আলোর বুলেট এবং আইনস্টাইন

আলো কী? কণা, নাকি তরঙ্গ? বিজ্ঞানের আগের সব ধ্যান-ধারণা বদলে দিতে এসেছেন এক তরুণ। আলবার্ট আইনস্টাইন। আলোর প্রমাণিত তরঙ্গ তত্ত্বের বেড়াজাল ভেঙে, একরকম নিজের বিশ্বাসের বিপরীতে গিয়েই তিনি অদ্ভুত এক দাবি করে বসলেন। বিজ্ঞানের ইতিহাস বদলে দেওয়া সেই কাহিনি…

শুক্রবার, শীতের সকাল। ১৯০৫ সালের ৭ মার্চ। ঘড়ির কাঁটা ৮টা ছুঁই ছুঁই। কর্মব্যস্ত লোকজন ছুটছে নিজ নিজ গন্তব্যে। যেকোনো মুহূর্তে বার্ন শহরের সিগ্লোগকা নামের ক্লক টাওয়ারের ঘণ্টা বেজে উঠবে ঢং ঢং আওয়াজে। সচকিত হয়ে উঠবে আশপাশের লোকজন।

সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরের এই ক্লক টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল সেই মধ্যযুগে। নামকরা ক্যামগ্যাছে এলাকায় সটান দাঁড়িয়ে শাসন করে চলেছে গোটা শহর। এখান থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে পুরোনো ধাঁচের একটা চারতলা বাড়ি। ঠিকানা ৪৯ ক্যামগ্যাছে। সেই বাড়ির সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলা থেকে হন্তদন্ত হয়ে নিচে নেমে এলেন এক যুবক। তাঁর এক হাতে একটা খাম। শক্ত করে আঁকড়ে ধরা। যেন মহামূল্যবান বস্তুটা কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চান না।

যুবকের গায়ে চেক স্যুট। পায়ে জুতার বদলে জরাজীর্ণ এক জোড়া চপ্পল। সবজে রঙের, তার ওপর ফুল এমব্রয়ডারি করা। ভীষণ ব্যস্ততায় হয়তো সময়মতো জুতাজোড়া খুঁজে পাননি কিংবা জুতা নাকি চপ্পল, এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই তাঁর।
ক্যামগ্যাছে স্ট্রিটের পাকা রাস্তায় মধ্যযুগীয় তোরণ দাঁড়িয়ে আছে সারবদ্ধভাবে।

সেগুলো ভেদ করে যুবক এগিয়ে যেতে লাগলেন সামনে। সুইস রাজধানীর সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা বলা হয় একে। কিন্তু সে পথে যুবকের এহেন বেমানান বেশভূষা দেখে যেকোনো পথচারীর ভ্রু কুঁচকে যাওয়ার কথা। তবে কারও ভ্রুকুটি খেয়াল করার সময় নেই যুবকের। হেঁটে চলেছেন নিজের চিন্তায় বুঁদ হয়ে। ৮টার মধ্যেই তাঁকে অফিসে পৌঁছাতে হবে। তার আগে চিঠিটা দিতে হবে পোস্ট অফিসে। হাতের খামটা যে এখনই পাঠাতে হবে জার্মানিতে! রাজধানী বার্লিনে। খুব জরুরি। খামের ওপর প্রাপকের ঠিকানা লেখা অ্যানালেন ডার ফিজিক জার্নালের প্রকাশকের। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী সে জার্নাল। কেউ জানে না, খামের ভেতরের ওই চিঠি অচিরেই মোড় ঘুরিয়ে দিতে যাচ্ছে গোটা বিজ্ঞানজগতের।

বার্ন শহরের বুকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলা সেই যুবকের নাম আলবার্ট আইনস্টাইন।

২.

মাত্র তিন দিন আগে ২৬ বছর বয়সে পা দিয়েছেন আইনস্টাইন। বাবা হয়েছেন ১০ মাস আগে। ক্যামগ্যাছের ওই বাড়িতে দুই কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটে স্ত্রী মেলিভা আর ছেলে হ্যান্স অ্যালবার্টকে নিয়ে আইনস্টাইনের সংসার। টেকনিক্যাল ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেন সুইস পেটেন্ট অফিসে। কারিগরি বিশেষজ্ঞ। নামটা গালভারী হলেও পদ হিসেবে তা তৃতীয় শ্রেণির। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘পেটেন্ট স্লেভ’। এটি তাঁর স্বপ্নের চাকরি নয়। মাসে যে বেতন পান, তা দিয়ে সংসারও স্বচ্ছন্দে চলে না। কিন্তু দীর্ঘ বেকারত্ব আর সীমাহীন হতাশার পর চাকরিটা তাঁর জন্য মরূদ্যান।

আরেকভাবে দেখলে, এ চাকরি তাঁর জন্য অনেকাংশে শাপে বর হয়েছিল। কারণ, এর সুবাদে কিছু সুযোগ পান আইনস্টাইন। নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা ও নিজেকে বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ। পেটেন্ট অফিসে চাকরির কারণে যেকোনো উদ্ভাবনের পেছনের মৌলিক ভৌত নীতি খুঁজে বের করতে হতো তাঁকে। তাই পদার্থবিজ্ঞানের সমসাময়িক তত্ত্ব সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতে হতো। আবার অফিসে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নিত্যদিনের কাজের ফাঁকে বেশ কিছুটা সময় পেতেন নিজের জন্য। আলো ও গতি–সম্পর্কিত গভীর প্রশ্নগুলো নিয়ে মনোযোগ দিয়ে ভাবার সময় পেতেন পর্যাপ্ত। প্রায় সময় দেখা যেত, খুব দ্রুত কাজ শেষ করে নিজের আগ্রহের পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবছেন। অঙ্ক কষছেন নিবিষ্ট মনে। সময় কাটাচ্ছেন পদার্থবিজ্ঞানের সমসাময়িক তত্ত্ব বা সমস্যা নিয়ে। অবশ্যই সংগোপনে। পেটেন্ট অফিসের নিরিবিলি পরিবেশ তাঁর জন্য দারুণ কাজে লেগেছিল। নিজের ডেস্কটা রীতিমতো তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগার বানিয়ে ফেলেছিলেন আইনস্টাইন।

