২০ বছরে ফেসবুক যেভাবে ৩০০ কোটির বেশি ব্যবহারকারীর সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ২০ বছরে পা দিয়েছে। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯ বছরের তরুণ মার্ক জাকারবার্গ এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও চার ছাত্র এদুয়ার্দো স্যাভেরিন, অ্যান্ড্রু ম্যাকলাম, ডাস্টিন মস্কোভিৎজ ও ক্রিস হিউস তৈরি করেন ‘দ্য ফেসবুক’। তাঁরা সবাই হার্ভার্ডে একই কক্ষে থাকতেন। সেই সময় সবেমাত্র ডায়াল-আপ ইন্টারনেটের বদলে দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট জনপ্রিয় হচ্ছিল। একই সঙ্গে ফোনেও মিলছিল রঙিন পর্দা। এরপর ২০ বছর পেরিয়ে সেই সময়ের দ্য ফেসবুক হয়ে উঠেছে আজকের মেটা। বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করা সেই ফেসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানে ৩০৩ কোটির বেশি।
ফেসবুকের নামকরণের পেছনে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘স্টুডেন্ট ডিরেক্টরি’র সম্পর্ক রয়েছে। সে সময় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবর্ষ শুরুর সময় শিক্ষার্থীদের যে ডিরেক্টরি দেওয়া হতো, তার নাম ছিল ‘ফেস বুক’। সেই নাম থেকেই ‘দ্য ফেসবুক’ নামকরণ হয়। চালুর কয়েক বছরের মধ্যেই জনপ্রিয় হতে শুরু করে প্ল্যাটফর্মটি।
শুরুর সময়ের কথা: ছিল বিতর্কও
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের তথ্য জানাতে ‘ফেসম্যাশ’ নামের একটি ওয়েবসাইট চালু করেন মার্ক জাকারবার্গ। ওয়েবসাইটটিতে নারী শিক্ষার্থীদের ছবি যুক্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাব্যবস্থা হ্যাকও করেন তিনি। অনুমতি ছাড়াই শিক্ষার্থীদের ছবি সংগ্রহ করে ওয়েবসাইটে ব্যবহার করায় বিতর্কের মুখে ওয়েবসাইটটি বন্ধ করতে বাধ্য হন জাকারবার্গ। এমনকি শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য শাস্তিমূলক পদক্ষেপও নেওয়া হয় তাঁর বিরুদ্ধে। এর কয়েক মাস পর ফেসম্যাশের আদলে সহপাঠীদের নিয়ে ‘দ্য ফেসবুক’ চালু করেন জাকারবার্গ। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেইল দিয়ে শিক্ষার্থীরা একে–অপরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারতেন। এরপর হার্ভার্ডের গণ্ডি পেরিয়ে মার্কিন মুলুকের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়ে ওয়েবসাইটটি।
ফেসবুক থেকে মেটা
চালু হওয়ার এক বছর পরই ২০০৫ সালে দ্য ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ লাখ। এরপর নতুন করে নাম দেওয়া হয় ‘ফেসবুক ডটকম’। ২০০৬ সালের শেষ নাগাদ ১৩ বছরের বেশি বয়সী সবার জন্য প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহারের সুযোগ চালু করা হয়। ফলে ২০০৬ সালের মধ্যেই ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ২০ লাখ। ২০০৭ সালে ৫ কোটি ব্যবহারকারী যুক্ত হয় ফেসবুকে। পরের বছর ২০০৮ সালে ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি। ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো শতকোটি ব্যবহারকারীর মাইলফলক স্পর্শ করে ফেসবুক। তখন এর বাজারমূল্য দাঁড়ায় ১০ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতি শেয়ারের দাম ৩৮ ডলার ধরে আইপিও ছেড়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার সংগ্রহ করে ফেসবুক। বর্তমানে ফেসবুকের শেয়ারের দাম ৪৭৪ মার্কিন ডলার। ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর ফেসবুকের করপোরেট নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মেটা’। বর্তমানে মেটার মালিকানায় ফেসবুক ছাড়াও ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, থ্রেডসসহ আরও বেশ কিছু অ্যাপ রয়েছে।
ফেসবুকের পরিসর কত বড়
বর্তমানে প্রতি মাসে ৩০৩ কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছেন ফেসবুকের, যা বিশ্বের মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর অর্ধেকের চেয়ে বেশি এবং বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। বর্তমানে ভারতে সবচেয়ে বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন। এরপরই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল ও মেক্সিকোতে।
কোন বয়সীরা ফেসবুক বেশি ব্যবহার করেন
অনলাইন রেফারেন্স লাইব্রেরি ডেটাপেট্রলের তথ্যমতে, ফেসবুক সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীরা, যা ফেসবুকের মোট ব্যবহারকারীর ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ। এরপর বেশি ফেসবুক ব্যবহার করেন ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা (২১ দশমিক ৫ শতাংশ), ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সীরা (১৯ দশমিক ৪ শতাংশ), ৪৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সীরা (১১ দশমিক ৬ শতাংশ) ও ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সীরা (৭ দশমিক ৩ শতাংশ)। এসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, অপেক্ষাকৃত কম এবং বেশি বয়সীরা ফেসবুক ব্যবহারে কম আগ্রহী।
তথ্য সুরক্ষা ও গ্রাহকের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে বিতর্ক
২০ বছরের এই দীর্ঘ পথচলায় তথ্য সুরক্ষা ও গ্রাহকের অনলাইন নিরাপত্তা নিয়ে মাঝেমধ্যেই সমস্যায় পড়েছে ফেসবুক। এর পাশাপাশি বাজারে একাধিপত্য, মিথ্যা তথ্যের প্রসার, তথ্য ফাঁসসহ নানা কেলেঙ্কারির কারণে বিশ্বের নানা দেশে চাপের মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল তথ্য বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। ভোটারদের তথ্য বিশ্লেষণের জন্য ফেসবুকের কোটি কোটি ব্যবহারকারীর প্রোফাইল থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ওই কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৮ কোটি ৭০ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য বেহাত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
সূত্র: আল-জাজিরা