অল্প বয়সে বিয়ে, ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়িয়ে ফ্রিল্যান্সার তানিয়ার মাসিক আয় লাখ টাকা

তানিয়া নাসরিনের এখন লক্ষ্য মেয়েদের নিয়ে কাজ করাছবি: তানিয়া নাসরিনের সৌজন্যে

মাত্র ১৪ বছর বয়স। যে বয়সে কিশোরীরা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে দুরন্তপনায় মেতে থাকে, সে বয়সেই বাল্যবিবাহের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল তানিয়া নাসরিনকে। অল্প বয়সে সংসারের ভার, এরপর কোলজুড়ে আসে এক ছেলে ও এক মেয়ে। পড়াশোনা শেষ করার আগেই সংসারে প্রবেশ করায় চাকরি করার কোনো যোগ্যতা বা সুযোগ কোনোটাই ছিল না তাঁর। এর মধ্যেই সংসারে শুরু হয় তীব্র অর্থনৈতিক টানাপোড়েন।

সাধারণ কোনো গল্প হলে এখানেই হয়তো সমাপ্তি ঘটত। কিন্তু তানিয়া নাসরিন হার মানতে নারাজ। সেই কঠিন সময় পাড়ি দিয়ে তানিয়া আজ একজন সফল ডিজিটাল ডিজাইনার। মাসে আয় করছেন হাজার ডলারের বেশি। একজন গৃহিণী থেকে শুরু করলেন, তারপর পড়াশোনা শেষ করে হলেন সফল ফ্রিল্যান্সার। তানিয়া নাসরিনের এই যাত্রাপথ কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না।

ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

তানিয়া নাসরিনের বাবা আবদুল খালেক ছিলেন একজন প্রবাসী, থাকতেন দুবাইয়ে। মা রাশেদা বেগম, গৃহিণী। ২০০১ সালে প্রবাসেই তাঁর বাবার ক্যানসার ধরা পড়ে। তখনই শুরু হয় তানিয়ার বিয়ে নিয়ে আলোচনা। সেই অল্প বয়সেই মেয়েকে বিয়ে দিতে হয়। বিয়ের দেড় মাস পর তানিয়ার বাবা মারা যান।

বাবাহারা অল্প বয়সি মেয়ের জীবনে আসে শূন্যতা। তানিয়ার স্বামীর নাম জাহিদ হাসান, পেশায় একজন ব্যাবসায়ী। জাহিদ তানিয়াকে বললেন, ‘তুমি চাইলে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারো।’ তখন ২০০২ সাল প্রথম সন্তান জেবা ফারিহা এসেছে ঘরে। সেভাবে পড়াশোনাই আর করতে পারেননি। সংসারে ব্যস্ত সময় কাটে তানিয়ার।

২০০৭ সালেই সংসারে আসে দ্বিতীয় সন্তান জুবায়ের আহম্মেদ। সে বছরেই তানিয়া আবিষ্কার করেন নিজেকে। সন্তান মানুষ করার পাশাপাশি নিজেকে কিছু করতে হবে। আর কিছু করতে গেলে পড়াশোনাটা আগে শুরু করতে হবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। যেহেতু স্বামীর বাসা ঢাকার লালবাগ, সেখানেই ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে তানিয়া ভর্তি হন। এরপর সংসার, বাচ্চা সামলানো আর পড়াশোনা।এরপর ভর্তি হন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচএসসি প্রোগ্রামে। এইচএসসি পাস করে শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্টগ্র্যাজুয়েট কলেজ থেকে বিবিএ শেষ করেন। তানিয়ার গ্রামের বাড়ি ঢাকার দোহার উপজেলায়। দুই ভাই ও দুই বোন। তিনিই সবার ছোট ছোট।

সংসারের অভাব-অনটনের দিনগুলোতে তানিয়া খুঁজছিলেন এমন কোনো পথ, যা তাঁকে ঘরের বাইরে না গিয়েও আয়ের সুযোগ দেবে। একদিন এক বান্ধবীর ভাবির কাছ থেকে জানতে পারেন গ্রাফিক ডিজাইনের কথা। জানতে পারেন, এ কাজ শিখে ঘরে বসেই সম্মানজনক আয় করা সম্ভব। সেই ভাবি নিজেও তখন ঘরে বসে ভালো আয় করছিলেন। অন্যের সাফল্য দেখে নিজের মনেও সাহস সঞ্চার করেন তানিয়া। সংকল্প করেন তিনিও পারবেন।

