মেটার সহায়তায় সফল বাংলাদেশের ৩ নারী উদ্যোক্তা

অনলাইনে নিজের ব্যবসার পেজ খুলে সফল হয়েছেন সুফিয়া মাহমুদ (ডানে)সংগৃহীত

বর্তমানের বিশ্ববাজার এখন সামগ্রিকভাবে হয়ে উঠেছে অনলাইননির্ভর। গত কয়েক বছর থেকেই ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক নারীই নিজেদের ব্যবসা শুরু করেছেন, শক্ত হাতে নিজের পরিবারের দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছেন। তাঁরা ব্যবসার লাভ থেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজেদের দোকান বা আউটলেট।

সফল নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে শীর্ষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা। গত বছর মেটা তাদের ‘শিমিনসবিজনেস’ কর্মসূচি চালু করে বাংলাদেশে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) কর্মসূচি, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও লাইটক্যাসল পার্টনার্সদের সঙ্গে মেটা বাংলাদেশে এই কর্মসূচি শুরু করে নতুন অনলাইন নারী উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার ও সম্পর্ক তৈরিতে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০ লাখ নারীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে তুলেছে মেটার এই উদ্যোগ। বাংলাদেশেও নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা প্রসারের জন্য ডিজিটাল টুল ও প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও সংযোগ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে মেটা। এরই মধ্যে দেশজুড়ে ১০ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে শিমিনসবিজনেস। চলতি বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে মেটা। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মেটার শিমিনসবিজনেস কর্মসূচিতে যুক্ত বাংলাদেশের তিনজন সফল নারী উদ্যোক্তার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

আরও পড়ুন
আফসানা আক্তার
সংগৃহীত

আফসানার গুটিপোকা পৌঁছে গেছে সারা দেশে

ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছে স্বাবলম্বী হওয়ার দীক্ষা পেয়ে আসা আফসানা আক্তার সব সময় চেয়েছেন নিজের ব্যবসা শুরু করতে। কাপড়ের ক্যানভাসে রংতুলি দিয়ে নকশা ফুটিয়ে তুলতে বরাবরই পছন্দ করতেন, তাই পছন্দের এই কাজকেই আয়ের উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছেন। চালু করেন নিজের ফেসবকু পেজ—গুটিপোকা!
শুরুতে আফসানা একাই পণ্য তৈরি, অর্ডার নেওয়া, প্যাকেজিং ও সরবরাহের কাজ সামলাতেন। লাভ হতে থাকলে সাহায্যের হাতও বাড়তে থাকে। এভাবে গুটিপোকা বড় হতে থাকে।

মেটার শিমিনসবিজনেস সম্পর্কে আফসানা যখন জানতে পারেন, তখনই তিনি এতে যুক্ত হন। কেননা, ফেসবুকনির্ভর ব্যবসায় বিভিন্ন ডিজিটাল টুলের ব্যবহারের মাধ্যমে দূরদূরান্তের ক্রেতাদের কাছে নিজের ব্যবসা নিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। প্রশিক্ষণ নিয়ে আফসানা ডিজিটাল টুলসের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানতে থাকেন।

আফসানা আক্তার বলেন, ‘জীবন খুবই চ্যালেঞ্জিং, আমাদের সব পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আর প্রস্তুতির প্রথম শর্ত হচ্ছে আর্থিক সংগতি। নারী বা পুরুষ, নিজের সমস্ত ব্যয় বহনের যোগ্যতা থাকা উচিত প্রত্যেকের। এখন আমি অনলাইন প্রচারণা সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। ভিডিও, ছবি, ক্যাপশন ইত্যাদি দিয়ে কেমন উপস্থাপনা হওয়া উচিত—এসব শিখেছি। এ সবকিছুই পরে কাজে লেগেছে, যার ফলে পেজে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। ব্যবসার প্রসার হয়েছে।’

প্রচলিত ব্যবসা থেকে অনলাইনে সুফিয়ার উদ্যোগ

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চল শুরু হয়নি, সেই সময় থেকেই সুফিয়া মাহমুদ উদ্যোক্তা হিসেবে যশোরে নিজের যাত্রা শুরু করেন। যাত্রা শুরুর পথ কিংবা শুরু করার কারণ কোনোটিই সুখকর ছিল না। বাল্যবিবাহের শিকার সুফিয়া কৈশোরেই স্কুল ছেড়েছিলেন। সংসারজীবনে পা রাখতেই অল্প সময়ের ব্যবধানে সন্তানের মা হন। সন্তান ও নিজের ভরণপোষণ চালাতে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন আয়ের পথ। সামাজিক বাধা ও নানাজনের কটু কথা শুনতে হয় সুফিয়াকে। কিন্তু এসব প্রতিকূলতা তাঁকে টলাতে পারেনি। দৃঢ়ভাবে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান সুফিয়া।

