বদিউজ্জামানের জন্ম টাঙ্গাইলের একটি গ্রামে। যেখানে এখনো ইন্টারনেট সংযোগ যায়নি। ভাদুরীর চর নামের গোপালপুর উপজেলার সেই প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে উঠেছেন তিনি। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হবে। তবে সেটা হয়নি। ২০০৯ সালে ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দমোহন কলেজ থেকে হিসাবরক্ষণে স্নাতক হয়ে একই কলেজে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন বদিউজ্জামান। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১২ সালে বদিউজ্জামান একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে বিক্রয় প্রতিনিধি (মেডিকেল ইনফরমেশন অফিসার) হিসেবে যোগ দেন। ছয় বছর এই চাকরি করার পর ২০১৮ সালের শেষ দিকে ফেসবুক থেকে অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং অর্থাৎ আউটসোর্সিং সম্পর্কে জানতে পারেন। শুরু হয় নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখা।
ময়মনসিংহে কোথায় ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিভিন্ন বিষয় শেখা যায়, তা খুঁজতে থাকেন বদিউজ্জামান। খুঁজে পেলেন নকরেক আইটি ইনস্টিটিউট। সেখানে ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিকস ডিজাইন এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য কোর্স শেখানো হয়।
এরপর বদিউজ্জামান নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠতা সুবীর নকরেকের সঙ্গে কথা বলেন। এক সহকর্মীসহ বদিউজ্জামান এখানে ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্সে ভতি হন। সেই থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শেখা শুরু হয় বদিউজ্জামানের।
একদিকে চাকরি আর একদিকে ফ্রিল্যান্সিং—চাপে পড়তে হয় বদিউজ্জামানকে। তিনি বলেন, ‘যদি অফিস জানতে পারে যে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করি, তাহলে চাকরিটাই যাবে। তাই অফিসের কাজ সারা দিন ঠিকঠাক করে রাতে এসে ফ্রিল্যান্সিং করতাম।’
বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজেকেই বিশ্বাস করাতে শুরু করলাম যে তথ্যপ্রযুক্তির আউটসোর্সিং খাতে ভালো কিছু করতে হবে আমাকে। যদিও প্রথম দিকে কাজ শেখা এবং কাজ বুঝে করাটা আমার জন্য অনেক কষ্টেরই ছিল। আমি বরাবরই পেছনের সারির ছাত্র ছিলাম। যে ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতাম সেখানে আসলে ভবিষ্যৎ কি—তা বুঝতেই পারতাম না। হতাশার মধ্যেই চাকরিটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।’ কারণ, সকাল নয়টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো বদিউজ্জামানকে। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিয়তায় ভুগতেন। চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শিখতে থাকেন।
বদিউজ্জামান বলেন, ‘২০১৯ সালের পুরোটাই দিনরাত পরিশ্রম করার পর অনলাইন মার্কেটপ্লেস (আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া–নেওয়ার অনলাইন বাজার) থেকে প্রথমে ১০ ডলারের একটি অর্ডার পাই। এরপর থেকেই একের পর এক কাজ পেতে থাকি। ২০২০ সালে অফিস জানতে পারে, আমি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করছি। তখন বিষয়টি একটু সামাল দিলেও ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে বদিউজ্জামান চাকরি ছেড়ে দেন।
জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ীতে বদিউজ্জামানের শ্বশুরবাড়ি। এখানে জমিও কিনেছেন তিনি। সরিষাবাড়ির স্টেশন রোডে নিজের বাড়িতে বসে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, পর্তুগাল, সুইজারল্যান্ডসহ নানা দেশের গ্রাহকদের সঙ্গে কাজ করেন বদিউজ্জামান। তিনি এখন কানাডার একটি নেটওয়ার্কিং সাইটের সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়মিত কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ডিজিটাল বিপণন এজেন্সির দলনেতাও তিনি। মার্কেটপ্লেস এবং মার্কেটপ্লেসের বাইরে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় পাঁচজনকে তাঁর দলে নিয়েছেন। তাঁরা ভার্চ্যুয়ালি, মানে অন্য জায়গা থেকে অনলাইনে কাজ করেন। বর্তমানে ফাইভআর ও আপওয়ার্ক মার্কেটপ্লেসে সফলতার সঙ্গেই কাজ করছেন বদিউজ্জামান ও তাঁর দল। এই দল নিয়ে ডিজিটাল বিপণনের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন তিনি। নাম দিয়েছেন বঙ্গ আইটি ইনস্টিটিউট।
বদিউজ্জামান বলেন, এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে আমার বিশ্বাস ও পরিশ্রমের কারণে। সফল হতে আমি হাজারো নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। আমি সব সময় আমার পরিবারকে পাশে পেয়েছি। তাঁরা আমাকে উৎসাহ দিতেন। স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে কাজ করতে পারছি, এটাই বড় কথা। আর নিজেকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগও পেয়েছি। কাজে কিছুটা চাপ থাকলেও যখন পারিশ্রমিক (পেমেন্ট) পাই এবং গ্রাহকের ভালো ভালো পর্যালোচনা পাই, তখন সব কষ্ট ভুলে যাই।
এখন সব মিলিয়ে বদিউজ্জামান মাসে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ডলার আয় করছেন। বদিউজ্জামান প্রতিনিয়ত তাঁর দক্ষতা বাড়াতে নতুন নতুন ও হালনাগাদ বিভিন্ন বিষয়ের কোর্স করেছেন। তিনি মনে করেন, এই খাতে ভালো কিছু করতে হলে অবশ্যই নিজের দক্ষতা বাড়াতে হবে, নিজেকেও হালনাগাদ থাকতে হবে।
২০১৩ সালে বিয়ে করেন বদিউজ্জামান। স্ত্রী ইসরাত জাহান এবং সাত বছর বয়সী আবদুল্লাহ আল–আয়ানকে নিয়ে তাঁর সংসার।
ভবিষ্যতে বদিউজ্জামান ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছেন। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। দলের ভার্চ্যুয়াল সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে বিদেশের গ্রাহকদের কাজ করছেন। এই কাজের পরিসর আরও বাড়াতে চান।