তানিয়া নাসরিন মনে করেন, বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়
ছবি: তানিয়া নাসরিনের সৌজন্যে

দক্ষতা অর্জনের লড়াই

সিদ্ধান্ত নিলেন শেখার। ভর্তি হলেন ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউট নামের একটা প্রতিষ্ঠানে, সেখানেও পেলেন ৫০ শতাংশ ছাড়। শুরু হলো গ্রাফিক ডিজাইন শেখার যাত্রা। তবে শুরুর দিকটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। তানিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরুতে বুঝতে পারছিলাম, আমি খুব বেশি কিছু জানি না, আমার ডিজাইন দক্ষতাও তেমন ছিল না। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আমার এ যাত্রায় বড় ভূমিকা রাখেন প্রশিক্ষক হাফিজ স্যার। শিক্ষকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়াতে থাকি। বেসিক কোর্স শেষ করার পর আমার মেধা ও আগ্রহ দেখে হাফিজ স্যার আমাকে অ্যাডভান্স গ্রাফিক ডিজাইন কোর্সে ১০০ শতাংশ বৃত্তিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দেন। সফলভাবে সেই কোর্স শেষ করে আমি ক্রিয়েটিভ আইটিতেই ৩ মাসের একটি শিক্ষানবিশি করার সুযোগ পাই, যা আমার ক্যারিয়ারের ভিত্তি মজবুত করে দেয়।’

থেমে থাকেননি তানিয়া

গ্রাফিক ডিজাইন দিয়ে আয়ের শুরু হলেও তানিয়া নিজেকে সেখানেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়েই তিনি শিখতে শুরু করেন মোশন ডিজাইন। এরপর নজর দেন সময়ের জনপ্রিয় দক্ষতা ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের দিকে। সেখানে হাসান স্যারের তত্ত্বাবধানে তিনি এই নতুন বিষয়গুলো আয়ত্ত করেন এবং নিজেকে একজন পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ডিজাইনার হিসেবে গড়ে তোলেন।

তানিয়া নাসরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। তখন তিনি ক্যানসারের যন্ত্রণায় ভুগছিলেন, আর আমার দুই ভাই বেকার। পরিবারের সব দায়িত্ব যেন বাবার একাই নিতে হতো। বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু তার স্বামীও ছিল বেকার। সংসারের চাপ, মানুষের কথা আর টানাপোড়েন মিলিয়ে বাবা ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। এই অবস্থায় শুধু সমাজের চোখে সম্মান রাখার জন্য আমাকে মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাধ্য হয়ে গ্রামের একটি নামকরা বাড়িতে বিয়ে দিতে হয়। বাবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু পরিস্থিতি তাকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল।’

তানিয়া নাসরিন
ছবি: তানিয়া নাসরিনের সৌজন্যে

বর্তমান সাফল্য ও তুমি নারী তুমিও পারবে

একসময় যে তানিয়া সংসারের খরচ নিয়ে চিন্তিত থাকতেন, আজ তিনি অ্যাডোবি স্টক, শাটারস্টক এবং ফাইভআরের মতো আন্তর্জাতিক বাজারে (মার্কেটপ্লেস) দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। প্যাসিভ ও অ্যাক্টিভ মার্কেটপ্লেস মিলিয়ে বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় এক হাজার ডলারের (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা) বেশি।

নিজের এই সাফল্য নিয়ে তানিয়া নাসরিন বলেন, ‘ডিজিটাল ডিজাইনের জগতে নিজের জায়গা তৈরি করতে পেরেছি। পরিবার নিয়ে এখন বেশ ভালো আছি। বয়স বা পরিস্থিতি কোনো বাধা নয়। বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়। প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর সঠিক গাইডলাইন থাকলে ঘরের কোণ থেকেও বিশ্বজয় করা সম্ভব। আমার মেয়ে স্নাতক শ্রেণিতে পড়তে এখন জাপান যাচ্ছে, ছেলেকেও কিছুদিনের মধ্যে পড়াশোনা করতে বাইরে পাঠিয়ে দেব। এরপর আমি আমার কাজ পুরো দমে করতে পারব। আমি নারীদের নিয়ে কাজ করতে চাই।’