতাংশ শেয়ার দখল করতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি দেশীয় বাইক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রানারও বাজারে কিছুটা স্থান দখল করতে পেরেছে।

বাজার আনুমানিক ২০০ কোটি ডলারের

২০২৫ সালে দেশের মোটরসাইকেলের বাজারের আকার আনুমানিক ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের এবং ২০২৯ সালের মধ্যে এটি পৌঁছাতে পারে ২১০ কোটি ডলারে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজারে দেখা দিয়েছে উল্লেখযোগ্য অস্থিরতা ও চ্যালেঞ্জ। ২০২৪ সালে মোটরসাইকেলের বিক্রি ছিল মাত্র ৩ লাখ ৯ হাজার ইউনিট, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ডলার–সংকট, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ আমদানি খরচ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা, এ চারটি বড় কারণ ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদা দুই–ই কমিয়ে দিয়েছে। যেখানে ২০২২ সালের ৬ লাখ ৪ হাজার ইউনিট মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে, সেখানে ২০২৩ সালে এসে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৪ লাখ ৬১ হাজার ইউনিট। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ২৮ শতাংশ বিক্রি কমেছে।

মোটরসাইকেল বিক্রি কমেছে ভারতের আরেক প্রতিষ্ঠান টিভিএসের। গত বছর ৩৫ শতাংশ কমে তাদের বিক্রি ৩০ হাজার ইউনিটের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে বাইকের প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা থাকলেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেকে নতুন বাহন কেনা থেকে বিরত থাকছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে যাঁদের হাতে টাকা ছিল, তাঁরাও এখন খরচ করতে পারছেন না বলে মন্তব্য করেন মোটরসাইকেল ব্যবসায়ীরা। প্রদর্শনী কেন্দ্র এবং অনলাইন গবেষণা করে দেখা যায়, মানুষ নিজেদের শখ পূরণ করতে মোটরসাইকেল সম্পর্কে জানছেন; কিন্তু কেনার কথা চিন্তা করে অনেকেই পিছিয়ে যাচ্ছেন।

কমিউটার বাইক

১০০ থেকে ১২৫ সিসির মোটরসাইকেলগুলোকে কমিউটার বাইক হিসেবে গণ্য করা হয়। সাশ্রয়ী মূল্য, কম জ্বালানিতে বেশি পথ পাড়ি দেওয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম বলে ব্যক্তিগত ব্যবহারের পাশাপাশি রাইড শেয়ারিং, খাবার সরবরাহ, কুরিয়ার সার্ভিসসহ ডেলিভারিম্যানদের বাহন হিসেবে এ ধরনের বাইক ব্যবহার হয়ে থাকে। পড়াশোনা বা চাকরির পাশাপাশি অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্যও মোটরবাইক একটি প্রয়োজনীয় বাহনে পরিণত হয়েছে। নারীরা নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের জন্য গণপরিবহনের চেয়ে ব্যক্তিগত পরিবহন হিসেবে মোটরসাইকেলকে বেছে নিচ্ছেন। কমিউটার শ্রেণির জনপ্রিয় মোটরবাইকগুলো হলো বাজাজ ডিসকভার ১২৫, প্লাটিনা ১১০ এইচ-গিয়ার, হোন্ডা সিবি শাইন ১২৫, এসপি ১২৫, সুজুকি হায়াতে ইপি, টিভিএস মেট্রো প্লাস, হিরো স্পেলেন্ডর প্লাস এবং হিরো এক্সট্রিম ১২৫ আর।

