৯৪ দেশে বাংলাদেশি মার্কোপোলোর বিজয় অভিযান

নিজেদের কার্যালয়ের আঙ্গিনায় মার্কোপোলোর দুই প্রতিষ্ঠাতা রুবাইয়াৎ মোস্তফা ফারহান ও তাসফিয়া তাসবীনআশরাফুল আলম

তাসফিয়া তাসবীন ও রুবাইয়াৎ মোস্তফা ফারহান দুজনের মন যে বেশ কিছুদিন ধরে একটু বেশিই ফুরফুরে তা বলা যায়। তারপরও সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান অ্যাভিনিউয়ে তাঁদের কার্যালয়ের সামনে সবুজের সমারোহে ছবি তোলার সময় বলা হলো, কোটি টাকার একটি হাসি দিন তো! তাসফিয়া হেসে উত্তর দিলেন, ‘দোয়া করবেন, যাতে কোটি টাকাকে ১০০ কোটি টাকা করতে পারি।’

তাসফিয়া তাসবীন ও রুবাইয়াৎ ফারহান মার্কোপোলো ডট এআই নামের একটি নতুন উদ্ভাবনী উদ্যোগ বা স্টার্টআপের সহপ্রতিষ্ঠাতা। তাসফিয়া মার্কোপোলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), রুবাইয়াৎ ফারহান প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও)। দুই তরুণের বয়সই ২৮ বছর। গত ১৮ মে বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ফোর্বস ২০২৩ সালের জন্য এশিয়ার ৩০ অনুর্ধ্ব ৩০ (থার্টি আন্ডার থার্টি) তরুণের যে তালিকা করেছে, তাতে দুজনই স্থান পেয়েছেন। বাড়তি স্বীকৃতি আছে তাসবীনের ঝুলিতে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি প্রযুক্তি শ্রেণিতে পেয়েছেন দ্য ডেইলি স্টার–এর স্টেলার উইমেন পুরস্কার।

রুবাইয়াৎ মোস্তফা ফারহান ও তাসফিয়া তাসবীন
আশরাফুল আলম

ফোর্বস–এর তালিকায় স্থান পাওয়ার আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই ১৭ জুন বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্ট ২০২৩–এর চ্যাম্পিয়ন হয়ে এক কোটি টাকার অনুদান পেয়েছে মার্কোপোলো ডট এআই। একই সঙ্গে এ বছর যৌথ চ্যাম্পিয়ন ‘ফেব্রিক লাগবে’ নামে আরেকটি স্টার্টআপও এক কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে।

মার্কোপোলো ডট এআইয়ের কার্যালয়ে বসে রুবাইয়াৎ ও তাসবীনের কাছে প্রথম প্রশ্ন ছিল—এআই মানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বোঝা গেল; কিন্তু মার্কোপোলো কেন? রুবাইয়াৎ বলেন, ‘মার্কেটিং থেকে মার্ক নিয়েছি। আমরা চেয়েছি, আলীবাবা বা অ্যামাজনের মতো সহজ নাম দিতে।’ তাই ইতালীয় বণিক, অভিযাত্রী ও লেখক মার্কো পোলোর নাম বেছে নিয়েছেন তিনি। রুবাইয়াৎ যোগ করলেন, ‘আমরা যেহেতু বৈশ্বিক পণ্য তৈরি করতে চাইছি, তাই নামটা যাতে সহজে সবার নজর কাড়ে, সে ইচ্ছাটা ছিল। মার্কোপোলো ডট এআই হলো নতুন বিক্রয়ের অভিযাত্রী।’

রুবাইয়াৎ মোস্তফা ফারহান
আশরাফুল আলম

মার্কোপোলো ডট এআই মূলত এ সময়ের আলোচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির একটি সফটওয়্যার, খুলে বলেন তাসবীন, ই–কমার্স বা ফেসবুক পেজভিত্তিক ব্যবসা, তা ছোট হোক বা বড় হোক, অনলাইনের নানা মাধ্যমে তাদের প্রচার চালাতে হয়, বিজ্ঞাপন দিতে হয়। আবার ভোগ্যপণ্যের বড় বড় প্রতিষ্ঠানকেও এখন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিনে প্রচারণা চালাতে হয়। এই প্রচারণা চালানো ও অনলাইনে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা কারিগরি কাজ।

রুবাইয়াৎ যোগ করেন, হয় তাঁদের নিজে শিখে নিতে হবে, না হয় একজন দক্ষ কর্মীকে নিয়োগ দিতে হবে কিংবা বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে (এজেন্সি) দায়িত্ব দিতে হবে। ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এর কোনোটাই সহজ নয়। মার্কোপোলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাজটা করে দেয়। মার্কোপোলো ডট এআইয়ের গ্রাহক হয়ে এর সঙ্গে ফেসবুক পেজ বা ই–কমার্স সাইট যোগ করে দিলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সফটওয়্যার কয়েকটা নমুনা দেবে প্রচারণা ও বিজ্ঞাপনের ধরনের ওপর। প্যাকেজের ওপর নির্ভর করবে খরচ। এরপর উপাত্ত বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিপণন ও বিজ্ঞাপন কৌশল নির্ধারণ করে দেবে মার্কোপোলো ডট এআই। এমনকি বিজ্ঞাপনটিও লিখে দেবে।