সে সময় পদার্থবিজ্ঞানের এ রকম এক অমীমাংসিত সমস্যা ছিল ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট। বাংলায় যাকে বলে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া। একদিন সেটা নজরে পড়ল আইনস্টাইনের। সমস্যাটার শুরু ১৮৮৭ সালের দিকে। সে বছর জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিক হার্জ আকস্মিকভাবে দেখলেন, আলো স্ফুলিঙ্গ তৈরি করতে পারে। তিনি খেয়াল করলেন, কোনো ধাতবপৃষ্ঠের ওপর অতিবেগুনি আলো ফেলা হলে সেখান থেকে ইলেকট্রন নিঃসৃত হয়। আরও ভালোভাবে বললে, আলোকরশ্মি কোনো ধাতব বস্তুতে আঘাত হানলে নির্দিষ্ট অবস্থায় অল্প পরিমাণ বৈদ্যুতিক প্রবাহের সৃষ্টি হয়। আলো ও বিদ্যুতের মধ্যে এ সম্পর্ককে বলা হয় ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট।

আধুনিক ইলেকট্রনিকসের পেছনেও রয়েছে এই নীতি। সোলার সেল বা সৌরকোষ সাধারণ সূর্যালোককে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করে। এই শক্তি আমাদের ক্যালকুলেটরে শক্তি জোগাতে ব্যবহার করা যায়। টিভি ক্যামেরা বস্তু থেকে আলোকরশ্মি নেয় এবং সেগুলো বৈদ্যুতিক প্রবাহে রূপান্তর করে। সেটাই দেখা যায় টিভি স্ক্রিনে। রিমোট কন্ট্রোলও কাজ করে এ প্রভাবের ওপর ভর করে। তবে এসব জানা গেছে অনেক পরে। ওই শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে ব্যাপারটি ছিল পুরো রহস্যে মোড়া। গবেষণার জন্য বিষয়টি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিষয়টি নিয়ে একাধারে জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেম হলওয়াচস ও ফিলিপ লেনার্ড, ইতালির বিজ্ঞানী অগাস্ট রিঘি, ব্রিটেনের জে জে থমসন এবং রাশিয়ার আলেকজান্ডার স্টোলেটোভসহ আরও কজন বিজ্ঞানী পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। পরীক্ষায় প্রমাণ মিলল, কোনো একভাবে আলোকরশ্মি ধাতব বস্তু থেকে ইলেকট্রন ধাক্কা দিয়ে বের করে আনছে। লাখ টাকার প্রশ্ন হলো, ঘটনা ঘটছে কীভাবে?

সে উত্তর জানার আগে জানতে হবে আলোর চরিত্র সম্পর্কে।

ধাতব পাতে আলোকরশ্মির ধাক্কায় পরমাণু থেকে ইলেকট্রন ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে

৩.

বিজ্ঞানের জগতে আলো নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। বিতর্কের বিষয় হলো আলো কি কণা, নাকি তরঙ্গ? সপ্তদশ শতকে আলোকে কণা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন। সে যুগে অনেকেই তাঁর মতবাদ মেনে নেন। তবে বিতর্ক বাধে কিছুদিন পরে। ডাচ পদার্থবিদ ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস আলোকে ব্যাখ্যা করেন তরঙ্গ হিসেবে। নিউটনের সমসাময়িক বিজ্ঞানী রবার্ট হুকসহ আরও কজন বিজ্ঞানী ছিলেন তরঙ্গ তত্ত্বের পক্ষে। দুই পক্ষের তুমুল বিতর্কের মধ্যেও টিকে যায় কণা তত্ত্ব। কারণ, বিজ্ঞানীদের মধ্যে নিউটনের প্রবল দাপট। তাই আলোর কণা তত্ত্ব রাজত্ব করে দীর্ঘদিন।

১৮০১ সালের দিকে আলো নিয়ে একটা পরীক্ষায় নড়বড়ে হয়ে পড়ে কণা তত্ত্ব। ভারী হয়ে ওঠে তরঙ্গ তত্ত্বের পাল্লা। পরীক্ষাটি করেন নিউটনের স্বদেশি বিজ্ঞানী থমাস ইয়ং। সেটি ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট বা দ্বিচিড় পরীক্ষা নামে পরিচিত। পরীক্ষায় দেখা গেল, আলো আচরণ করছে পানিতে ঢেউয়ের মতো। ফলে আলোর তরঙ্গ ধর্ম অস্বীকার করার কোনো উপায় রইল না। এরপর আলোর কণা তত্ত্বের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। তাত্ত্বিকভাবে আলোকে বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ হিসেবে প্রমাণ করেন তিনি। পদার্থবিদেরা এরপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, আলো একধরনের তরঙ্গ। ধ্রুব সত্যের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল তা। সে ধারণা দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হলো ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট সমস্যার।
তরঙ্গ তত্ত্ব অনুযায়ী এর শক্তি ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্কের অধীন নয়, যেমন লাল ও সবুজ আলোর কম্পাঙ্ক আলাদা হলেও তাদের শক্তি একই হওয়া উচিত বলে ধারণা করা হলো। তাই এসব আলো যখন কোনো ধাতব খণ্ডে আঘাত হানে, তখন তারা যে কটি ইলেকট্রন নির্গত করে, তার পরিমাণও একই হওয়া উচিত। একইভাবে চিরায়ত তরঙ্গ তত্ত্ব অনুসারে, বাতি বা আলোক উৎসে আলোকরশ্মির তীব্রতা বাড়ানো হলে নির্গত ইলেকট্রনের শক্তিও বাড়া উচিত।

