বাবার ডিপিএসের টাকায় ফ্রিল্যান্সিং শুরু শফিকুলের, এখন চালাচ্ছেন স্থানীয় স্পোর্টিং ক্লাব
যশোরের কাজীপাড়া মহল্লার এক মৎস্য ব্যবসায়ী বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন ছেলে বড় কিছু করবে। কিন্তু মধ্যবিত্তের সংসারে স্বপ্ন দেখা যতটা সহজ, তা বাস্তবায়ন করা ততটাই কঠিন। ২০১৬ সাল। সংসারে অভাব-অনটন থাকলেও ছেলের আবদার ফেলতে পারেননি বাবা নুরুল ইসলাম। নিজের শেষ সম্বল, তিলে তিলে জমানো ডিপিএস ভেঙে ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটি ল্যাপটপ কম্পিউটার। সেই ল্যাপটপ আর বাবার বিশ্বাসকে পুঁজি করেই শুরু হয়েছিল মো. শফিকুল ইসলামের জীবনযুদ্ধ।
আজ সেই শফিকুল ইসলাম কেবল সফল ফ্রিল্যান্সারই নন, তিনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। মাসে আয় করেন এক লাখ টাকার বেশি। নিজের উপার্জনের সিংহভাগ খরচ করে গড়ে তুলেছেন ‘কাজীপাড়া স্পোর্টিং ক্লাব’, যেখানে তিনি এলাকার তরুণদের দেখাচ্ছেন আলোর পথ। বর্তমানে ওয়েবসাইট ব্লগিং ও গুগল অ্যাডসেন্সের মাধ্যমে নিয়মিত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন শফিকুল ইসলাম।
ডিপিএস ভেঙে স্বপ্নের শুরু
সুজনের শুরুর পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। যশোর উপশহর কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর স্নাতক শ্রেণিতে পড়ার সময় ফ্রিল্যান্সিংয়ের পোকা মাথায় চাপে। বাবার ডিপিএস ভেঙে কিনে দেওয়া ল্যাপটপে রাতদিন এক করে খাটতেন। কিন্তু সফলতা যেন মরীচিকা। ২০১৬ থেকে ২০১৮—টানা তিন বছর শুধুই ব্যর্থতা। এর মধ্যেই ভালোবেসে বিয়ে করেন শামসুন্নাহারকে। কিন্তু বেকার ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দিতে নারাজ ছিলেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
শফিকুলের ভাষায়, ‘জীবনে সফলতা না থাকায় শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি। স্ত্রীকে এক কাপড়ে আমার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।’
এরপর আসে করোনা মহামারি। টিকে থাকার লড়াইয়ে দুই ছোট ভাইকে নিয়ে রেস্তোরাঁ ব্যবসা শুরু করেন, সেখানেও ব্যর্থতা। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে যখন দিশাহারা, তখন আবারও ঢাল হয়ে দাঁড়ান বাবা। বাবার সেই নিঃস্বার্থ ত্যাগের প্রতিদান দিতে সুজন মরিয়া হয়ে ওঠেন। গুগল অ্যাডসেন্স নিয়ে কাজ শুরু করেন, কিন্তু সেখানেও হোঁচট। যাদের তিনি কাজ শিখিয়েছিলেন, তাদের অ্যাকাউন্ট অ্যাপ্রুভ হলেও তাঁর নিজেরটা বারবার রিজেক্ট হতো। মানুষ তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করত, পাগল বলত। তবে আব্দুল্লাহ আল মুন্না ও আলামিন—এই দুই মেন্টরের প্রতি সুজন আজীবন কৃতজ্ঞ।
মেয়ের আগমনে ভাগ্যবদল
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর। সুজনের ঘর আলো করে আসে প্রথম সন্তান নুসাইবা শফিক। সুজন বিশ্বাস করেন, মেয়ের জন্মই ছিল তাঁর জীবনের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। মেয়ের জন্মের পরের মাসেই হাতে আসে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার বিশাল পেমেন্ট। যে সুজনকে একসময় কেউ গুনত না, সেই সুজনই হয়ে ওঠেন এলাকার সফল মুখ।
সুজন বলেন, ‘আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, বাস্তবতা বুঝি। তাই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, নিজের আয়ের একটা অংশ মানুষের জন্য খরচ করব।’
তারুণ্যকে বাঁচাতে খেলার মাঠের ডাক
নিজের জীবনের মোড় ঘোরার পর সুজন নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ছিল তাঁর অদম্য টান। এলাকার বড় ভাই সোহাগ, রনি, রুমন ও তুষারদের দেখতেন কাজীপাড়ার প্রতি গভীর ভালোবাসা লালন করতে। কিন্তু জীবিকার তাগিদে তাঁরা দূরে সরে গিয়েছিলেন। বড় ভাইদের সেই অপূর্ণ স্বপ্ন কাঁধে তুলে নেন শফিকুল।
মাদক ও খারাপ কাজ থেকে নতুন প্রজন্মকে বাঁচাতে ২০২৩ সালের বিজয় দিবসে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কাজীপাড়া স্পোর্টিং ক্লাব’। বর্তমানে ৭০ সদস্যের এই ক্লাবের কোনো বাহ্যিক বিনিয়োগকারী নেই। সুজন নিজের ফ্রিল্যান্সিং আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেন এই ক্লাবের পেছনে।
শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার এই উদ্যোগের পাশে দাঁড়িয়েছেন এলাকার ছোট ভাইয়েরা, যাদের আমি কাজ শিখিয়েছি তারা সবাই ফ্রিল্যান্সিং করছে। পাশাপাশি স্পোর্টিং ক্লাবের দেখাশোনা করে, খেলার আয়োজন করে। এই ছোট ভাইদের মধ্যে রয়েছে মাহফুজ, স্বজ্জন, শিমুল, চয়ন, ছামি, অন্ত, পারভেজ, নাফিজ ছামি, সুমন ছাড়া আরও অনেকে। ক্লাবের তরুণ খেলোয়াড় সাগর, আকাশ, আমান, মারুফরা এখন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
ভবিষ্যতের স্বপ্ন
দ্বিতীয় সন্তান মেসুত ওজিল আর মেয়ে নুসাইবাকে নিয়ে সুজনের ছোট্ট সংসার এখন শান্তিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের পরিধি এখন কাজীপাড়াজুড়ে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যদি একটি প্রজন্মকে ভালো রাখতে পারি, তবে তারা আগামী তিনটি প্রজন্মকে ভালো রাখবে। আমার মহল্লাকে আমি সারা বাংলাদেশে পরিচিত করতে চাই।’