৩ লাখ বছর আগের মানুষের পায়ের ছাপ আবিষ্কার

৩ লাখ বছর আগের মানুষের পায়ের ছাপের সন্ধান মিলেছে জার্মানির শোনিনজেন এলাকায়।সাই নিউজ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শতবর্ষ আগে গেয়েছিলেন, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে’। পায়ের চিহ্ন কিন্তু হারিয়ে যায় না। তেমনি এক পায়ের চিহ্নের রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছেন এক জার্মান গবেষক। আধুনিক মানুষের আদিপুরুষ হিসেবে খ্যাত নিয়ান্ডারথাল। তাদের পূর্বপুরুষ হোমো হাইডেলবার্জেনেসিস গোষ্ঠীর তিনটি পায়ের চিহ্নের সন্ধান মিলেছে। শুধু তা–ই নয়, অনেক প্রাচীন হাতি আর তৃণভোজী প্রাণীর পায়ের চিহ্নেরও দেখা মিলেছে জার্মানির শোনিনজেন এলাকায়। উত্তর জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনির অংশ এই এলাকা মধ্য প্লেইস্টোসিন সময়ের নির্দশন সন্ধানের জন্য আলোচিত।

এসব পায়ের চিহ্ন তিন লাখ বছর আগের, এ কথা শুনে চমকে যেতে পারেন। তবে গবেষকেরা এমনটাই জানাচ্ছেন। জার্মানির টাবিঞ্জেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফ্লাভিও আলটামুরা জানান, শোনিনজেন এলাকার দুই জায়গায় পায়ের চিহ্নের দেখা মেলে। প্রথমবারের মতো আমরা পায়ের চিহ্ন ধরে গবেষণা করছি। তিন লাখ বছর আগে এই অঞ্চলের পরিবেশ এমনই ছিল। ২৫ লাখ বছর থেকে ১১ হাজার ৭০০ বছর আগের সময়কে প্লেইস্টোসিন সময় বলা হয়। পায়ের চিহ্ন ধরে আমরা সেই সময়কার পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জলবায়ুর বিভিন্ন বিষয়কে জানার চেষ্টা করছি।

যাঁদের পায়ের চিহ্নের সন্ধান মিলেছে, তাঁরা তিনজনই তরুণ বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। পূর্বপুরুষ এই হোমো হাইডেলবার্জেনেসিস দলের সদস্যদের বসবাস ছিল স্থানীয় হ্রদের আশপাশেই। পরবর্তী সময়ে পূর্বপুরুষ হোমো হাইডেলবার্জেনেসিস থেকেই প্রাথমিক নিয়ান্ডারথালদের বিকাশ ঘটে। সেই সময় ইউরোপ কেমন ছিল, তা জানার উদ্দেশ্য থেকেই গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। সেই সময় হ্রদের আশপাশে বিভিন্ন তৃণ, ফল, মাশরুমসহ নানা খাবারের সন্ধান মিলত। এই পায়ের চিহ্নের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পায়ের ছাপ দেখা যায়। এসব চিহ্ন থেকে বিজ্ঞানীরা সেই সময়কার মানুষের সঙ্গে হাতি ও অন্যান্য স্তন্যপায়ীর কেমন সম্পর্ক ছিল, তা জানার চেষ্টা করছেন। পায়ের চিহ্নের ধরন থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই পায়ের মালিকেরা হয়তো ঘোরাঘুরির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন। বেড়ানোর সময় তাঁদের পায়ের ছাপ পড়ে যায় নরম মাটিতে। এখানে যে হাতির পায়ের ছাপের দেখা মেলে, সেটির দৈর্ঘ্য ৫৫ সেন্টিমিটার। এ ছাড়া গন্ডারের পায়ের ছাপের সন্ধান মিলেছে। পায়ের চিহ্ন নিয়ে কোয়াটারন্যারি সায়েন্স রিভিউতে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে গবেষক দল।
সেই কোনো এক ফাল্গুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি/ যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।’ আসলে তো হোমো হাইডেলবার্জেনেসিসদের পায়ের ছাপ পড়ে আছে হ্রদের ধারে, আর সেই সোনার তরী হারিয়ে গেছে মহাকালের অন্তর্জালে।

হোমো হাইডেলবার্জেনেসিস গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে হোমো ইরেক্টাস গোষ্ঠী থেকে। হোমো হাইডেলবার্জেনেসিসদের হোমো সেপিয়েন্স ও হোমো নিয়ান্ডারথালদের সরাসরি পূর্বপুরুষ হিসেবে মনে করেন অনেক বিজ্ঞানী। এই গোষ্ঠীর সদস্যদের মস্তিষ্কের আকার ১ হাজার ২০০ ঘনসেন্টিমিটার ছিল। নিয়ান্ডারথালদের মতোই হোমো হাইডেলবার্জেনেসিসদের বুক প্রশস্ত ছিল।

জীবনযাত্রা বিশ্লেষণ করে অনেক নৃবিজ্ঞানী মনে করেন, হোমো হাইডেলবার্জেনেসিসরা বেশ ভালো শিকারি ছিল। শিকারি হওয়ার কারণে তাদের খাদ্যাভাসে মাংসনির্ভরতা খেয়াল করা যায়। হোমো হাইডেলবার্জেনেসিসের দাঁতের গড়ন দেখে গবেষকদের ধারণা, তারা প্রাথমিকভাবে কথা বলার মাধ্যমে যোগাযোগ করত। যদিও আধুনিক মানুষের মতো কথা বলতে পারত কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। হাইডেলবার্জেনেসিস গোষ্ঠী আগুনের ব্যবহার জানত। এ ছাড়া কাঠের তৈরি বর্ষা ব্যবহার করে তারা শিকার করত বলে ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের নানান জায়গায় তেমন নিদর্শন পাওয়া গেছে।
সূত্র: সাই নিউজ অবলম্বনে