৩০ নভেম্বর বাঙালি জ্ঞানতাপস, আচার্য স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্মদিন। তিনি একই সঙ্গে ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, উদ্ভিদবিদ এবং বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের পথিকৃৎ। উপমহাদেশে ব্যবহারিক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা তাঁর হাত ধরেই হয়েছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে তাঁর অবদান বহুমুখী। ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার্স (আইইই) তাঁকে বেতারবিজ্ঞানের অন্যতম জনক হিসেবে অভিহিত করে।
১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলা) বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে জগদীশ চন্দ্র বসুর পরিবারের আদি নিবাস হলেও তাঁর জন্ম হয় ময়মনসিংহ জেলায়। তাঁর পিতা ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তিনি জগদীশ চন্দ্রকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি না করিয়ে গ্রামের একটি বাংলা বিদ্যালয়ে পাঠান। পিতার এই সিদ্ধান্ত জগদীশ চন্দ্রের মনে দেশপ্রেম ও মাতৃভাষার প্রতি বিশেষ মমত্ববোধ জাগিয়ে তোলে, যা পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান প্রবন্ধ রচনায় তাঁকে উৎসাহিত করে।
কলকাতার হেয়ার স্কুল এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনার পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে পাড়ি দেন। সেখানে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন এবং প্রকৃতিবিজ্ঞানে স্নাতক হন।
১৮৮৫ সালে ভারতে ফিরে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। বৈষম্যের শিকার হয়ে ইউরোপীয় অধ্যাপকদের অর্ধেক বেতনে কাজ করলেও তাঁর গবেষণার উৎসাহে ভাটা পড়েনি।
১৮৯৪ সালের দিকে তিনি ব্যাপকভাবে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোনো তার ছাড়াই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা অর্জন করেন। তিনি তারহীন শব্দ প্রেরণের জন্য ক্রিস্টাল রিসিভার নামক বেতারযন্ত্র আবিষ্কার করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রায় এক মাইল দূরে অবস্থিত তাঁর বাসভবনে সাংকেতিক শব্দ প্রেরণ করে দেখান।
তাঁর এই গবেষণা আধুনিক তারবিহীন যোগাযোগব্যবস্থা বা রেডিওপ্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে। যদিও তিনি তার আবিষ্কারের বাণিজ্যিক পেটেন্ট নিতে আগ্রহী ছিলেন না, তবুও তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতি রাডারপ্রযুক্তি উন্নয়নের প্রাথমিক ধাপের যন্ত্রপাতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্যপূর্ণ।
জগদীশ চন্দ্রের গবেষণার দ্বিতীয় এবং আরও আলোচিত দিকটি হলো উদ্ভিদ জগৎ। তিনি বিজ্ঞানীদের সামনে প্রমাণ করেন, উদ্ভিদেরও প্রাণীর মতোই সংবেদনশীলতা রয়েছে; তারা ব্যথা ও আনন্দ অনুভব করতে পারে।
এই সংবেদনশীলতা প্রমাণ করার জন্য তিনি ক্রেসকোগ্রাফ নামে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে ১০ হাজার গুণ পর্যন্ত বড় করে নিখুঁতভাবে পরিমাপ করতে সক্ষম ছিল। তিনি বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে উদ্দীপকের প্রতি উদ্ভিদের সাড়া প্রদান একটি জৈব প্রক্রিয়া। তাঁর এই আবিষ্কার জীব ও জড়ের মধ্যকার আপাতপার্থক্যকে অনেকটাই ঘুচিয়ে দেয়।
১৯১৭ সালে তিনি উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব নিয়ে গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কলকাতায় বসু বিজ্ঞানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞান গবেষণার জন্য দেশীয় বিজ্ঞানী তৈরি করা এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানকে একত্র করা। জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিজ্ঞানী। তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নাইটহুড এবং রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ লাভ করেন। এমনকি তাঁর সম্মানে চাঁদের একটি খাদের নামকরণও করা হয়েছে।
‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’ জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা একটি কল্পবিজ্ঞান গল্প, যা ১৮৯৬ সালে কুন্তলীন পুরস্কার প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে। এটি পরে ‘পলাতক তুফান’ নামে ‘অব্যক্ত’ নামক সংকলনে পুনঃপ্রকাশিত হয়। তার এই লেখাকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিসেবে গণ্য করা হয়।
সূত্র: ব্রিটানিকা