প্রথমে দর্জির দোকানে সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে প্রশিক্ষণ নিয়ে সামান্য পুঁজি দিয়ে নিজেই বুটিকের দোকান দেন। স্কুলের গণ্ডি পার করতে না পারলেও সুফিয়া নানা বিষয়ে জানতে সব সময় আগ্রহী ছিলেন। দর্জির কাজ করার পাশাপাশি তাই একসময় সাজসজ্জার কাজ শিখলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের বিউটি পার্লার ‘সানন্দা’।
সামাজিক মাধ্যমের প্রসার ঘটতে থাকলে অনলাইনে নিজের ব্যবসার পেজ খোলেন সুফিয়া। তবে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে কীভাবে অনলাইনে ব্যবসার বিস্তার ঘটাবেন, তা নিয়ে শঙ্কা তাঁকে ঘিরে ধরে। এরপর তিনি শিমিনসবিজনেসে অংশ নেন।

সুফিয়া মাহমুদ বলেন, ‘প্রথমে মানুষের সঙ্গে কথা বলে বলে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজের ব্যবসা সম্পর্কে জানাতে হতো। নারী বলে সেভাবে সুযোগও পেতাম না। প্রশিক্ষণ নিয়ে জানতে পারলাম কীভাবে ঘরে বসেই আমি অনলাইনে নিজের ব্যবসার কথা দেশের অন্য প্রান্তের মানুষদেরও জানাতে পারি। এতে সময় ও শ্রম দুটিই বাঁচে।’
সুফিয়া মাহমুদ শুধু নিজেই স্বাবলম্বী হয়ে থেমে থাকেননি; তাঁর আশপাশে থাকা দুস্থ নারীদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। চাকরি দেওয়ার পাশাপাশি করেছেন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।

কানিজ ফারহীন (ডানে)
সংগৃহীত

সন্তানের জন্য পোশাক তৈরি করে এখন উদ্যোক্তা কানিজ ফারহীন

ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে পড়ে থাকা ছোটখাটো জিনিস নিয়ে এটা–সেটা বানাতেন (ক্র্যাফটিং) করতে পছন্দ করতেন কানিজ ফারহীন। তবে কখনো সেটাকে পেশা হিসেবে বেছে নেবেন, তা ভাবেননি। সন্তান জন্মের পরপরই যখন অনেক নারীর পেশাজীবন পারিবারিক চাপে থমকে যায়, সেই সন্তান জন্মানোর পর থেকেই শুরু হয় কানিজের উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা।

সন্তান জন্মের পর বাচ্চাকে নানা রকম পোশাক ও অনুষঙ্গ পরিয়ে যখন সবার সামনে নিয়ে যেতেন, অনেকেই তাঁর হাতের কাজের প্রশংসা করতেন। এভাবে একটু একটু করে সাহস পেলেন কানিজ। কিন্তু ব্যবসা শুরুর আগেই ভাবনা জেঁকে বসল তাঁর মনে—ব্যবসা শুরু করবেন, কিন্তু ব্যবসার অ-আ-ক-খ সম্পর্কেই তো ধারণা নেই।
পরিবারের সাহসে এরপর শুরু হলো কানিজের যাত্রা। ফেসবুকে খুললেন ‘ঘুর্ণী বাই পান্থি পেজ’। পান্থি কানিজের ডাক নাম। শুরুতে অল্প কিছু পণ্য নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে দাম ঠিক করতেন। রাত জেগে কানিজ বানাতেন বাহারি মালা, কানের দুল, আংটিসহ বিভিন্ন গয়না। ধীরে ধীরে পণ্যের তালিকায় যুক্ত হলো পার্স ও ব্যাগ, যেগুলো কানিজ নিজের হাতে কাপড় কেটে, সেলাই করে বানাতেন। তাঁর ফেসবুক পেজ দ্রুতই সাড়া পেতে থাকে।

জনপ্রিয় হলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা গ্রাহকদের কাছে সেভাবে পৌঁছাতে পারছিল না পেজটি। কানিজ সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যবসা বিস্তৃত করার। এ সময় তিনি যোগ দেন মেটার শিমিনসবিজনেস কর্মসূচিতে। এই কর্মসূচি থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে কানিজের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ল দেশব্যাপী!

কানিজ ফারহীন বলেন, ‘ব্যবসা শুরুর জন্য মূলত দরকার সাহস। আমার পরিবার আমার শক্তির উৎস, আর আমি নিজেই নিজেকে ক্রমাগত সমর্থন দিয়ে গেছি। রাত জেগে তৈরি করা পণ্যগুলো ক্রেতাদের যখন ব্যবহার করতে দেখি, তখন আসলেই মনে হয় আমি সার্থক।’