তাসফিয়া তাসবীন
আশরাফুল আলম

মার্কোপোলো ডট এআই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ৯৪ দেশে। সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে জাপান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মার্কোপোলোর সার্ভারে রয়েছে তিন কোটি ডেটাসেট (তথ্য বা উপাত্তগুচ্ছ)। এগুলো দিয়েই প্রশিক্ষিত হয় সফটওয়্যারটি। ছোট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বড় প্রতিষ্ঠানের বিপণন দলকেও পণ্য বিপণনে সহায়তা করে এ সফটওয়্যার। অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞাপনী সংস্থা ফার্স্টপেজ, মধ্যপ্রাচ্যের বড় সংস্থা অ্যারাবিয়া মার্কোপোলোর গ্রাহক। বাংলাদেশে বড় গ্রাহকের মধ্যে আছে বিকাশ ও প্রাভা হেলথ।

মার্কোপোলো ডট এআইয়ের প্রথম সংস্করণ ২০২১ সালের জুনে ছাড়া হয়। শুরুতেই তাঁদের ২৪টি দেশের গ্রাহক আসে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অনলাইনে সফটওয়্যার বিক্রির ওয়েবসাইট প্রোডাক্ট হান্টে তাঁরা দ্বিতীয় সংস্করণ ছাড়েন। এপ্রিল থেকে জুন, এই তিন মাসে দুই কোটি টাকার বেশি বিক্রি হয় তাঁদের সফটওয়্যার। এখন তাঁদের অনেক পুনর্বিক্রেতা আছে। তারাও এটি বিক্রি করে। মার্কোপোলোর তৃতীয় সংস্করণ  প্রকাশের অপেক্ষায়।

তাসফিয়া তাসবীনের জন্ম ১৯৯৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৭ সালে ইলেকট্রনিকস ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলে স্নাতক তিনি। এরপর তিনটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছিলেন পরের তিন বছর। রুবাইয়াৎ ফারহানের জন্ম ১৯৯৫ সালের ১৫ এপ্রিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে বস্তু ও ধাতবকৌশলে (ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড মেটালারজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) স্নাতক হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তাসবীন বিয়ে করেছেন ২০২১ সালে, তাঁর স্বামী আবদুল আহাদ ব্যবসায়ী। তাঁদের ১০ মাস বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। রুবাইয়াৎ বিয়ে করেছেন গত এপ্রিল মাসে। তাঁর স্ত্রী আফিয়া আনজুম কম্পিউটার প্রকৌশলী।

ঢাকায় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) একটি উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতায় দেখা হয় তাসবীন ও রুবাইয়াতের। এরপর আলাপচারিতায় দেখেন দুজনের আগ্রহের জায়গা এক। দুজনেই কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখতে পারেন। তাসবীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রযুক্তির অভিজ্ঞতাও রয়েছ। রুবাইয়াৎ বলেন, ‘বিদেশি প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করতেই অভ্যস্ত। আমি চেয়েছি, নিজেরা সফটওয়্যার বানাব। আর তা হবে বৈশ্বিক। এই চিন্তা মিলে গিয়েছিল তাসবীনের সঙ্গে।’

মার্কোপোলো ডট এআই বাংলাদেশে তৈরি। তাসবীন ও রুবাইয়াৎ, এ দুজনই প্রোগ্রামটি তৈরি করেছেন। এখন তাঁদের প্রতিষ্ঠানে আছে ১৮ জনের প্রোগ্রামারের একটি দল। এর মধ্যে ছয়জন বিদেশি। মার্কোপোলো ডট এআইয়ের ব্যবসা, গ্রাহকসেবা ও ডেটা দলে এখন কাজ করেন ৪২ জন। কর্মীদের গড় বয়স ৩২। ঢাকায় গুলশান ও আগারগাঁয়ের আইসিটি টাওয়ারে কার্যালয় আছে। এছাড়া চট্টগ্রামের শেখ রাসেল ইনকিউবেশন সেন্টারেও একটি কার্যালয় রয়েছে।

রুবাইয়াৎ ও তাসবীন জানান, এই বিদায়ী অর্থবছরে প্রথমবারের মতো তাঁদের প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার ১ মিলিয়ন (১০ লাখ) মার্কিন ডলার ছুঁয়েছে। রুবাইয়াৎ বলেন, ‘চ্যাটজিপিটির নির্মাতা ওপেন আই ব্যবহারের অ্যাকসেস আমরা পেয়েছি ২০২০ সালেই। তখন অনেকেরই দুই–তিন মাস লেগে যেত এই অ্যাকসেস পেতে। আমরা মাত্র এক দিনে এটা পেয়েছি।’

বাংলাদেশ থেকে এআই সফটওয়্যার বানিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে এগিয়ে যেতে গুণগত মান নিয়ে সব সময় কাজ করে যেতে হয়। তাই রুবাইয়াৎ বলেন, এই অনুদানের টাকা তাঁরা গবেষণায় ব্যয় করবেন। মার্কোপোলো যাতে লেখা থেকে ছবি তৈরি করতে পারে (জেনারেটিভ এআই) সেই কাজ করছেন তাঁরা এখন। মার্কোপোলো বাংলা, ইংরেজিসহ অনেক ভাষা বুঝতে পারে। অনলাইনে বাংলা হরফ, ইংরেজি হরফে বাংলা, এমনকি রোমান হরফের অদ্ভুতভাবে লেখা বাংলাও (টাকলা ভাষা) যাতে এই এআই বুঝতে পারে সেটি, অর্থাৎ বিপণন ও বিজ্ঞাপন তৈরির জন্য বাংলা আবেগ বিশ্লেষণ শেখানো হবে মার্কোপোলোকে। এমন গবেষণার মধ্য দিয়ে এই দুই তরুণ আরও উন্নত করতে চান মার্কোপোলো ডট এআই।