সৌদি আরবে দিনমজুর ওয়াহিদুর এখন ফ্রিল্যান্সার, মাসে আয় আড়াই লাখ টাকার বেশি
সালটা ছিল ২০২৩। ওয়াহিদুর রহমান কাজের জন্য পাড়ি দিলেন সৌদি আরব। সেখানে তিনি একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ নিলেন। প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। ওয়াহিদুরের কাজটা ছিল দুই তলা থেকে পাঁচ–ছয়তলা পর্যন্ত ৫০ কেজির সিমেন্টের বস্তা ওঠানো। কিছু একটা করে বাড়ি ফিরতে হবে, সেই তাড়া সব সময় ছিল ওয়াহিদুর রহমানের। তাই কাজের ফাঁকে খুঁজতেন কী করা যায়।
ওয়াহিদুর রহমান খোঁজ পেলেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের। ২০২৩ সালেই কাজের পাশাপাশি শুরু করলেন ফ্রিল্যান্সিং শেখা; কিন্তু কাজ হলো না। ছয় মাস করে কিছুই শিখতে পারলেন না ওয়াহিদুর। আবার একটা হতাশায় পড়লেন।
বাংলাদেশে যেহেতু মেহেরপুরে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে কাজ করেছেন, ওই সনদ দেখিয়ে সৌদি আরবের সেই নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুতের কাজে ঢুকলেন। কাজের চাপ একটু কমে ওয়াহিদুরের। আবার খোঁজ নেওয়া শুরু করলেন কীভাবে ফ্রিল্যান্সিং শেখা যায়। তখন আরেকটি প্রতিষ্ঠানে শুরু করেন শেখা। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে ১০ ঘণ্টা কাজ করেন আর রাত জেগে কাজ শেখেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের। এভাবে ধের্য ধরে শিখতে শিখতেই দক্ষ হলেন গুগল অ্যাডস, ওয়েব অ্যানালাইটিকস ও কনভার্সন ট্র্যাকিংয়ের ওপর। এখন তিনি আপওয়ার্কের টপ–রেটেড ফ্রিল্যান্সার, পাশাপাশি লিংকডইন থেকেও গ্রাহকের অনেক কাজ করেন। এখন মাসে আয় করেন আড়াই লাখ টাকার বেশি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আসেন পরিবারের কাছে। দেশ ছাড়লেন কাজের সন্ধানে, কাজ শিখে আবার দেশেই ফিরে এলেন ওয়াহিদুর রহমান।
যেন স্বপ্নের অতীত
ওয়াহিদুর রহমান, ডাকনাম তুহিন। জন্ম কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলার দৌলতপুরের ইউসুফপুর গ্রামে। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। তবে পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে ওয়াহিদুর রহমানের মা–বাবা গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হন। তিনি তখন কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজে এইচএসসি পড়েন। একদিন মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফোন করে বলেন, ‘আমাদের পক্ষে আর তোমার পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব নয়।’ সেদিন থেকে শুরু হয় ওয়াহিদুর রহমানের সংগ্রামী পথচলা। সেদিন অবশ্য ওয়াহিদুর স্বপ্নেও ভাবেননি, তিনি মাসে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ডলার আয় করতে সক্ষম হবেন।
চড়াই–উতরাইয়ে ভরা জীবন
ওয়াহিদুরের জীবন চড়াই–উতরাইয়ে ভরা। এই সফলতা তাঁর জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক সময় ও আনন্দ। তবে এই সময় ও আনন্দের বিনিময় মূল্য তাঁর আজকের সফলতা।
জীবনের প্রথম উপার্জন শুরু হয়েছিল টিউশনি দিয়ে। টিউশনি করে সামান্য যে টাকা উপার্জন করতেন, তা দিয়ে নিজের মেসের খরচ চালানোই দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। স্কুলের বন্ধুদের কেউ ১০০ টাকা, কেউ ৫০০ টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন তাঁকে। পারিবারিক দুর্দশার মধ্যেও নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন পরীক্ষার জন্য। এমন সময় টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে পড়েন ওয়াহিদুর রহমান। ফলে পরীক্ষার ফল আশানুরূপ হয় না। আশপাশের মানুষজন তখন কটূক্তি করতে শুরু করে। ফলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। আর্থিক সংকটের কারণে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাও দিতে পারেন না।
এরপর ওয়াহিদুর ঠিক করেন যে তিনি চাকরি করবেন। মাত্র ১২ হাজার টাকা বেতনে যোগ দেন একটি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে। নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ শুরু করেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হয়। ফলে একাকিত্ব আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে তাঁকে। ভুগতে শুরু করেন হতাশায়।
এরপর বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে মেহেরপুরে লাইনম্যান পদে চাকরি পান। বেতন সর্বসাকল্যে ২৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে বিয়ে করেন। ফলে মাস শেষে হাত খালিই থাকত। কিস্তি ও ধারদেনায় ক্রমেই জর্জরিত হতে থাকে জীবন। কী করবেন, কিছু ভেবে পাচ্ছিলেন না। স্ত্রীকে বলতেন, এভাবে তো চলবে না। একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন, চাকরি ছেড়ে দেবেন। পাড়ি জমাবেন সৌদি আরবে। পরিবার বা শ্বশুরবাড়ির কেউ বিদেশ গমনের এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেননি। তবে ওয়াহিদুরের জেদ তাঁকে পিছু ফিরতে দেয় না। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি। কিন্তু সৌদি আরবে যেতে অন্ততপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা প্রয়োজন। এমনিতেই তিন লাখ টাকার মতো দেনা জমে আছে। নতুন করে টাকা কোথায় পাবেন?