আবার এ তত্ত্ব বলে, আলো নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি বহন করে, যা তার বিস্তারের বর্গের সমানুপাতিক (বিস্তার মানে তরঙ্গের আকার বা আলোর উজ্জ্বলতা)। কোনো বস্তু, বিশেষ করে ধাতব বস্তুর ওপর আলো ফেললে তা এই শক্তি শোষণ করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ধাতুর মধ্যে অতিরিক্ত শক্তি ইলেকট্রনে স্থানান্তরিত হয়। ইলেকট্রন পর্যাপ্ত শক্তি অর্জন করলে তা ধাতু থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায়। ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করলেন, ধাতুর ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর মধ্যে আবদ্ধ থাকে। তাই পরমাণু থেকে কোনো ইলেকট্রনকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে হলে অবশ্যই তাকে কিছুটা শক্তি অর্জন করতে হবে। প্রাথমিক এই শক্তির বাধা অতিক্রম করার পর আরও বেশি আলো প্রয়োগ করলে ইলেকট্রনে আরও বেশি শক্তি স্থানান্তরিত হওয়া উচিত, যতক্ষণ না আলো থেকে শোষিত শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তি নিয়ে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসছে (ধাতু থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি বিয়োগ হবে)।

এখান থেকে তিনটি অনুমান করা যায়। প্রথমত, ধাতবপৃষ্ঠে উজ্জ্বল আলো ফেললে ইলেকট্রন দ্রুত বেরিয়ে আসা উচিত। বিজ্ঞানীরা যুক্তি দেখালেন, ধাতুর ওপর ফেলা আলো যত শক্তিশালী হবে, ইলেকট্রন তত বেশি শক্তি পাবে। তাই ইলেকট্রনগুলো ধাতু থেকে তত দ্রুতবেগে বেরিয়ে যাবে। বিষয়টি বেশ যৌক্তিক বলে মনে হয়। দ্বিতীয়ত, আলো যদি যথেষ্ট ম্লান হয়, তাহলে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসতে কিছুটা দেরি হওয়ার কথা। কারণ, তার বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ম্লান আলো থেকে ধীরে ধীরে জমা হতে থাকবে। এরপর ইলেকট্রনটি ধাতু থেকে কম গতিতে বেরিয়ে যাবে। তৃতীয়ত, ধাতু থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ইলেকট্রনের শক্তি শোষণ করতে হয়। কাজেই ধাতুর তাপমাত্রা কমবেশি হলে ফলাফলও ভিন্ন কিছু পাওয়া উচিত।

ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করায় ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার পান আলবার্ট আইনস্টাইন

এদিকে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে জে থমসন অনুমান করলেন, কম তাপমাত্রার চেয়ে উচ্চ তাপমাত্রায় ধাতুতে ইলেকট্রনের শক্তি বেশি থাকবে, এবং ধাতু থেকে সহজে ও উচ্চ গতিতে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসবে। কিন্তু মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিকানের পরীক্ষায় বিষয়টি ভুল বলে প্রমাণিত হলো। দেখা গেল, ধাতুর তাপমাত্রার সঙ্গে ইলেকট্রনের বেরিয়ে আসার কোনো সম্পর্ক নেই (এ বিষয়ে পরে আসছি)।

১৯০২ সালে হাঙ্গেরিতে জন্ম নেওয়া পদার্থবিদ ফিলিপ লেনার্ড কাজ করছিলেন জার্মানিতে। দেশটির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ সময় তিনি বিভিন্ন ধাতুতে আলোর এই প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন। নির্দিষ্ট কিছু ধাতুতে আলট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মি ফেলে বিটা রশ্মি নিঃসৃত হতে দেখলেন। মানে ইলেকট্রন নিঃসরণ।

নির্দিষ্ট কোনো ধাতুর ওপর অতিবেগুনি রশ্মি ফেলে ওই ধাতু থেকে নির্গত ইলেকট্রনের সংখ্যা এবং তাদের গতির ওপর অতিবেগুনি রশ্মির কম্পাঙ্ক ও তীব্রতা কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা করলেন লেনার্ড। ঝামেলার শুরু এখানে। বেশ কিছু পরীক্ষায় দেখা গেল, আলোর তরঙ্গ তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষার ফলাফল মিলছে না। প্রথম অনুমানের কথা ভাবুন: আলো যত উজ্জ্বল, ইলেকট্রন তত দ্রুতবেগে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু লেনার্ড অবাক বিস্ময়ে দেখলেন আলোর উজ্জ্বলতা বা তীব্রতার সঙ্গে ইলেকট্রনের শক্তি বা গতিবেগের কোনো সম্পর্ক নেই; বরং নির্গত ইলেকট্রনের শক্তি কম্পাঙ্ক বা আলোকরশ্মির রঙের ওপর নির্ভরশীল। এটি আলোর তরঙ্গ তত্ত্বের অনুমানের একেবারে বিপরীত। তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষা কোনোভাবেই খাপ খায় না।

