নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী স্যার রিচার্ড জন রবার্টস

‘রাজনীতিবিদেরা বিজ্ঞান বুঝতে চান না’

ব্রিটিশ জৈবরসায়নবিদ ও আণবিক জীববিজ্ঞানী স্যার রিচার্ড জন রবার্টস। তিনি বিজ্ঞানী ফিলিপ অ্যালেন শার্পের সঙ্গে ১৯৯৩ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে (ফিজিওলজি অর মেডিসিন) যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান। ইউক্যারিওটিক ডিএনএতে ইন্ট্রোন আবিষ্কার ও জিন-বিভক্তকরণের কৌশল নিয়ে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন। রাজধানীর নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনিস্টিউট অব পলিসি অ্যান্ড গর্ভন্যান্সের (এসআইপিজি) আমন্ত্রণে সংক্ষিপ্ত সফরে ২৬ অক্টোবর বাংলাদেশে এসেছিলেন স্যার রিচার্ড জন রবার্টস। তিনি এসআইপিজির 'জিএমও ক্রপস ইন বাংলাদেশ: পলিসিস অ্যান্ড প্র্যাক্টিসেস' শীর্ষক বিশেষ বক্তৃতায় অংশ নেন। ২৭ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে প্রথম আলোর সঙ্গে বিজ্ঞান ও উদ্ভাবন নিয়ে নিজের ভাবনা মেলে ধরেন স্যার রিচার্ড জন রবার্টস। নোবেলবিজয়ী এই বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহিদ হোসাইন খান

ঢাকায় নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী স্যার রিচার্ড জন রবার্টস
প্রথম আলো
প্রশ্ন:

আপনি বিজ্ঞানী ফিলিপ অ্যালেন শার্পের সঙ্গে যৌথভাবে ১৯৯৩ সালে চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। আপনি যে আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন সেই সম্পর্কে জানতে চাই।

স্যার রিচার্ড জন রবার্টস: আমরা বিশেষ ধরণের জিন আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলাম। উচ্চতর জীব বা প্রাণীর জিন আর ব্যাকটেরিয়ার জিন আলাদা—সেই বিষয়টি আমরা শনাক্ত করি। ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ একটি রৈখিক অংশের মত। মেসেঞ্জার আরএনএ অনুলিপি তৈরি করুন, যা রাইবোসোমে যায় ও প্রোটিনে রূপান্তরিত হয়। আমরা অ্যাডেনোভাইরাস নিয়ে কাজ করেছিলাম। উচ্চতর জীবে জিনগুলোকে টুকরো টুকরো করে বিভক্ত করা হয়। সিনেমা তৈরিতে ভিডিও সম্পাদনার মতো বিষয়টি বলা যায়। টুকরো টুকরো করে নানান জায়গা থেকে জিন কেটে নেয়া যায়। আসলে আমরা দুর্ঘটনাক্রমে এই আবিষ্কার করেছিলাম। আমরা জিন খুঁজছিলাম না, আমরা আসলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু খুঁজছিলাম। আমরা যেসব পরীক্ষা করেছিলাম তার সবই ব্যর্থ হয় তখন। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম কেন পরীক্ষাগুলো ব্যর্থ হয়েছে? তা খোঁজার প্রক্রিয়ায় আমরা আরএনএ যুক্তকরণের উপায় বা স্প্লাসিং, ইন্ট্রোন ও এক্সন আবিষ্কার করেছি।

প্রশ্ন:

এবছরের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ২০২৩ সালের নোবেল পুরস্কার নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

রিচার্ড জন রবার্টস: করোনা মহামারীর সময় খুব দ্রুত ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টা নেয়া হয়। ভ্যাকসিন তৈরিতে প্রচলিত উপায় হল প্রোটিন খুঁজে বের করা। তা বিভিন্ন ভাইরাসে উপস্থিত থাকে। আপনি সেই প্রোটিনকে মানুষের মধ্যে প্রবেশ করান। তারপরে আপনার শরীর ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এভাবে আপনি ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত হন। এটি কিন্তু বেশ একটি ধীর প্রক্রিয়ায় হতে থাকে। প্রোটিনভিত্তিক ভ্যাকসিন তৈরি করতে সাধারণত কয়েক বছর লেগে যায়। পাঁচ বছরও কিন্তু সময় লাগে। মহামারীর সময়ে ক্যাটালিন ক্যারিকো ও ড্রু ওয়েইসম্যান একটি বিকল্প উপায় উদ্ভাবন করেন। প্রোটিন তৈরির পরিবর্তে তাঁরা আরএনএ তৈরি করেন, যা প্রোটিনকে এনকোড (সংকেতে রুপান্তর) করে। যদি আপনি তা মানুষের মধ্যে ইনজেক্ট করেন, তাহলে খুব দ্রুত একটি অ্যান্টিবডি প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। বাকি ইতিহাসটা আমরা জানি। বিজ্ঞানীরা রেকর্ড সময়ে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করেছেন। এটি সত্যিই খুব দ্রুত ছিল। এখন আমরা জানি এভাবেও কাজ করা যেতে পারে। এই বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে এসব নিয়ে কাজ করছেন। তাঁরা কিন্তু ভ্যাকসিন তৈরির জন্য কাজ করছেন না। ক্যানসার ও অন্যান্য রোগের জন্য থেরাপি হিসেবে নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করছিলেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন ভ্যাকসিনের জন্য তাঁদের উদ্ভাবিত উপায় ব্যবহার করা যেতে পারে। আর এ কারণেই তাঁরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আমি বলব এটা খুব ভালো কাজের জন্য নোবেল পুরস্কার।’

