উদ্ভিদ ও প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করবে জৈব ব্যাংক

মিলেনিয়াম সিড ব্যাংকে সংরক্ষণ করা বীজের নমুনাদ্য অবজারভার

হলিউডের আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের টার্মিনেটর কিংবা বিখ্যাত কোনো সাই-ফাই সিনেমা দেখলে আমরা অনেকেই চমকে যাই। পৃথিবী ধ্বংসের শেষ সময়ে চলে গেলে মানবসভ্যতা কতটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে, তা সিনেমায় আমরা সৃজনশীল উপায়ে দেখতে পাই। সত্যি সত্যি যদি ভবিষ্যতে তেমন দুর্যোগ নেমে আসে, তখনকার কথা বিবেচনা করে বিজ্ঞানীরা বসে নেই কিন্তু। আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করার জন্য বিশেষায়িত ভল্ট বা সিন্দুকে বীজসহ মানবসভ্যতার নানান তথ্যাদি সংরক্ষণের কাজ চলছে অনেক বছর ধরে। এসব সিন্দুকে মানুষসহ নানা প্রাণীর ডিএনএ সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে জলবায়ুগত কিংবা মানুষ্য সৃষ্ট খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে সবকিছু সংরক্ষণ করতে জন্য অত্যন্ত সুরক্ষিত চেম্বার তৈরি করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাসেক্সের ওয়েকহার্স্টে মিলেনিয়াম সিড ব্যাংক সেই লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সিড ব্যাংকের বিজ্ঞানী এলিনর ব্রেম্যান জানান, এই ব্যাংকে শূন্যের নিচে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সব সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এই তাপমাত্রায় যেকোনো মানুষ বরফঠান্ডায় জমে দিয়ে ফ্রস্টবাইট ও হাইপোথার্মিয়ার মতো জটিলতায় পড়তে পারে। মিলেনিয়াম সিড ব্যাংকে ২৫০ কোটি বীজের নমুনা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এখানে সারিবদ্ধ কাচের বয়ামে বিশেষভাবে বীজ ভর্তি করে রাখা হয়েছে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম বীজ ব্যাংক। বেশির ভাগ বীজ এই সিন্দুকে হিমায়িত করে রাখা হয়েছে। সামান্যসংখ্যক নমুনা ক্রিওপ্রিজারভ বা আরও বেশি মাত্রায় মাইনাস ১৮০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়। নানান জায়গা থেকে সংগৃহীত প্রায় ৪০ হাজার বন্য উদ্ভিদ প্রজাতির বীজ এখানে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

সিড ব্যাংকে কাজ করছেন গবেষকেরা
দ্য অবজারভার

২০০০ সালে মিলেনিয়াম সিড ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। সারা বিশ্বে এমন ব্যাংক আছে প্রায় ১ হাজার ৭০০টি। এসব ব্যাংকে শুধু বীজ নয় গবেষকেরা ডিএনএ থেকে শুরু করে মানুষের নানা জৈবিক তথ্য, মলের নমুনা পর্যন্ত সংরক্ষণ করছেন। পুরো বিষয়টিকে নুহ (আ)-এর বিখ্যাত সেই নৌকার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সেই আমলে নৌকা ছিল কাঠের, আর এখন এখন নৌকা হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যম। ব্রেম্যান বলেন, মিলেনিয়াম সিড ব্যাংকের মতো বিভিন্ন ব্যাংক মানুষসহ বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিলুপ্তি ঠেকাতে বিমার মতো কাজ করছে। আমাদের গ্রহের দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে সাহায্য করছে এসব ব্যাংক। রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনসের প্রতিবেদন বলছে, প্রতি পাঁচটির মধ্যে দুটি উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। শিল্পের বিকাশ, কৃষি-চাষ, বন উজাড়সহ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনে বিলুপ্তির ঘটনা ঘটছে। আক্ষরিক অর্থে আমরা যে অক্সিজেন শ্বাস হিসেবে নিই তার একমাত্র উৎস কিন্তু নানা ধরনের উদ্ভিদ। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য এই গাছ দরকার। এ ধরনের ব্যাংক বা সিন্দুকের ধারণা গত শতাব্দীর ২০ দশকে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। রাশিয়ার উদ্ভিদবিদ নিকোলাই ভ্যাভিলভ সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। সেটি আজও বিদ্যমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেনিনগ্রাদের ২৮ মাসের অবরোধের মুখে পড়লেও ব্যাংকটির ক্ষতি হতে দেননি বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর শেষ সময় আসছে কি না বলা যাচ্ছে না, কিন্তু এরই মধ্যে অনেক ব্যাংক কার্যকর ভূমিকা রাখছে। মিলেনিয়াম বীজ ব্যাংক এরই মধ্যে মাদাগাস্কার, ইন্দোনেশিয়া এবং মেক্সিকোতে নানাভাবে তৃণভূমি পুনরুদ্ধার করতে কাজ করছে। বিজ্ঞানী ভ্যাভিলভের সংগৃহীত বীজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে ফসল পুনরুদ্ধার করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।

