তরিকুল–শাহজাবিন দম্পতির জুতার উদ্যোগ, বার্ষিক লেনদেন ৮ কোটি টাকা
স্ত্রী শাহজাবিন হকের জমানো ৯০ হাজার টাকা দিয়ে দুজন মিলে ই–কমার্স ব্যবসা শুরু করেছিলেন তরিকুল ইসলাম। দুজনই চাকরি ছেড়ে শুরু করেন জুতার ব্যবসা, নাম জুকো। অনলাইনের পাশাপাশি এখন দুটি শাখাও আছে। এখন ৯০ কর্মী কাজ করেন তরিকুল–শাহজাবিন দম্পতির উদ্যোগে। জুকোর বার্ষিক লেনদেন (টার্নওভার) এখন প্রায় আট কোটি টাকা।
ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু
শিক্ষক দম্পতি প্রয়াত শহিদুল ইসলাম ও লুৎফুন্নেসার ছেলে তরিকুল ইসলাম। পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার পুরানদারপুর গ্রামে জন্ম। ঢাকার সরকারি বাঙলা কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষে ২০১৫ সালে নর্দান ইউনিভার্সিটি থেকে বিপণন বিষয়ে এমবিএ ডিগ্রি নেন। একটি কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানে চাকরির কারণে ২০১৭ সাল থেকে ই–কমার্স খাত সম্পর্কে তাঁর ভালো জানাশোনা তৈরি হয়। ২০১৯ সালে ছোট্ট একটি ই–কমার্স সাইটে চাকরি শুরু করেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটি শুধু টি–শার্ট বিক্রয় করত। সেখানকার অপারেশন হেড ছিলেন তরিকুল ইসলাম।
আগেও একাধিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন তরিকুল। তখনো নতুন কিছু করার তাগিদ অনুভব করতেন। স্বপ্ন ছিল নিজে একটা কিছু করবেন আর সেটা হবে ব্যবসা। কিন্তু কোন ব্যবসা করবেন, তা তো অজানা। যেহেতু ই–কমার্স ব্যবসাটা তরিকুলের ভালো জানা, তাই তিনি মনে মনে ভাবতে থাকেন, এটাই শুরু করবেন ভালোভাবে।
এসব ভাবতে ভাবতেই বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। এর মধ্যে হানা দেয় করোনা মহামারি। টি–শার্টের প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পুরো ২০২০ সাল বাসায় বসে কাটাতে হয় তরিকুল ইসলামকে। এ সময় তরিকুলকে আর্থিক ও মানসিক সমর্থন দেন তাঁর স্ত্রী শাহজাবিন হক।
হতাশ তরিকুল
শাহজাবিন হকেরও বাড়ি পাবনায়। যন্ত্র প্রকৌশলী শহিদুল হক ও গৃহিণী রাবেয়া খাতুনের মেয়ে তিনি। ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে পুরকৌশলে বিএসসি ডিগ্রি নিয়ে শাহজাবিন হক যোগ দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে। স্ত্রীর বেতনেই কোনোরকমে কেটে যায় করোনা মহামারির দিনগুলো। সংসারে কোনো অবদান রাখতে না পারায় ক্রমেই হতাশা চেপে ধরে তরিকুলকে।
২০২১ সালে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার দশা হলো এই দম্পতির। শাহজাবিন হকের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে সে বছরের নভেম্বরে। আবার অন্য প্রকল্পে ঢুকতে হবে। তা–ও কীভাবে কী হবে, পুরোপুরি নিশ্চিত নন। ফলে তিনি তরিকুল ইসলামকে প্রস্তাব দেন দুজন মিলে ব্যবসা শুরু করার। তরিকুলও তো তা–ই ভাবছিলেন। শুধু ভেবে পাচ্ছিলেন না, কী দিয়ে শুরু করবেন। তখনই হুট করে মাথায় এল অনলাইনে জুতার ব্যবসার কথা। স্ত্রীকে তিনি জানান নিজের চিন্তার কথা। শাহজাবিনও রাজি। নিজের জমানো ৯০ হাজার টাকা তুলে দিলেন স্বামীর হাতে। ওই সম্বলটুকু নিয়ে দুজন নেমে পড়লেন ব্যবসায়ে।
তত দিনে তরিকুল যে ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, সেটি আবার চালু হয়েছে। শুরুর দিকে চাকরিটা একদম ছেড়ে না দিয়ে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। অফিস শেষ করে রাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে চলে যেতেন। সেখানে গিয়ে একেক দিন একেকটি জুতার দোকানের মালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। প্রস্তাব দেন, তিনি তাঁদের দোকানের জুতার ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে বিক্রি করবেন। যদি অর্ডার পান, তাহলে টাকা দিয়ে জুতা কিনে ক্রেতাকে পাঠাবেন। প্রায় ৩০টির মতো দোকানে কথা বলেছিলেন তিনি। এর মধ্যে ২৮টি দোকান থেকে খালি হাতে ফিরে আসতে হয় তাঁকে। দুটি দোকান রাজি হলো। অনুমতি মিলল ছবি তোলার।
ছবি তুলে তুলে জুতা বিক্রি
তরিকুল ইসলাম তখন ছবি তুলে তুলে ফেসবুকে প্রকাশ করে জুতা বিক্রি করতে থাকেন। শুরুর দিকে দিনে দুই থেকে তিন জোড়া জুতা বিক্রি হওয়া শুরু হলো। সে সময় ডিজিটাল বিপণন নিয়ে কাজ করতেন রাশেদুল হাসান। তাঁর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করেন তরিকুল। রাশেদুল তাঁকে জানান, তাঁর ওয়েবসাইট বানানো থেকে শুরু করে সব তিনি ফ্রিতেই করে দেবেন। তবে বিপণনের জন্য যে খরচ, সেটা তরিকুলকেই বহন করতে হবে।
রাশেদুল হাসানের এই প্রস্তাব তরিকুল ইসলামকে আলোড়িত করে। সাহস বাড়িয়ে দেয়। রাশেদুলের ভরসায় তিনি ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ চালু করেন। ধীরে ধীরে জুতার নিয়মিত বিক্রিও বাড়ছিল। দুই–তিন জোড়া থেকে প্রতিদিনের জুতা বিক্রি দাঁড়াল ১৫ জোড়ায়। তখনই তরিকুল ইসলামের মাথায় আসে নিজস্ব ব্র্যান্ড বানানোর চিন্তা। তৎক্ষণাৎ একটি নামও ঠিক করেন—জুকো। স্ত্রী শাহজাবিন বাসায় বসে অর্ডার নিতেন, আর তরিকুল ঘুরতেন বাজারে। রাতে বাসায় ফিরে দুজন মিলে প্যাকেজিং করতেন। ধীরে ধীরে বিক্রি আরও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে চাপও। স্ত্রী শাহজাবিন তখন বলেন, আরও অন্তত দুজন কর্মী প্রয়োজন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুজন মেয়ে যুক্ত হলেন তাঁদের সঙ্গে। প্যাকেজিংয়ের পাশাপাশি ক্রেতার সঙ্গে কথা বলার কাজ করতেন তাঁরা।
অবশেষে নিজের ব্র্যান্ড
তখনো তরিকুল ইসলাম এলিফ্যান্ট রোডের জুতার দোকানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সেই জুতাগুলো ছিল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে। ফলে নিজের প্রতিষ্ঠান জুকোর নাম ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছিলেন না। তখন তিনি জানার চেষ্টা করতে থাকেন, এলিফ্যান্ট রোডের জুতার দোকানগুলো কোথা থেকে জুতা আনে। ঘুরতে ঘুরতে এক ব্যক্তিকে দেখতে পান—লুঙ্গি পরে কাঁধে ২৪ জোড়া জুতা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁকে দাঁড় করান তরিকুল। পরিচিত হন। জুতা বানানোর কারখানার খোঁজ জানতে চান তাঁর কাছে।
সেই ব্যক্তির নাম রবিউল ইসলাম। রবিউল তাঁকে জানান, তিনি নিজেই জুতা বানান। তাঁর নিজের ছোট একটা কারখানা আছে। তখন তরিকুল তাঁকে সব খুলে বলেন। সব শুনে তিনি প্রস্তাব দেন, তরিকুল যদি তাঁকে নিজের চাহিদা জানান, তাহলে তিনি সেইমতো জুতা বানিয়ে দিতে পারবেন।
তরিকুল ইসলাম ভাবতে থাকেন, কোন মডেলের জুতা চলতে পারে। সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইসলামপুরে গিয়ে ২০ গজের মতো কর্ড কাপড় কেনেন তরিকুল। সেই কাপড় নিয়ে চলে যান রবিউল ইসলামের জুতার কারখানায়। ওই কাপড় দিয়েই জুতা তৈরি করে দিতে বলেন।
কিন্তু রবিউল ইসলাম জানান, এটা চলবে না। এভাবে হয় নাকি? তরিকুলকে তিনি এই চিন্তা বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেন। তবে তরিকুল নাছোড়বান্দা। রবিউল ইসলামকে তিনি এই কাপড় দিয়েই জুতা বানিয়ে দেওয়ার জেদ ধরেন।
তরিকুলের চাহিদামতো কর্ড কাপড় দিয়েই ১০ জোড়া জুতা বানিয়ে দেন রবিউল। সেই জুতার ছবি নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট করেন তরিকুল ইসলাম। কোনো বিজ্ঞাপন ছাড়াই এক ঘণ্টায় সব জুতা বিক্রি হয়ে যায়। এরপরই শুরু হলো তরিকুলের সফলতার গল্প। ইসলামপুর থেকে নতুন নতুন কাপড় কিনে সেগুলো দিয়ে জুতা বানাতে শুরু করলেন তিনি। বাড়িয়ে দিলেন উৎপাদন।
চার মাসের মাথায় ২০২২ সালের মার্চে নিজের একটি অফিস নেন তরিকুল। ওয়্যারহাউসও নেন। শুরু হয় নতুন নতুন জুতা তৈরি। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বিক্রি। তরিকুল ইসলাম ও শাহজাবিন হক লোকও বাড়াতে থাকেন তাঁদের প্রতিষ্ঠানে।
কিন্তু এর মধ্যে একদিন জুতা কারখানার মালিক রবিউল ইসলাম আসেন তরিকুলের কাছে। তিনি জানান, বিভিন্ন জায়গায় তাঁর টাকা আটকে আছে। ফলে তাঁর পক্ষে কারখানাটা চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়। বন্ধ করে দিতে হবে। তরিকুল তাঁকে বলেন, এটা বন্ধ না করে তিনি যেন তরিকুলের কাজগুলো করেন। রাজি হয়ে যান রবিউল ইসলাম।
শুরু হলো তরিকুলের প্রতিষ্ঠানের নতুন নতুন ডিজাইনের জুতা উৎপাদন। নকশাগুলো তরিকুল নিজেই করে দেন। তাঁদের প্রতিষ্ঠানে এখন ৯০ জনের মতো কর্মী কাজ করেন। ধানমন্ডি ও বনানী–১০ নম্বরে নিজের ব্র্যান্ডের দুটি শাখা চালু করেছেন।
স্বামী–স্ত্রীর উদ্যোগ
তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী শাহজাবিন হক জুকো ব্র্যান্ডের সহপ্রতিষ্ঠাতা। তিনি আমাকে সব সময় সমর্থন দিয়েছেন, সময় ও শ্রম দিয়েছেন। তাঁর কারণেই আজ আমাদের প্রতিষ্ঠান এই অবস্থানে এসেছে। আসলে আমরা দুজন শুধু স্বপ্ন দেখে বসে থাকিনি। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা দিনরাত পরিশ্রম করেছি, চেষ্টা করে গেছি। সেই চেষ্টায় এত দূর এসেছি।’ তরিকুল জানান, সামনে আরও দুটি শাখা খোলার ইচ্ছা আছে তাঁদের।
শাহজাবিন হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আমাদের ব্র্যান্ডকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যেখানে বাটা ও এপেক্সের মতো অন্য বড় বড় ব্র্যান্ডের সঙ্গে আমাদের জুকো নামটা মনে রাখবে। আমরা সামনে বাচ্চাদের, মেয়েদের ও বৃদ্ধদের জন্য বিভিন্ন পণ্য তৈরি করব।’
প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় নিজেদের জুকোর শাখা খোলার পরিকল্পনা আছে তরিকুল ও শাহজাবিন হকের। যাতে তাঁদের ব্র্যান্ডের জুতা সহজেই কিনতে পারেন ক্রেতারা।