মুক্তিযুদ্ধের তথ্যে সমৃদ্ধ এখন অনলাইন

অলংকরণ: আপন জোয়ার্দার

বছর কয়েক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। ভিডিওটিতে একজন রিপোর্টার ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে কয়েকজন কিশোর-কিশোরীকে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। সহজ সে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারছিল না তারা। বিষয়টি নিয়ে খুব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তখন। কেননা প্রশ্নগুলো ছিল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের। যদিও অনেকে মনে করেন, ভিডিওটি ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং যারা এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছিল, তাদের অংশটি বাদ দেওয়া হয়েছিল সম্পাদনার সময়ে। যা হোক, ভিডিওটির উপস্থাপনভঙ্গি ছিল এমন—যাতে মনে হয় নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে একেবারে অসচেতন। আদতে কিন্তু সেটা ঠিক নয়। কেননা যেকোনো কিছু জানার জন্য এখন তাদের সামনে অবারিত উৎস—অন্তর্জাল, অর্থাৎ ইন্টারনেট।

আমাদের নতুন প্রজন্ম অনেকটা যন্ত্রনির্ভর, এটা বর্তমান বাস্তবতা। যেকোনো বিষয়ে জানার জন্য এখন গুগলসহ অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন হয়ে উঠেছে প্রধান ভরসা। কাগজের বই হাতে নিয়ে পড়ায় যেমন তৃপ্তি আছে, তেমনি বইয়ের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বই আপনি শুধু পড়তে পারবেন। ইন্টারনেটের ওয়েবসাইট থেকে আপনি কোনো কিছু সম্পর্কে পড়তে, শুনতে এমনকি দেখতেও (অডিও-ভিডিও) পাবেন। চাইলে নিজের মতামত, প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেখা সম্পাদনা করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার জন্যও অনলাইনে বেশ কিছু সমৃদ্ধ উৎস আছে। অ্যাপ, ভিডিও, ব্লগ, ফেসবুক গ্রুপ, ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় এসব তথ্য। তেমন কয়েকটি উৎস, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনাবলি, ইতিহাস, বিশ্লেষণ ইত্যাদি তুলে ধরেছে; তা নিয়েই আজকের আয়োজন।

প্রথমে বলা যাক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কথা। এখানকার দারুণ এক বিষয় হলো—সশরীর যেমন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখা যায়, তেমনি ভার্চ্যুয়ালিও কিন্তু পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে পরিদর্শন করা যায় সমৃদ্ধ এ জাদুঘর। চমৎকার এই ওয়েবসাইটের ঠিকানা হলো— www.liberationwarmuseumbd.org। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সম্পর্কিত তথ্য, ভার্চ্যুয়াল ট্যুর, বাংলাদেশের ইতিহাস, নানা ধরনের দলিল, বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র পাওয়া যায় এখানে। এ ছাড়া অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থাও রয়েছে; পাওয়া যায় জাদুঘরের অনুষ্ঠানগুলোর খবর। ‘অন দিস ডে’ নামে এখানে একটি অপশন আছে যাতে ১৯৭১ সালের বর্তমান তারিখে উল্লেখযোগ্য যা ঘটেছিল তার একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। ওয়েবসাইটটি বেশ গোছানো এবং ব্যবহারবান্ধব।

মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্ক জানার জন্য আরেকটি ভালো উৎস হলো ‘মুক্তিযুদ্ধ–ই–আর্কাইভ’। এই ওয়েবসাইট গড়ে উঠেছে সাব্বির হোসাইন ও শান্তা আনোয়ার নামের দুই তরুণ–তরুণীর উদ্যোগে। এটিও বেশ সমৃদ্ধ ওয়েবসাইট। মুক্তিযুদ্ধ–সম্পর্কিত অডিও, ভিডিওর পাশাপাশি এখানে রয়েছে প্রচুর বই, দলিল ও ছবি। এমনকি ১৫ খণ্ডে রচিত স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিল পড়া যাবে এই সাইট থেকে। সেই সময়ের পত্রিকাগুলোর রিপোর্টের একটা আর্কাইভ সংযোজিত এখানে। মুক্তিযুদ্ধের পরম্পরা, অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্ন সালের নির্বাচন, ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, স্বাধীনতার ঘোষণা, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড–সম্পর্কিত তথ্য যেমন এখানে আছে, তেমনি যুদ্ধ–পরবর্তী বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ঘটনা জানা যাবে এই আর্কাইভ থেকে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পাঁচ হাজার ছবির সমৃদ্ধ আর্কাইভ আছে এখানে। দেশি–বিদেশি আলোকচিত্রী ও নানা সংবাদ সংস্থার তোলা এই ছবিগুলো মুক্তিযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও রয়েছে নানা তথ্য। বেশ কিছু দলিল, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, গণহত্যার তথ্য, বিভিন্ন সময়ের মুক্তিযুদ্ধের ছবি ইত্যাদি পাওয়া যাবে এই সাইটে

‘চিরন্তন ১৯৭১’ নামে প্রথম আলোর সাইটে গেলেও জানা যাবে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য। এই সাইটে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দিনলপি, মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য, গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারসহ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জানা যাবে এখান থেকে। এ ছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য পাঠানোর সুযোগ রয়েছে এ ওয়েবসাইটে। যাচাই–বাছাই করে সেই তথ্য প্রকাশ করা হয় সাইটটিতে।

‘বাংলাদেশ জেনোসাইড আর্কাইভ’ আরেকটি দারুণ ওয়েবসাইট, যেখান থেকে জানা যাবে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ইংরেজি ভাষার এই সাইটও সমৃদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য, কোনো বাহিনীর কতজন যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, কতজন মারা গেছেন—এমন সব দরকারি তথ্য পাওয়া যায় এখানে। এর টাইমলাইন ট্যাব থেকে যুদ্ধের নির্দিষ্ট সময়ের ঘটনাবলি জানা যায়। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের তালিকা, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ওই সময়ের তথ্যচিত্রের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার আছে এখানে। পাকিস্তানিদের চোখে ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ, বই, প্রতক্ষ্যদর্শীর কথা, চিত্রকলা, ভারতের ভূমিকা, শরণার্থী সমস্যা, প্রবাসীদের ভূমিকা ইত্যাদি বিস্তারিত বয়ান পাওয়া যায় সাইটটিতে।

চাইলে ফেসবুক গ্রুপ থেকেও জানা যাবে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটিতে রয়েছে এ–সম্পর্কিত অনেকগুলো গ্রুপ। ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো’ তেমনই একটি গ্রুপ। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এ ধরনের গ্রুপে ঢুঁ মেরে জেনে নিতে পারেন মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা।

মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের জন্য গুগল প্লে স্টোরে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে রয়েছে নানা অ্যাপ। সাত বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার জীবন, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার অজানা ইতিহাস, সংগ্রামের নোটবুক—মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ইত্যাদি অ্যাপ থেকে জানা যাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। মুক্তিযুদ্ধের একেকটি বিষয় নিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে একেকটি অ্যাপ।  

মোদ্দাকথা হলো আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস জানার জন্য অনলাইন এখন বেশ সমৃদ্ধ। তরুণ প্রজন্মের পক্ষে বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে জানা সম্ভব সহজেই।