রাজমিস্ত্রির জোগালি, হোটেল বয় ও ফুডপ্যান্ডার রাইডার থেকে রিফাদুল এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে

রিফাদুল এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছবি: প্রথম আলো

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মধুর ক্যানটিনের সামনে অপেক্ষা করছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কড়িঘর উচ্চবিদ্যালয় থেকে উঠে আসা রিফাদুল ইসলামের জন্য। একটু পরেই তিনি এলেন। মুখে বিজয়ের হাসি, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে ফেলে আসা কঠিন দিনের দীর্ঘশ্বাস।

এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের ফি জোগাতে করেছেন রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ। কখনো রেস্তোরাঁ কিংবা মুঠোফোন সারানোর দোকানে শ্রম দেওয়া, আবার কখনো ওষুধের দোকানে কাজ করা। ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালাতে গায়ে জড়িয়েছেন ফুডপ্যান্ডার রাইডারের জ্যাকেট। জীবনের চড়াই–উতরাই পেরিয়ে দরিদ্র ঘরের এই ছেলে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের শিক্ষার্থী। রিফাদুল ইসলামের এই উঠে আসার গল্প কোনো রূপকথার চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়।

দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া গ্রামে রিফাদুল ইসলামের জন্ম। বাবা আবুল কাশেম পেশায় দরজি এবং মা সুরাইয়া বেগম গৃহিণী। চার ভাই–বোনের মধ্যে রিফাদুল দ্বিতীয়, তবে বড় ছেলে হওয়ায় কাঁধে ছিল পাহাড় সমান দায়িত্ব। অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।

রিফাদুল ইসলাম যখন বুঝতে শিখলেন দারিদ্র্য কী, তখন থেকেই শুরু হলো তাঁর বেঁচে থাকার লড়াই। ছেলের কলেজের পড়াশোনা শুরুর সময় বাবা তাঁর সামান্য জমিটুকুও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। রিফাদুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন বুঝি, আমাদের সামান্য যতটুকু জমি ছিল, সেটা আমাদের পড়াশোনা চালানোর জন্যই বাবাকে বিক্রি করতে হয়েছে।’

এসএসসির রেজিস্ট্রেশন ফি জোগাতে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ

জীবনের অন্যতম কঠিন সময় ছিল এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময়ের দিনগুলো। বাবার পকেটে টাকা নেই। কী করবেন? কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নন রিফাদুল। টানা এক সপ্তাহ রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করলেন। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে পারিশ্রমিক পেলেন ২ হাজার ১০০ টাকা। রিফাদুল সেই টাকা দিয়েই এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করলেন। স্মৃতিচারণা করে রিফাদুল বলেন, ‘আমার পরিষ্কার মনে আছে, ওই টাকা দিয়ে আমি আমার রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েছিলাম। রেজিস্ট্রেশন না করলে হয়তো ওখানেই পড়াশোনার ইতি টানতে হতো।’

রিফাদুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

করোনাকাল ও বিচিত্র পেশার অভিজ্ঞতা

করোনাকালে যখন স্কুল–কলেজ বন্ধ, রিফাদুল তখন বসে থাকেননি। জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো কাজকেই ছোট মনে করেননি তিনি। কখনো হোটেল বয়, কখনো মোবাইল মেকানিক, আবার কখনো চাতালে ধান শুকানো ও চাল প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ করেছেন। কলেজে পড়ার সময় মেসের খরচ চালাতে যে বাড়িতে থাকতেন, সেই বাড়ির মালিকের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন দুই সন্তানকে বিকেলে হাঁটাতেন।

তবে কষ্টের একটি স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে রিফাদুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার সময় যে হোটেলে কাজ করতাম, এক ভাইয়ের মাধ্যমে সেখানে আমার দৈনিক ১০০ টাকা মজুরি ঠিক হয়েছিল। কাজ করেছি ৫০ দিন। দেওয়ার কথা ছিল পাঁচ হাজার টাকা, দিয়েছে মাত্র দুই হাজার টাকা। বাকি তিন হাজার টাকা এখনো দেয়নি। যখন দেখলাম উনি টাকা দিচ্ছেন না, তখন কাজ ছেড়ে দিলাম। শ্রম দিয়ে পারিশ্রমিক না পাওয়াটা খুব কষ্টের। কারণ, ওই টাকা দিয়েই আমাকে পড়াশোনার খরচ চালাতে হতো।’

অটো পাস চেয়ে পেলেন জিপিএ–৫

রিফাদুল ইসলামের সততা ও সরলতা ফুটে ওঠে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তিতে। তিনি হেসে বলেন, ‘আমি নামাজ পড়ে দোয়া করতাম যেন এসএসসিতে অটো পাস দেয়। আমি ওই লেভেলের ছাত্র ছিলাম।’

কিন্তু ভাগ্য পরিশ্রমীদের পক্ষেই থাকে। কঠোর পরিশ্রমে রিফাদুল শুধু পাসই করলেন না, পিএসসি (২০১৬), এসএসসি (২০২২) ও এইচএসসি (২০২৪) প্রতিটি ধাপেই জিপিএ–৫ অর্জন করলেন। খড়িয়ালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কড়িঘর উচ্চবিদ্যালয় ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষাজীবন পার করেছেন।

এইচএসসির পর মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনে বৃত্তির জন্য আবেদন করেন। তাদের সব শর্ত পূরণ হওয়ায় পড়াশোনার প্রায় ৮০ শতাংশ খরচ তাদের কাছ থেকে পেয়েছেন। রিফাদুল স্বীকার করেন, এই বৃত্তি না পেলে পথচলা আরও কঠিন হতো।

ফুডপ্যান্ডার রাইডার যখন ঢাবি শিক্ষার্থী

গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে রিফাদুল মুখোমুখি হন নতুন বাস্তবতার। টিউশনি পাওয়া সোনার হরিণের মতো কঠিন। কিন্তু রিফাদুল থেমে থাকেননি। ঢাকায় আসার এক সপ্তাহের মাথায় তিনি যুক্ত হন ফুডপ্যান্ডার ডেলিভারি রাইডার হিসেবে। ক্যাম্পাসে ক্লাস আর রাস্তায় খাবার সরবরাহ—এভাবেই চলছিল তাঁর জীবন।

রিফাদুল বলেন, ‘টিউশনির জন্য বসে না থেকে যেকোনো কাজ করা সম্মানের। আমি আমার বন্ধুদের বাসায়ও কাজ করেছি। আমার কাছে কোনো কাজই ছোট নয়। আমি তো চুরি বা ডাকাতি করছি না, কাজ করছি—এটাই সম্মানের।’ বর্তমানে তিনি আই এডুকেশন–এ ক্লাস নিচ্ছেন, সঙ্গে টিউশনি করছেন এবং বাবার নেওয়া ঋণও শোধ করছেন।

বাবার চোখের জল ও আগামী দিনের স্বপ্ন

এত কষ্টের পর রিফাদুল ইসলামের প্রাপ্তি কী? রিফাদুল বলেন, ‘বাবাকে জীবনে দুবার কাঁদিয়েছি। তবে তা দুঃখে নয়, সুখে। প্রথমবার এসএসসিতে জিপিএ–৫ পাওয়ার পর, আর দ্বিতীয়বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর। বাবাকে জড়িয়ে ধরে সেই কান্নাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।’

রিফাদুল ইসলাম আজ হাজারো শিক্ষার্থীর কাছে এক জীবন্ত উদাহরণ। তিনি প্রমাণ করেছেন, পকেটে টাকা না থাকলেও যদি বুকে অদম্য স্বপ্ন আর পিঠে কঠোর পরিশ্রমের ছাপ থাকে, তবে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করেও দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানো সম্ভব। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে নিজের গ্রামের অবহেলিত স্কুলের জন্য কাজ করতে চান এই অদম্য মেধাবী।