প্রশ্ন:

বাংলাদেশে আগেও আপনি এসেছেন। এবারে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এসআইপিজির আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছেন। এসআইপিজির 'জিএমও ক্রপস ইন বাংলাদেশ: পলিসিস অ্যান্ড প্র্যাক্টিসেস' শীর্ষক বিশেষ বক্তৃতায় অংশ নিচ্ছেন। জিএমও ফসলের গুরুত্ব কেমন বলে মনে করেন?

রিচার্ড জন রবার্টস: আমি বাংলাদেশে এসেছি জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গানিজম (জিএমও) নির্ভর খাদ্যবিষয়ক একটি বক্তৃতায় অংশ নিতে। এই পদ্ধতিতে উন্নত ও দ্রুততম উপায়ে উদ্ভিদ বা ফসলের প্রজনন ত্বরানিত করা হয়। প্রচলিত উপায়ে চাষাবাদের তুলনায় এই পদ্ধতি আরও সুনির্দিষ্ট ও অনেক দ্রুতগতির। দুটি উদ্ভিদ নিয়ে আপনি তাদের একটি হাইব্রিড তৈরি করতে পারেন। যেভাবে মানুষ বংশবিস্তার করে বিষয়টি তেমন। আপনি বিভিন্ন ধরণের গাছপালার ক্রস বা সংকরায়ন করলে তাদের মধ্যে বিভিন্ন জিন স্থানান্তরিত হয়। এটি সাধারণভাবে খুব ধীর প্রক্রিয়া। জিএমও পদ্ধতিতে জিনকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। নির্দিষ্ট উদ্ভিদে সেই জিনকে যুক্ত করা যায়। নতুন জিন ফসলের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়ক।

প্রশ্ন:

আর কী উপকারে আসতে পারে জিএমও ফসল?

রিচার্ড জন রবার্টস: এই পদ্ধতিতে খরা প্রতিরোধী ফসল চাষ সম্ভব। নতুন ফসল এমন পুষ্টি তৈরি করে যা মানুষের প্রয়োজন হয়। খুব দ্রুততম উপায়ে এই পদ্ধতিতে কাজ করা যায়। জিএমও নিয়ে অনেক পক্ষের কথা শোনা যায়। ইউরোপীয় অঞ্চল আসার কারণে প্রাথমিকভাবে এই পদ্ধতি খারাপ ও বিপজ্জনক বলে দাবি করা হয়। আমরা জানতাম না আমরা কী করছি, এমন সব অপ্রত্যাশিত পরিণতি হতে পারে বলে শঙ্কা ছিল। আমরা বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে এই ফসল নিরাপদ কিনা তা খুঁজে বের করেছি। আমরা গবেষণায় দেখেছি এই ফসল নিরাপদ। তারপরেও জিএমও বিরোধীরা অস্বীকার করে। বিজ্ঞানীরা অনেক বছর ধরে এই পদ্ধতি নিরাপদ বলে পরীক্ষা করছেন। জানেন কি, প্রথম জিএমও উদ্ভিদ তৈরি হওয়ার পর থেকে গত ৪০ বছরে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। এই পদ্ধতি থেকে নতুন সমস্যা দেখা যায়নি। ইউরোপীয় অঞ্চলে পশুদের খাওয়ানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে জিএমও ফসল আমদানি করা হয়। দৃশ্যত এই ফসল প্রাণীদের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ। সেই হিসেবে মানুষের খাওয়ার জন্য কিন্তু এই পদ্ধতিতে চাষ করা ফসল বিপজ্জনক না। যে সব প্রাণীকে জিএমও ফসল খাওয়ানো হচ্ছে তারা কিন্তু নিরাপদেই আছে।

১৯৯৩ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেলবিজয়ী দুই বিজ্ঞানী
নোবেলপ্রাইজ ডটওআরজি
প্রশ্ন:

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। এখানে জিএমও ফসলের চাষের সম্ভাবনা কেমন?