সমস্যা বোঝার জন্য একটি উপমা দেওয়া যাক। কল্পনা করা যাক, একটি সাগরের বালুতীরে ছোট কিছু নুড়িপাথর পড়ে আছে এলোমেলোভাবে। একমুহূর্তের জন্য বালুকাময় সৈকতকে ভেবে নিন ধাতবপৃষ্ঠ এবং নুড়িগুলোকে ইলেকট্রন। আর সাগর থেকে ধেয়ে আসা ঢেউগুলোকে ভাবুন অতিবেগুনি আলোর তরঙ্গ, যা তীরে এসে সজোরে আছড়ে পড়ছে। আমাদের কল্পনার এ সৈকত কিছুটা ঢালু। সৈকত থেকে ক্রমে উঁচু হয়ে গেছে বালুকাবেলা। তাই সাগরের তীর থেকে নুড়িগুলো দূরে ঠেলে দিতে মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। স্রেফ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারবেন, সাগরের ঢেউ যত বড় হবে, নুড়িপাথরে তত বেশি শক্তি এসে ধাক্কা দেবে।

আবার তীরে তথা নুড়িতে যত বেশিবার ঢেউ আছড়ে পড়বে, ঢাল বেয়ে ওপরে উঠে যাবে তত বেশি নুড়ি। ঢেউয়ের বিস্তার, মানে ঢেউয়ের উচ্চতা কম হলে, একটা নুড়িপাথর সরাতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, তখন দরকার হবে অনেক বেশি ঢেউ। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, লেনার্ড যে পরীক্ষাগুলো করেছিলেন, তার ফলাফলে এমন কিছু পাওয়া গেল না। তাহলে কি তরঙ্গ তত্ত্বে ঘাপলা আছে?

কোয়ান্টাম তত্ত্বের সারকথা পড়ে শুরুতে তাল সামলাতে পারেননি খোদ আইনস্টাইনও। তাঁর নিজের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল বলে মনে হয়েছিল। কারণ, প্ল্যাঙ্কের কথামতো শক্তি যদি কোয়ান্টা বা কণা দিয়ে গঠিত হয়, তাহলে ম্যাক্সওয়েলের আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব কীভাবে ঠিক হয়?

আগেই বলেছি, লেনার্ড দেখতে পান, আলোর তীব্রতা বাড়িয়ে ধাতু থেকে ছিটকে বেরোনো ইলেকট্রনের গতি বাড়ছে না। তবে প্রতি সেকেন্ডে নিঃসৃত ইলেকট্রনের পরিমাণ বাড়ছে। সমস্যা হলো, তরঙ্গ তত্ত্ব অনুসারে প্রতি সেকেন্ডে ইলেকট্রনের সংখ্যা বাড়ার কথা আলোর তরঙ্গের কম্পাঙ্কের ওপর নির্ভর করে।

পরীক্ষায় আরও দেখা গেল, আলোর কম্পাঙ্ক যদি একটা নির্দিষ্ট মানের নিচে থাকে (যা বিভিন্ন ধাতুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম), তাহলে কোনো ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে না, আলোর তীব্রতা যা–ই হোক না কেন। সাগরের ঢেউ বা নুড়ির উপমার ক্ষেত্রে তার মানে দাঁড়াচ্ছে, প্রতি সেকেন্ডে ঢেউয়ের চূড়ার সংখ্যা যদি একটি নির্দিষ্ট মানের নিচে থাকে, তাহলে সুনামির ধাক্কাতেও সৈকত থেকে নুড়িপাথর নড়ানো সম্ভব নয়। কাজেই এখানে আলোর কম্পাঙ্ক শেষ কথা। অর্থাৎ ধাতু থেকে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসবে কি আসবে না, তা নির্ভর করে আলোর কম্পাঙ্কের ওপর। সাগরের উপমার ক্ষেত্রে বলা যায়, তরঙ্গ শীর্ষ সংখ্যা যদি প্রতি সেকেন্ডে একটি নির্দিষ্ট সীমার ওপরে থাকে, তাহলে খুব কম বিস্তারের মৃদু ঢেউও সৈকতের নুড়িগুলো ওপরের দিকে ঠেলে তুলতে পারবে। আর আলোর কম্পাঙ্ক যদি এই সীমার ওপরে থাকে, তাহলে ধাতু থেকে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসবে সঙ্গে সঙ্গে। তখন একটুও দেরি হবে না। আলোর তীব্রতা কম হলেও তা ঘটবে। আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার এমন ফলাফল আলোর তরঙ্গ তত্ত্ববাদীদের মাথায় ঢুকল না। বিষয়টি অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে ঝুলে রইল বেশ কয়েক বছর। ঠিক এ সময় মঞ্চে এলেন আইনস্টাইন। তাঁর কাছে একটা ব্যাখ্যা। কিন্তু সেটা বৈপ্লবিক। অবিশ্বাস্যও বটে।

৪.

আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার সমস্যা আইনস্টাইনের মনে ধরেছিল বেশ আগে। গবেষণার জন্য দারুণ একটা বিষয়। বেশ কিছুদিন তা নিয়ে ভাবতে থাকেন তিনি। তরঙ্গ তত্ত্ব দিয়ে যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, তা–ও জানতে বাকি রইল না। এ সময় একটি আলোর দেখা পান। বলা যায়, বিষয়টি ব্যাখ্যার বিকল্প সম্ভাবনা। আর সে সমাধান খুঁজে পান জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাঙ্ক প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভেতর।

মাত্র পাঁচ বছর আগে, ১৯০০ সালে বার্লিনে কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান থেকে আমূল সরে আসতে বাধ্য হন তিনি। সে জন্য অনুমান করে নেন, শক্তির পরিমাণ তরলের মতো মসৃণ বা নিরবচ্ছিন্ন নয়, বরং তা নির্দিষ্ট, বিচ্ছিন্ন প্যাকেট হিসেবে ঘটে। অর্থাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার মতো। প্ল্যাঙ্ক এ বিচ্ছিন্ন প্যাকেটের নাম দেন কোয়ান্টা (একবচনে কোয়ান্টাম)। শক্তির প্রতিটি কোয়ান্টাম তার কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। এ সমানুপাতিক ধ্রুবকটি ছিল প্রকৃতির নতুন এক ধ্রুবক, যাকে এখন বলা হয় প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক। তবে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে সিরিয়াসভাবে নেননি সমসাময়িক কোনো পদার্থবিজ্ঞানী। একটি সমীকরণকে প্রতিষ্ঠিত করতে জোড়াতালি দেওয়া একটি তত্ত্ব হিসেবে মনে করতেন সবাই।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের সারকথা পড়ে শুরুতে তাল সামলাতে পারেননি খোদ আইনস্টাইনও। তাঁর নিজের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল বলে মনে হয়েছিল। কারণ, প্ল্যাঙ্কের কথামতো শক্তি যদি কোয়ান্টা বা কণা দিয়ে গঠিত হয়, তাহলে ম্যাক্সওয়েলের আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব কীভাবে ঠিক হয়? বিজ্ঞানীদের কাছে ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুচ্চুম্বকীয় তরঙ্গই তখন ধ্রুব সত্যের মতো। তাই আইনস্টাইনের কাছে প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব এক অর্থে ছিল ধর্মদ্রোহিতার শামিল।

১৯৩১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালটেকে আইনস্টাইনের সঙ্গে বিজ্ঞানী আলবার্ট মাইকেলসন এবং রবার্ট মিলিকান

আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব দিয়ে ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, তা–ও প্রমাণিত সত্য। সে কথা আগেই বলেছি। তাই শেষ অস্ত্র হিসেবে প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহারের চেষ্টা করলেন আইনস্টাইন। তিনি কারণ দর্শালেন, প্ল্যাঙ্কের তত্ত্ব অনুসারে স্বাভাবিকভাবে শক্তি হিসেবে আলোও কণা দিয়ে গঠিত হওয়া উচিত। তাই শক্তি যদি বিচ্ছিন্ন প্যাকেট হিসেবে ঘটে, তাহলে আলো নিজেও অবশ্যই কোয়ান্টায়িত হবে। মোটকথা, আইনস্টাইন দাবি করেন, আলো, তথা বিদ্যুচ্চুম্বকীয় বিকিরণ তরঙ্গ নয়, বরং কণার মতো কোয়ান্টা। আইনস্টাইন এর নাম দেন লাইট অব কোয়ান্টা। পরে লাইট কোয়ান্টার প্যাকেট বা আলোর কণার নাম দেওয়া হয় ফোটন। আরও প্রায় দুই দশক পর, ১৯২৬ সালে রসায়নবিদ গিলবার্ট লুইস এ নামকরণ করেন। আইনস্টাইন বললেন, ফোটনের শক্তি যদি তার কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক হয়, তাহলে নিঃসৃত ইলেকট্রনের শক্তিও তার কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক হবে, যা চিরায়ত পদার্থবিদ্যার বিপরীত ধারণা।

আইনস্টাইনের ব্যাখ্যাটা সরলভাবে বুঝতে আবারও সাগরের ঢেউ আর নুড়িপাথরের উপমায় ফেরা যাক। লেনার্ডের পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাখ্যাও পাওয়া যাবে এখান থেকে। এর আগে আমরা কল্পনায় ধরে নিয়েছিলাম, সাগরের নিরবচ্ছিন্ন ঢেউ ধীরে ধীরে নুড়িগুলোকে ধাক্কা দিয়ে ওপরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার বদলে যদি ধরে নিই, নুড়িগুলো ধাক্কা দিচ্ছে সৈকতে থাকা কোনো মেশিনগানের বুলেট, তাহলে কী হবে? আলো যদি আইনস্টাইনের কথামতো একগুচ্ছ ফোটন কণা হয়, তাহলে আলোর উজ্জ্বলতা নির্ধারিত হবে প্রতি সেকেন্ডে কোনো এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়া ফোটনের সংখ্যার ওপর। এটি মেশিনগানের ক্ষেত্রে প্রতি সেকেন্ডে বুলেট ছোড়ার হারের সমতুল্য। অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে বেশি বুলেটের মানে আলোর উজ্জ্বলতাও বেশি।

সেকেন্ডে একটি বুলেট মানে আলোর উৎস দুর্বল। উজ্জ্বলতা কম। আর সেকেন্ডে ঝাঁকে ঝাঁকে—শত শত, হাজার হাজার বা লাখ লাখ বুলেট ছোড়ার মানে উজ্জ্বল আলো। এ উপমার ক্ষেত্রে ফোটনের শক্তি হবে বুলেটের গতির সমতুল্য। এখানে ধরে নিচ্ছি, আমাদের মেশিনগানটা বুলেটের গতিও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই নিরবচ্ছিন্ন সাগরের ঢেউয়ের বদলে যদি মেশিনগানের বুলেট ছোড়া হয়, তাহলে লেনার্ডের পরীক্ষার ফলাফলের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