বাজাজের পরিবেশক এস কে ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আল মামুন বলেন, ‘২০১৮ থেকে ২০২১ সাল মোটরসাইকেল বিক্রির স্বর্ণযুগ ছিল। ২০২১ সালের পর থেকেই মূলত বিক্রি কমতে থাকে। মধ্যম ঘরানার বাইকের মধ্যে বাজাজের ডিসকভার ১২৫ বিক্রির শীর্ষে রয়েছে। পাশাপাশি সিঙ্গেল ডিস্কে পালসার ১৫০ সিসির বাইকটাও সাশ্রয়ী মূল্যে ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করছে। বছরের শুরুতে বাইক বিক্রি কমে গিয়েছিল। তবে গত দুই মাসে আমাদের বিক্রি প্রায় দুই হাজার ইউনিট বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তরবঙ্গ এবং যশোর অঞ্চলের দিকে আমের বাম্পার ফলনের কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাইক বিক্রিও বেড়েছে। আগে যেমন ধান বিক্রি করে মানুষ শখ পূরণ করতেন, এখন তেমনি আম ও লিচু থেকে শুরু করে মৌসুমি অন্যান্য ফল বিক্রি করে মানুষ সক্ষমতা অর্জন করছেন। বাজার পরিবর্তন হয়ে বাইক বিক্রি বাড়বে বলে আমি আশাবাদী।’

 

উচ্চ সিসির বাইক 

৩৫০ সিসি বাইক সেগমেন্ট রয়্যাল এনফিল্ড বাজার দখল করা শুরু করেছে। এখনো আগাম ফরমা শ অনুসারে তাদের বাইক ক্রেতাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রিমিয়াম সেগমেন্ট রয়্যাল এনফিল্ডের পর ইয়ামাহা, সুজুকি, বাজাজসহ চীনা বাইক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিএফমটো উচ্চ সিসির বাইক দেশের বাজারে বিক্রি করছে। ক্রেতাদের সাড়াও মিলছে বেশ। ধনী ক্রেতাদের ওপর অর্থনৈতিক চাপের প্রভাব অতটা পড়েনি, তাই বিলাসবহুল বাইক বিক্রি তেমন একটা কমেনি। প্রিমিয়াম শ্রেণিতে অন্যতম বাইকগুলো হলো রয়্যাল এনফিল্ডের ক্ল্যাসিক, সুজুকি জিক্সার এসএফ২৫০, ইয়ামাহা এফজেড ২৫, সিএফ মটো ৩০০এসআর এবং বাজাজ পালসার এন২৫০।

বৈদ্যুতিক বাইকের চাহিদা বাড়ছে

বৈদ্যুতিক বাইক ক্যাটাগরিতে চীনের বেশ কয়েকটি ব্যাটারি এবং ই-বাইক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বাহন দেশে পাওয়া যাচ্ছে। দেশেও বৈদ্যুতিক বাইক তৈরি করছে ওয়ালটন। পাশাপাশি রানার পরিবেশন করছে জনপ্রিয় ই-বাইক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইয়াদিয়ার ব্যাটারিচালিত বাইক। পাওয়া যাচ্ছে স্বনামধন্য ই-বাইক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রিভো, আইমার বৈদ্যুতিক বাইক। লিথিয়াম ব্যাটারি এবং ই-বাইকের ওপর শুল্ক কমে গেলে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান দেশে বৈদ্যুতিক বাইক সংযোজন এবং বাজারজাত করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছে ইভি লাইফ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সোহেল বিন আজাদ।

 

ধীরে ধীরে আবার মোটরসাইকেলের বাজার ফিরছে

দেশে মোটরসাইকেলের সার্বিক বাজার সম্পর্কে বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেডের (বিএইচপিএল) প্রধান বিপণন কর্মকর্তা (সিএমও) আশেকুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের মোটরসাইকেলশিল্প ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধারের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক ঈদ মৌসুমে মোটরসাইকেল কিনতে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ব্যাপক বেড়েছে। গ্রাহকেরা এখন কম সিসি (১০০ সিসি) থেকে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত, জ্বালানিতে সাশ্রয়ী ও কম রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়যুক্ত মাঝারি সিসির (১২৫ সিসি) মোটরসাইকেলের দিকে ঝুঁকছেন।’