স্যার রিচার্ড জন রবার্টস: বাংলাদেশের কৃষি নিয়ে অনেক অগ্রগতি আছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো যেখানে খাদ্যসংকট আছে সেখানে জিএমও ফসলের প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের মত কৃষিপ্রধান দেশের ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশ বিটি ব্রিঞ্জাল নামের একটি বেগুন চাষে অগ্রগামী অবস্থানে আছে। এই বেগুন জিএমও পদ্ধতিনির্ভর। এই বেগুনের কারণে কোনো ধরণের দুর্ঘটনা ঘটেনি। আরও অনেক ফসল আছে এমনই উপকারী। আমি ‘গোল্ডেন রাইস’ নিয়ে কথা বলেছি। এই ধান চাষ ফিলিপাইনে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই ধান শিশুকালে অন্ধত্ব দূর করতে কার্যকর। যে সব শিশু পর্যাপ্ত ভিটামিন এ-যুক্ত খাবার খায় না বা পায় না, তাদের অন্ধত্বের ঝুঁকি থাকে। আরও অনেক ধরণের অপুষ্টিতে ভোগে তারা। গোল্ডেন রাইস তাদের পুষ্টির ভালো উৎস হতে পারে। জিএমও ফসলের মাধ্যমে অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব। আমি আরও ১৬৬ জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের একটি সংগঠনে যুক্ত। আমরা সবাই বলছি জিএমও ফসল ভালো। শুধু তাই নয় জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে নতুন উদ্ভাবিত নানা ফসল। অনেক ফসল কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে বায়ুমন্ডল থেকে। ভবিষ্যতে ফসলকে উন্নয়নের মাধ্যমে এসব সমস্যায় আরও কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে

প্রশ্ন:

বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা অনেক কাজ করেন। এর পাশাপাশি নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদেরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন বলে আপনি মনে করেন?

স্যার রিচার্ড জন রবার্টস: বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি অনেক রাজনীতিবিদেরা বিজ্ঞান বুঝতে চান না। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণকে বেশি গুরুত্ব দেন। রাজনীতিবিদেরা বিজ্ঞান বুঝতে চান না, বিজ্ঞান যে সত্য বলে তা তারা পছন্দ করেন না। বৈজ্ঞানিক তথ্য সত্যনির্ভর, তাদের বিশ্বাস করুন বা না করুন, তা সত্য। রাজনীতিবিদদের বিজ্ঞান সম্পর্কে জানা উচিত। বিজ্ঞানীদের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। আমি নিশ্চিত আপনার কাছে একটি মোবাইল ফোন আছে। মোবাইল ফোন কোথা থেকে এসেছে? কী কারণে মোবাইল ফোন সম্ভব হয়েছে? এর পিছনে ছিল বিজ্ঞান। কোনো রাজনীতিবিদ কি বলছিলেন আমাদের সেলফোন বানাতে হবে? মোবাইল তৈরি হয়েছে কারণ বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবনের উপায় আবিষ্কার করেছিলেন।

প্রশ্ন:

উদ্ভাবন ও গবেষণার ব্যবহারিক দিক নিয়ে আপনার ভাবনা কি?

স্যার রিচার্ড জন রবার্টস: তরুণ বিজ্ঞানী ও গবেষকদের উৎসাহ ও সুযোগ তৈরির জন্য অনুদান ও অর্থের প্রয়োজন হয়। সাধারণ বিজ্ঞাননির্ভর গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য একাডেমিক গবেষণাকে আরও উৎসাহিত করা উচিত। আপনার দেশের স্থানীয় বিজ্ঞানীরা জানেন কীভাবে ফসলের উন্নয়ন করতে হয়। তাঁদের এসব নিয়ে কাজের বেশি বেশি সুযোগ দিতে হবে। উদ্ভাবিত নতুন ফসল কৃষকদের কাছে পৌছে দিতে হবে। নতুন উদ্ভাবনের কারণে চিকিৎসাসংক্রান্ত নানান সমস্যা সমাধানের সুযোগ আছে। উদ্ভাবন দারিদ্র্যতা বিমোচনের মত বিষয়গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ।

প্রশ্ন:

আপনাকে ধন্যবাদ।

স্যার রিচার্ড জন রবার্টস: আপনাকেও ধন্যবাদ।