পরীক্ষায় তিনি দেখেছেন, আলোর উজ্জ্বলতা যত বেশি, ধাতু থেকে তত বেশি ইলেকট্রন ছিটকে বেরিয়ে আসে। আগেই বলেছি, মেশিনগানের উপমায়, উজ্জ্বল আলো মানে সেকেন্ডে বেশি বেশি বুলেট। ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট। এসব বুলেটই নুড়িপাথরগুলোকে সেকেন্ডে বেশি বেশি ধাক্কা দেবে। বুলেটরূপী আলোর ক্ষেত্রে ধাতুতে ফেলা আলো ও ধাতু থেকে ইলেকট্রনের বেরিয়ে আসার মধ্যে সময়ে তফাত থাকবে না। তখন সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসবে। কারণ, নুড়িপাথরে একবার একটা বুলেট ধাক্কা দিলে, সৈকতের ওপরের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য তার পর্যাপ্ত শক্তি থাকবে। তাই প্রভাব পাওয়া যাবে তৎক্ষণাৎ। বুলেটগুলো যত দ্রুত ছুটে যাবে, সেগুলো নুড়িতে তত বেশি জোরে ধাক্কা দেবে। ফলে নুড়িগুলো দ্রুত সময়ে সৈকতের ওপরের দিকে উঠে যাবে। মানে প্রতিটি আলোক ফোটনের শক্তি যত বেশি হবে, তার ইলেকট্রন ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার গতিশক্তিও হবে তত বেশি। আবার বুলেটগুলোর গতি কম হলে, তা নুড়িগুলোতে ধাক্কা দেবে ঠিকই, কিন্তু ধাক্কাটা নুড়িগুলোকে সৈকতের ওপরে তোলার মতো যথেষ্ট হবে না। বোঝা গেল ব্যাপারটা?

সেদিন, মানে সেই ১৯০৫ সালের ৭ মার্চ, শুক্রবার আলোকতড়িৎ ক্রিয়া–সংক্রান্ত গবেষণাপত্র হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে পোস্ট অফিসে ছুটছিলেন আইনস্টাইন। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম—অন আ হেরিস্টিক পয়েন্ট অব ভিউ কনসার্নিং দ্য প্রোডাকশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন অব লাইট।

কয়েক দিনের মধ্যে পৌঁছায় চিঠিটা বার্লিনে অ্যানালেন ডার ফিজিক জার্নাল অফিসে। জার্নালটির সম্পাদক তখন কোয়ান্টাম গুরু ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। আইনস্টাইনের গবেষণাপত্র আগাগোড়া পড়ে দেখলেন তিনি। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন আরও তিনটি গবেষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন ওই জার্নালে। এর মধ্যে ছিল আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে একটি প্রবন্ধ। সেটি পড়ে তাঁকে ‘খুব বৈপ্লবিক’ বলে আখ্যায়িত করেন প্ল্যাঙ্ক। বৈপ্লবিক তত্ত্বটির নাম ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’ দিয়েছিলেন তিনিই। কিন্তু গোল বাধল আইনস্টাইনের আলোর কোয়ান্টা ধারণা নিয়ে। নিজে কোয়ান্টা ধারণার প্রবর্তক হলেও আলোর কোয়ান্টা ধারণা প্ল্যাঙ্কের কাছে সাময়িক গাণিতিক সমাধান ছাড়া আর কিছু মনে হলো না। আলোর কণা তত্ত্বের সঙ্গে কোনোভাবেই একমত হতে পারলেন না তিনি। তবু গবেষণাপত্র জার্নালে প্রকাশের অনুমতি দেন প্ল্যাঙ্ক। ভাবেন, ‘বার্নের এই শৌখিন পদার্থবিদ কে, যিনি হুট করে এমন চমৎকার ও বেপরোয়া তত্ত্বগুলো প্রকাশ করছেন?’

আইনস্টাইনের এই ঐতিহাসিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলো প্রায় তিন মাস পর। ১৯০৫ সালের ৯ জুন। শিরোনাম আগেই বলেছি। এর মাধ্যমে জন্ম হলো ফোটন ও আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের।

আইনস্টাইনের আলোর কোয়ান্টার ধারণা ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টকে বেশ ভালোভাবে ব্যাখ্যা করল ঠিকই, কিন্তু তা কেউ মেনে নিতে পারলেন না। ম্যাঙ্ক প্ল্যাঙ্কের মতো অন্য আরও বিজ্ঞানী একে মনে করলেন গাঁজাখুরি ব্যাখ্যা। বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইলেন না কেউ কেউ। তবে তাঁদের মধ্যে একেবারে ব্যতিক্রম ছিলেন একজন। আইনস্টাইনের ব্যাখ্যা কোনোভাবে মেনে নিতে পারলেনই না, সেটা যে ভুল ব্যাখ্যা, তা–ও হাতেনাতে প্রমাণের জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। তিনি মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিকান।

৫.