নরওয়ে ও উত্তর মেরুর মধ্যবর্তী একটি প্রত্যন্ত দ্বীপপুঞ্জ স্যাভালবার্ডের হিমায়িত পর্বতমালায় আরেকটি সিন্দুক আছে। এটিতে বিশ্বের সব তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে এটি চালু হয়। আর্কটিক ওয়ার্ল্ড আর্কাইভ নরওয়েজিয়ান কোম্পানি পিকুল চালু করেছে। ফিল্মের রিলের নানা তথ্য সঞ্চয় করা হচ্ছে এখানে। এই সিন্দুক একটি পুরোনো খনির ভেতরে প্রায় ৩০০ মিটার নিচে চালু করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান রুনে জারকেস্ট্র্যান্ড বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুবিধার জন্য বিশ্বের নানা ঘটনা ও আলোচিত স্মৃতির বিষয়ের তথ্য সংরক্ষণে সাহায্য করার চেষ্টা করছি আমরা। সাইবার-আক্রমণ ও ভুল তথ্যের এই যুগ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা এখানে এমনভাবে তথ্য সংরক্ষণ করছি, যা ভবিষ্যতে সম্পাদনা করা যাবে না। এখানে পুরো সুইডেনের নানা শিল্পের প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার শিল্পকর্মের তথ্য  সংরক্ষণ করা হয়েছে। রয়েছে ভ্যাটিকান লাইব্রেরি থেকে পাণ্ডুলিপি, চিত্রশিল্পী এডভার্ড মুঞ্চের দ্য স্ক্রিমের মতো বিখ্যাত চিত্রকর্মের ডিজিটাল সংস্করণও। ২০২০ সালে বিশ্বের বৃহত্তম সোর্স কোড প্রতিষ্ঠান গিটহাব এই ভল্টে ১৮৬টি ফিল্মের রিলে ২১ টেরাবাইট তথ্য সংরক্ষণ করেছে।

গ্লোবাল সিড ভল্ট নামের একটি সিন্দুক নরওয়ে সরকার ২০০৮ সালে চালু করেছে। মিলেনিয়াম সিড ব্যাংকের মতো এই ব্যাংকে ধান, গম ও মটরশুঁটিসহ ১ মিলিয়নের বেশি বীজের জাত সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এই ব্যাংকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে সেই অঞ্চলের নানা বীজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এর বাইরে আরেকটি প্রকল্প মাইক্রোবায়োটা ভল্টের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক আর ভাইরাসের নমুনা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। মাইক্রোবায়োটা ভল্ট মানব মল ক্রায়োপ্রিজার উপায় সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছে। বিলুপ্তির কথা বিবেচনা করে অনেক সিন্দুক আরও দূরে তৈরির পরিকল্পনা আছে। এমনকি চাঁদের দিকেও নজর আছে গবেষকদের। ২০২১ সালে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীরা একটি সৌরচালিত চন্দ্র সিন্দুকের উচ্চাভিলাষী প্রস্তাব উন্মোচন করেন। এই সিন্দুকে বীজ, মানব শুক্রাণু ও ডিমের নমুনা ক্রাইওপ্রিজারভ উপায়ে সংরক্ষণ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ ও যান্ত্রিক প্রকৌশলের অধ্যাপক জেকান থাঙ্গা বলেন, ‘আমাদের বর্তমান সভ্যতা আসলে বেশ অস্থির সময় কাটাচ্ছে। বিচ্ছিন্ন যেকোনো ঘটনা সত্যিই পৃথিবীর গতি বদলে ফেলতে পারে, নতুন আকার দিতে পারে। এসব ব্যাংক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বা অন্য কারণে ক্ষতি হতে পারে। বরফ গলে যাচ্ছে, ইরাক ও আফগানিস্তানে জিন ব্যাংকের সংগ্রহ ধ্বংস হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে ফিলিপাইনের জাতীয় জিন ব্যাংক বন্যায় ডুবে যায়। আমরা সব প্রাণীর প্রজাতি থেকে ৫০টি করে নমুনা সংরক্ষণ করতে চাচ্ছি।’

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান