পম্পেই নগরে কি পিৎজা তৈরি হতো

দেয়ালে পিজ্জাসদৃশ্য ছবি দেখে পিজ্জার সন্ধান পাওয়া গেছে বলে ভুল অনুমান করেন দর্শনার্থীরা,
ছবি: টনি জোলাইফ/বিবিসি

ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংস হয়ে যায় ইতালির পম্পেই নগরী। খ্রিষ্টপূর্ব ৭৯ সালে ইতিহাস কাঁপানো সেই দুর্যোগে ১৫ হাজারের বেশি মানুষের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময় রোমের সম্রাট ছিলেন টাইটাস। অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংস হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে কেমন ছিল সেই পম্পেই নগরীরর জীবনযাত্রা, তা অনেক বছর ধরে মানুষের আগ্রহের বিষয়। নতুন করে পম্পেইকে জানতে কয়েক বছর ধরে খননকাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। এমনই খননের সংবাদ জানিয়েছে পম্পেই আর্কিওলজিক্যাল পার্ক কর্তৃপক্ষ। এবারে একটি রান্নাঘর, বেকারি, মানুষের কঙ্কাল, ম্যুরাল, পেইন্টিং, পিৎজার আদিরূপ হারিয়ে যাওয়ার রোমান দুনিয়ার নানান অনুষঙ্গের সন্ধান পেয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা।

পম্পেইতে নগরী পঞ্চাশটির মত বেকারি পাওয়া গেছে, যেখানে দেখা যায় এমন বিশাল বিশাল ওভেন
ছবি: জোনাথান এমোস/বিবিসি

পম্পেই আর্কিওলজিক্যাল পার্কে এই খননকাজ পরিচালনা করা হয়। ভায়া ডি নোলা নামের প্রধান সড়কে এবারে গভীরভাবে খননকাজ চালানো হয়েছে। একই জায়গায় গত শতাব্দীতে শেষ খননকাজ চালানো হয়। সেবার শুধু একটি লন্ড্রির সন্ধান পেয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। এবারের অনুসন্ধানে সবাই আরও বিস্মিত হচ্ছেন। ৩২ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে খনন করা হয় এবার।

ইউরোপে জুন মাসের গরমের মধ্যে অনেক ধৈর্য নিয়ে কাজ করেছেন অনুসন্ধানকারীরা। আগ্নেয়গিরির ছাই আর ল্যাপিলি নামের ছোট ছোট পাথর সরিয়ে অনেক কিছু খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা। দুই হাজার বছর আগের সেই অগ্ন্যুৎপাতের ছাপ এখনো বোঝা যায়। দুই দিনের সেই প্রলয় এখনো এখানে সেখানে প্রমাণ রেখে গেছে।

খননে বিশাল এক ওভেনের সন্ধান পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এখানে প্রতিদিন ১০০ টুকরা করে রুটি বা ব্রেড তৈরি করা হয়। একই খননকাজ থেকে লন্ড্রি, পুড়ে যাওয়া বিছানা, ওয়ালপেপার, ঝরনা, ওভেন, পিৎজার মতো দেখতে দেয়ালচিত্র, মন্দিরের স্থাপনার খোঁজ পাওয়া গেছে।  

খননকারী দলের সদস্য জেন্নারো আওভিনো জানান, ‘পম্পেই শহরের প্রতিটি ঘরেই যেন গল্প ছড়িয়ে আছে। আমরা এই ঘরের গল্পগুলোই খুঁজে বের করতে চাই।’

আওভিনো ও তাঁর দল খননের মাধ্যমে সুরম্য এক বাড়ির সন্ধান পেয়েছেন। তাঁর ধারণা, অগ্ন্যুৎপাতের সময় সেখানে কোনো মেরামতের কাজ চলছিল বলে বাড়ির অনেক টাইলস যত্ন করে একসঙ্গে রাখা হয়। বাড়ির সঙ্গেই দেখা মেলে একক ওভেনের।