এক্সপেরিমেন্টাল পদার্থবিদ রবার্ট মিলিকানের জন্ম ১৮৬৮ সালের ২২ মার্চ, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের মোরিসনে। ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট–সংক্রান্ত আইনস্টাইনের গবেষণাপত্র জার্নালে যখন প্রকাশিত হয়, তখন মিলিকানের বয়স প্রায় ৩৭ বছর। আইনস্টাইনের চেয়ে প্রায় ১১ বছরের বড়। তখন শিকোগো বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৮৬ সালে যোগ দেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মনমতো গবেষণার মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি দাগ রেখে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল মিলিকানের অনেক দিনের। কিন্তু শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গবেষণাগারে তখন উপযুক্ত সরঞ্জামের অভাব। সেখানে তখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। পৌঁছাবে আরও ২০ বছর পরে। গ্যাস ল্যাম্প কিংবা মোমবাতি ভরসা। সেখানে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানও নেই, যারা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বানিয়ে দিতে পারবে। প্রয়োজনীয় সবকিছু নিজে বানিয়ে নিতে হবে। আবার তিনি যে বিষয়ে গবেষণা করতে চান, তা নিয়ে সেখানকার অন্য কোনো বিজ্ঞানীর আগ্রহ ছিল না। তবু মিলিকান নিষ্ঠার সঙ্গে পরীক্ষামূলক গবেষণা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

কিন্তু সে জন্য প্রথমে দরকার একটি ভালো ও জুতসই সমস্যা। সে জন্য ইউরোপ থেকে আসা বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন মিলিকান। মনে মনে আশা করেন, যদি জুতসই কিছু মেলে। ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে জে থমসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন। তাতে খুব উৎসাহিত হন মিলিকান। এ নতুন ও রোমাঞ্চকর বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাইলেন তিনি। কিন্তু বাদ সাধল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। এ গবেষণার জন্য দরকার উচ্চ ভ্যাকুয়াম পাম্প করতে সক্ষম যন্ত্রপাতি। কিন্তু শিকাগোতে তাঁর গবেষণাগারে তেমন কোনো ভ্যাকুয়াম পাম্প ছিল না। তাতেও দমলেন না মিলিকান। নিজে একটা ভ্যাকুয়াম পাম্প তৈরি করতে শুরু করলেন। এভাবে পারদ, টিউব আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি জোগাড় করে ১৯০৩ সালের মধ্যে বানিয়ে ফেললেন নিজের একটা ভ্যাকুয়াম পাম্প। সে যন্ত্র বায়ুচাপের চেয়ে ১০০ কোটি ভাগ নিম্নচাপ তৈরি করতে পারত। সে যুগের তুলনায় যথেষ্ট ভালো ও উন্নত বলা চলে।

অপর দিকে ইউরোপে কিছুদিন পর থমসন অনুমান করলেন, ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত। তাঁর মতে, কম তাপমাত্রার চেয়ে উচ্চ তাপমাত্রায় ধাতুতে ইলেকট্রনের শক্তি বেশি থাকবে এবং ধাতু থেকে সহজে ও উচ্চ গতিতে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসবে। অচিরেই প্রবন্ধটি ছাপা হওয়া জার্নাল এল মিলিকানের হাতে। থমসনের অনুমান পরীক্ষা করে দেখার কথা ভাবলেন তিনি। তখন তাঁর হাতে সদ্য নির্মিত শক্তিশালী ভ্যাকুয়াম পাম্প। পরীক্ষা করতে গিয়ে যথাসম্ভব সতর্কও থাকলেন, যাতে কোনো ভুলচুক না হয়।

দৈনন্দিন জীবনে সৌরকোষ ছাড়াও আরও নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট

কিন্তু পরীক্ষা শেষে হতাশ হলেন মিলিকান। দেখলেন, ধাতুর তাপমাত্রার সঙ্গে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসার কোনো সম্পর্ক নেই। ভাবলেন, তাহলে কি তাঁর নিজের পরীক্ষায় কোনো ভুল হলো? তাই ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার’ নীতি অনুসরণ করলেন মিলিকান। পরীক্ষাটি আবার করার কথা ভাবলেন। এবার তাঁর কয়েকজন গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীর মধ্যে ভাগ করে দিলেন সমস্যাটি। ছোট্ট একটা ঘরে দিনের পর দিন দল বেঁধে কাজ করতে লাগল ছাত্ররা। এবার একে একে ১২টি ধাতুতে আলো ফেলে পরীক্ষা করে দেখা হলো। তামা, নিকেল, লোহা, দস্তা, সিলভার, ম্যাগনেশিয়াম, সিসা, অ্যান্টিমনি, সোনা, অ্যালুমিনিয়াম ও পিতল (তামা ও দস্তার সংকর ধাতু)। এবারও একই ফলাফল। হাকিম নড়ে, তবু হুকুম নড়ে না—এমন অবস্থা! তাহলে ব্যাপারটা কী?
সেই ব্যাখ্যা পাওয়া গেল আইনস্টাইনের গবেষণাপত্রে, ১৯০৫ সালে। অ্যানালেন ডার ফিজিক-এর সেই সংখ্যা হাতে পেয়ে আইনস্টাইনের ব্যাখ্যা পড়ে ফেললেন মিলিকান।

কিন্তু ব্যাখ্যাটা মনঃপূত হলো না তাঁর। আলো যে তরঙ্গ, সে কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন তিনি। তাই আলোর কণা তত্ত্ব এককথায় নাকচ করে দিলেন। শুধু তা–ই নয়, আইনস্টাইনের ব্যাখ্যা যে ভুল, তা পরীক্ষা করে প্রমাণ করতে চাইলেন তিনি। এত দিন এমন একটা কিছু খুঁজছিলেন যেন। আইনস্টাইনের আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে একটি প্রত্যক্ষ ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া যায়। সেটা আবার পরীক্ষায় যাচাই করে দেখা সম্ভব। তাঁর ব্যাখ্যা অনুসারে, আগত আলোকরশ্মির কম্পাঙ্ক বাড়িয়ে ধাতব বস্তুতে সৃষ্ট ভোল্টেজের ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়া মাপা সম্ভব।

