১ গিগাবাইটের যে হার্ডডিস্ক তখন বিস্ময় জাগিয়েছিল

কোয়ান্টামের বিগ ফুট হার্ডডিস্ক
উইকিমিডিয়া কমন্স

হাতের মুঠোয় ধরা এই সময়ের স্মার্টফোনের তথ্য ধারণক্ষমতা কত? উত্তরটা দিতে হয় গিগাবাইটে বা জিবিতে। সেটাও ৬৪, ১২৮, ২৫৬ বা তারও বেশি পরিমাণ। ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ কম্পিউটারের তথ্য ধারণক্ষমতা বা স্টোরেজ তো ১ টেরাবাইট ছাড়িয়েছে সেই কবে! অথচ একটা সময় ১ গিগাবাইটের হার্ডডিস্ক ড্রাইভ (এইচডিডি) ছিল বহুল প্রতীক্ষিত। তাই তো ঢাকা শহরে প্রথম যখন ১ গিগাবাইটের হার্ডডিস্ক নিজের হাতে নিয়ে দেখলাম, তখন বিস্মিত ও রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।

১৯৯৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধের কোনো এক সময়। আমি তখন ইন্দিরা রোডের কম্পিউটার বিপণন প্রতিষ্ঠান দ্য হার্ডওয়্যারের টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করি, পড়াশোনার পাশাপাশি। যন্ত্রাংশ সংযোজন করে গোটা একটা কম্পিউটার তৈরি, সফটওয়্যার ইনস্টল, যন্ত্রে কোনো সমস্যা দেখা গেলে সেটার সমাধান (ট্রাবলশুটিং) করা আমাদের কাজ। এত দিন পর সঠিক তারিখ মনে নেই, তবে জুলাই বা আগস্টের কোনো এক দিনের বিকেল হবে। দ্য হার্ডওয়্যারের পরিচালক মাহবুবুল আলম বললেন, ‘পল্লব, ১ গিগাবাইটের হার্ডডিস্ক নাকি এসেছে। সমীর দার অফিসে গিয়ে নিয়ে আসো একটা।’ আমি তো বিস্মিত। ‘১ গিগার হার্ডডিস্ক!’ তখন ৩৪০, ৫২০ মেগাবাইটের হার্ডডিস্কই আমাদের কাছে বিশাল।

সমীর দা মানে সমীর কুমার দাশ। সেই সময়ে পুরানা পল্টনের মোনার্ক কম্পিউটারস ও ইঞ্জিনিয়ার্সের অংশীদার। সহকর্মী আশরাফকে নিয়ে বিকেলেই রওনা হলাম মোনার্কের পথে। পুরো পথের রিকশাযাত্রায় আমরা বেশ উত্তেজিত। মোনার্কে পৌঁছানোর পর আমাদের হাতে সমীর কুমার দাশ তুলে দিলেন সেই হার্ডডিস্ক। ১ নয়, এটা ১.২ গিগাবাইট ধারণক্ষমতার। ১০২৬ মেগাবাইটে হয় ১ গিগাবাইট। সেই সময়ে এর মানে অনেক অনেক তথ্য এঁটে যাবে ভেতরে চাকতিওয়ালা চার কোনা এই যন্ত্রাংশে।

কোয়ান্টাম ব্র্যান্ডের এই হার্ডডিস্কের নাম ‘বিগ ফুট’—বড় পা। হার্ডডিস্কটা হাতে নিয়েই এই নামকরণের কার্যকারণ বোঝা গেল। বিগ ফুট আক্ষরিকভাবেই বড়সড়। আর বেশ ওজনদার। সেই সময়ের প্রচলিত হার্ডডিস্কগুলো সাড়ে ৩ ইঞ্চি প্রশস্ত ছিল। এই বিগ ফুট প্রস্থে ছিল সোয়া ৫ ইঞ্চি। এ কারণেই এমন নাম।

মুঠোফোনে সেই সময়ের কথা হচ্ছিল সমীর কুমার দাশের সঙ্গে। তিনি এখন কম্পিউটার প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ব্র্যান্ড (প্রা.) লিমিটেডের সেলস ও ডিস্ট্রিবিউশন বিভাগের প্রধান। সমীর বলেন, ‘গিগাবাইট ধারণক্ষমতার হার্ডডিস্ক কোয়ান্টাম প্রথম তৈরি করে। সেই সময়ে প্রযুক্তির দিক থেকে সেটি বৈপ্লবিক ঘটনা ছিল। যতটুকু মনে পড়ছে তখন আমরা ১.২ গিগাবাইটের বিগ ফুট বিক্রি করতাম ২৫ হাজার টাকার আশপাশে।’ তখনো বাংলাদেশে কম্পিউটার ও এর যন্ত্রাংশের ওপর আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়নি। তাই কম্পিউটারের সবকিছুই ব্যয়বহুল ছিল।

নব্বইয়ের দশকে প্রচলিত সাড়ে ৩ ইঞ্চির হার্ডডিস্কের পাশে বিগ ফুট (ওপরে ডানে)
উইকিমিডিয়া কমন্স

ঢাকায় ১.২ গিগাবাইটের বিগ ফুট দেখে আমাদের যে বিস্ময় তৈরি হয়েছিল, তা শুধু আমাদেরই না। আজ থেকে ২৮ বছর আগে এই হার্ডডিস্ক প্রযুক্তি জগৎকেই আলোড়িত করেছিল। ফটোশপ, অটোক্যাডের মতো সফটওয়্যার তখন ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। উইন্ডোজ আসায় অনেক প্রোগ্রামেই তখন ছবি, অডিও-ভিডিওর ছোঁয়া। তাই কাজ করার জন্য, কাজের ফাইল রাখার জন্য বেশি বেশি জায়গা চাই হার্ডডিস্কে। মেগা থেকে গিগায় উত্তরণের প্রযুক্তি নিয়ে আলোড়ন তাই স্বাভাবিক।

১৯৯৬ সালের মে মাসে বিগ ফুট নামে হার্ডডিস্ক বাজারে আনে যুক্তরাষ্ট্রের স্যান জোসেভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম করপোরেশন। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত কোয়ান্টামের এই হার্ডডিস্ক নব্বই দশকের শেষ নাগাদ রাজত্ব করে গেছে। সাড়ে তিনের জায়গায় সোয়া পাঁচ ইঞ্চি মাপের হওয়ায় এই হার্ডডিস্ক শুরু থেকেই ছিল ব্যতিক্রমী। কম্পিউটারে ওই সময়ে সিডি চালানোর যে সিডি ড্রাইভ, সেটিও ছিল প্রস্থে সোয়া পাঁচ ইঞ্চি। একই সঙ্গে ১.২ ও ২.৫ গিগাবাইটের বিগ ফুট বাজারে এসেছিল। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, জাপানসহ কয়েকটি দেশে থাকা কোয়ান্টামের কারখানায় তৈরি হতো এই বিগ ফুট।

আজ তো কম্পিউটারে র‌্যামই থাকে কয়েক গিগাবাইটের। কিন্তু গত শতকের শেষ প্রান্তে তথ্য ধারণে গিগাবাইট যুগের শুরুটা ছিল রোমাঞ্চকর।