অবশেষে ওয়াহিদুরের শাশুড়ি এই ঋণের ব্যবস্থা করে দেন। আগের তিন লাখ টাকাসহ মোট আট লাখ টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে দেশ ছাড়েন ওয়াহিদুর। তত দিনে তাঁদের ঘরে নতুন সদস্য এসেছে। সেই সদস্যের বয়স তখন মাত্র ২৪ দিন।
সৌদি আরবে গিয়ে ওয়াহিদুর জীবনের অর্থ আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন। বেতন ছিল সাকল্যে ৬০ হাজার টাকা। অথচ কিস্তিই ছিল ৩৭ হাজার। ফলে মোট বেতন থেকে ৩০-৩৫ হাজার টাকা দেশে পাঠিয়ে দিতেন। বাকি টাকায় নিজে চলতে হিমশিম খেতে হতো। কিন্তু কিছু তো করার ছিল না।
ধীরে ধীরে সময় কেটে যায়। সন্তান কথা বলা শিখে ফেলে। আধো আধো বোলে ফোনে বলে, ‘বাবা, তুমি কবে আসবে? আমার জন্য গাড়ি কিনে আনবে, চকলেট আনবে। কবে আসবে সব নিয়ে?’ সন্তানের কথাগুলো শুনে ওয়াহিদুরের বুক ভেঙে যেত। একটা যন্ত্রণা ভেতর থেকে ছিঁড়ে খেত। চোখের পানি লুকিয়ে কথা বলেন স্ত্রীর সঙ্গে, সন্তানের সঙ্গে। এই কষ্ট পরিবারের কাউকে বলা যায় না। কথা শেষ হলে মোবাইল রেখে একা একা কাঁদতেন লুকিয়ে। সেই যন্ত্রণা তাঁকে আজও তাড়া করে বেড়ায়।
দেশে ফেরার আকুতি
ওয়াহিদুর শুধু ভাবতেন, কবে দেশে ফিরতে পারবেন! কিন্তু দেশে ফিরলে মা-বাবার কী হবে? স্ত্রী-সন্তানের কী হবে? তারা কি আগের মতো ভালোবাসবে তাকে? এসব চিন্তা কুরে কুরে খেতে থাকে তাঁকে। ভেতর থেকে আরও দুর্বল করে দেয়। তিনি ঠিক করেন, দেশে অবশ্যই ফিরবেন। তবে ফেরার আগে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ঋণের বোঝা কমাতে পারেন। আবার পরিবার নিয়ে একত্রে সুখে থাকতে পারেন।
ফ্রিল্যান্সিংয়ে ঘুরে দাঁড়ানো
একদিন ওয়াহিদুর ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে জানতে পারেন। ফ্রিল্যান্সিং করে নাকি আয় করা যায়। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেন, ফ্রিল্যান্সিং শিখবেন। যত দ্রুত পারেন, শিখবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। অ্যামাজন থেকে কিস্তিতে একটি ল্যাপটপ কেনেন তিনি। ভর্তি হন একটি তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রে। শুরুতে ভালো শেখালেও পরে বুঝতে পারেন, যা শিখতে পারছেন, তা দিয়ে গড়পড়তা চলবে হয়তো। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিংয়ের জগতে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। ধীরে ধীরে আবার তাঁকে ঘিরে ধরা হতাশা। একপর্যায়ে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন তিনি। মনে হতে থাকে, ফ্রিল্যান্সিং বুঝি পুরোপুরি একটি স্ক্যাম।
ঠিক তখনই স্কিলআপার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কথা জানতে পারেন ওয়াহিদুর। নিজেকে আরেকটি সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবেন। শুরুতে ৯৯০ টাকায় একটি রেকর্ডেড কোর্স কেনেন। প্রথম কয়েকটি ক্লাস দেখে নতুন করে আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়। সৌদি আরবে থাকতে প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। কাজ থেকে ফিরে রাত জেগে চর্চা করতেন। অনেক দিন না ঘুমিয়ে টানা অনুশীলন করতে হয়েছে। প্রতিটি মিনিটের হিসাব রাখতেন। কীভাবে করতেন এতটা পরিশ্রম? ওয়াহিদুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলের কাছে ফিরতে হবে যেকোনো মূল্যে’—এ ভাবনাটিই তাঁকে সব বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে।
এভাবে আট মাস টানা পরিশ্রম করেছেন ওয়াহিদুর। এরপর ১৫ ডলারের একটি কাজ পান। এ কাজটি দিয়ে শুরু হয় তাঁর ফ্রিল্যান্সিং পেশার পথচলা। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি—এই তিন মাসে দুই হাজার ডলার আয় করেন তিনি।
এ বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরেন। এসেই সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। এত দিনে নিজেকে সফল মনে হয় ওয়াহিদুরের। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ডলার। স্বপ্ন দেখেন, একদিন একটি আন্তর্জাতিক এজেন্সি গড়ে তুলবেন, যেখানে শতাধিক মানুষের আয়ের ব্যবস্থা থাকবে।