পম্পেইতে এর আগে প্রায় ৫০টির মতো বেকারির সন্ধান পাওয়া গেছে। যদিও এই বাড়ির সামনে কোনো দোকান নেই বলে ওভেনের বাড়িটিকে এখনকার কারখানা হিসেবে মনে করছেন খননকারীরা। ফাস্টফুড খাওয়ার জন্য পম্পেই যে বিখ্যাত ছিল তারই প্রমাণ বলা যায় এই ওভেন।

পিৎজার মতো দেখতে আরেকটি ছবি দেখে সবাই আলোড়িত হয়েছেন। কেনইবা হবেন না—পিৎজ্জার সঙ্গে ডালিম, বাদাম, খেজুরসহ নানান ফলের ছবি দেখেছেন তাঁরা। যদিও গবেষকেরা বলছেন, এটা পিৎজার ছবি না। কেননা, খ্রিষ্টের জন্মের আগের শতকে ইউরোপে টমেটো ও চিজ পাওয়া যেত না। টমেটো ও চিজ ছাড়া তো আর পিৎজা হয় না। পম্পেইয়ের কাছের শহর নেপলসে পিৎজার জন্ম দেখে সবার কল্পনার ঘোড়া একটু বেশিই দৌড়ায় যায় বলে জেন্নারোর ভাবনা। জেন্নারো বলেন, প্রথমে ওভেন পেয়েছি আমরা, এবারে পিৎজা। এই পিৎজাসদৃশ ছবি দেখার জন্য প্রতিদিন পম্পেইতে প্রায় ২০ হাজার দর্শনার্থী আসছেন। আদি পিৎজা দেখার ভিড় বাড়ছে প্রতিদিন।

এ ছাড়া মানুষের কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া গেছে। এখনো গবেষকেরা নিশ্চত নন, সেই সময় কত মানুষ ছাইচাপা পড়েছিলেন। অগ্ন্যুৎপাতের শুরু দেখে অনেকেই শহর ছেড়ে চলে যান বলে সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি। প্রায় দেড় হাজার কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া গেছে, নতুন করে দুজন নারী ও একজন শিশুর কঙ্কালের সন্ধান মিলেছে।

কঙ্কালগুলোর দৈহিক অবস্থান বলছে, তাঁরা সিড়ির মতো কোনো স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ছাদ ধসে যাওয়ায় সিঁড়ির নিচেই আটকা পড়েন তাঁরা। দেয়ালচিত্র দেখে গবেষকেরা আধুনিক সময়ের ওয়ালপেপার সমতুল্য বলে মনে করছেন। পম্পেই পার্কের পরিচালক গ্যাব্রিয়েল জাখট্রিয়েজেল জানান, আমরা যেন এখানে সব সময় বিস্ময় দেখার জন্য বসে আছি। কারা থাকত সেখানে?

অনুসন্ধানকারীরা আরেকটি দেয়ালচিত্রের সন্ধান পেয়েছেন, সেটি ত্রিপল দিয়ে ঢাকা ছিল। এই চিত্রে দেখা যায়, ট্রোজান যুদ্ধের যোদ্ধা অ্যাকিলিস নারী ছদ্মবেশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, যেন তিনি যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে পারেন। আরেকটি ঘর পাওয়া যায়, যেটিকে উপাসনার স্থান বলে মনে করছেন গবেষকেরা। গাঢ় লাল-বাদামি দেয়ালে দুটি সাপের অবয়ব দেখা যায়। সাপ সেই সময় মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করত বলেই মনে করা হয়। পম্পেই পার্কের পরিচালক গ্যাব্রিয়েল জানান, ‘অনেকেই আমাদের জিজ্ঞাসা করেন, আমরা কী খুঁজছি। আমরা কী করি? আমরা আসলে যা জানি না, তা খুঁজছি। আমরা এখানে সব সময় বিস্ময়ের খোঁজ করি। জানি না, আমাদের যাত্রার শেষ কোথায়?’
সূত্র: বিবিসি