মিলিকান ভাবেন, আইনস্টাইনের অনুমান যদি ভুল প্রমাণ করা যায়, তাহলে কেল্লা ফতে। পদার্থবিদ হিসেবে সারা বিশ্বে নাম কামানো যাবে। এভাবেই পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখাতে চাইলেন। নবোদ্যমে কাজ শুরু করলেন তিনি। ১৯০৭ সালের দিকে প্রায় সেই একই সেটআপ নিয়ে মাঠে নামল মিলিকান এবং তাঁর দল—আলোর উৎস, ধাতবপৃষ্ঠ, ইলেকট্রন সংখ্যা গণনার জন্য একটা যন্ত্র ও আনুষঙ্গিক আরও কিছু। পরীক্ষা ত্রুটিমুক্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালালেন।
১৯০৯ সালের দিকে পরীক্ষার প্রথম ফলাফল পেলেন মার্কিন এই বিজ্ঞানী। কিন্তু তা মেনে নিতে পারলেন না। দেখা গেল, আইনস্টাইনের কথাই ঠিক। এবার মরিয়া হয়ে উঠলেন তিনি। পরীক্ষায় কোনো ভুল হয়েছে ভেবে আবারও কোমর বেঁধে দলবল নিয়ে পরীক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন মিলিকান। ১৯১২ সালে পাওয়া গেল সেই পরীক্ষার ফল। কিন্তু এবারও আইনস্টাইনের ব্যাখ্যার কাছে হেরে গেলেন তিনি। তাতে হতাশ হয়ে পড়লেন। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে তাঁর গবেষণা দলে অনেক শিক্ষার্থী নাম লেখাল; গবেষণা শেষে, পড়ালেখা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে বিদায়ও নিল। মিসিসিপির জলও গড়াল মেক্সিকো উপসাগরে গ্যালন গ্যালন। দীর্ঘদিন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ চালালেন—ফলাফল প্রকাশ করবেন নাকি করবেন না!

অবশেষে ১৯১৬ সালে ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ করেন মিলিকান। তাতে দেখা গেল, আইনস্টাইনের প্রায় সব অনুমান মিলিকানের পরীক্ষায় সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ ধাতু থেকে বেরিয়ে আসা ইলেকট্রন আগত আলোর কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। এর সরল মানে, আলোর কণা তত্ত্ব সঠিক। আলো আসলে ফোটনের মতো গুচ্ছ বা প্যাকেট হিসেবে নিঃসৃত হয়।

স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া যায়, মিলিকানের ফলাফল প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসবেন পদার্থবিদেরা। হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের আইনস্টাইনের ব্যাখ্যা মেনে নেবেন। কিন্তু বাস্তবতা আসলে কল্পনার চেয়ে নাটকীয় হয়। ঘটনা ঘটল তাঁর উল্টো। কারণ, তখন কেউ আলোর ফোটন কণা দেখেনি। কাজেই আইনস্টাইনের ব্যাখ্যা উপেক্ষা করতে লাগলেন বেশির ভাগ বিজ্ঞানী। এমনকি ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টকে অমীমাংসিত রহস্য ভেবেও খুশি ছিলেন অনেকে।

যাহোক, একসময় অবশ্য সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া কারও কোনো উপায় থাকবে না। কারণ, ১৯২০-এর দশকে পরীক্ষামূলকভাবে ফোটন শনাক্ত করেন মার্কিন বিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন। সেটি আরেক রোমাঞ্চকর কাহিনি। এখানে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আলো কি আসলে কণা, তরঙ্গ নয়? সেই বিতর্কের কি অবসান হলো শেষ পর্যন্ত? আসলে তা নয়। আরও পরে প্রমাণিত হবে, আলো আসলে একই সঙ্গে কণা এবং তরঙ্গ, যাকে বলে পার্টিকেল-ওয়েভ ডুয়ালিটি বা কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা। কিছু ক্ষেত্রে আলো কণার মতো আচরণ করে, আবার কিছু ক্ষেত্রে আচরণ করে তরঙ্গের মতো। ফরাসি বিজ্ঞানী লুই দ্য ব্রগলি তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করেন, শুধু আলো নয়, অন্যান্য কণাও এ রকম দ্বৈত আচরণ করে। সে সময় ব্রিটিশ-অস্ট্রেলিয়ান পদার্থবিদ উইলিয়াম হেনরি ব্রেগ বিষয়টি নিয়ে রসিকতা করে বলেছিলেন, কোয়ান্টাম তাত্ত্বিকেরা আলোকে তরঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করেন সোম, মঙ্গল ও বুধবারে। আর কণা হিসেবে বর্ণনা করেন বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবারে। কিন্তু যত রসিকতা করুন, আলোর ক্ষেত্রে আসলে এটি সত্য। এটি স্বীকার করার মধ্য দিয়ে আলো কণা নাকি তরঙ্গ, সে বিতর্কের অবসান হয়।
এ কাহিনির শেষে আরেকটি তথ্য জেনে রাখলে ক্ষতি নেই। ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের এ ব্যাখ্যার জন্য ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল আইনস্টাইনকে। তাঁর বিখ্যাত থিওরি অব রিলেটিভিটির জন্য নয়; আর এ ব্যাখ্যা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রমাণ করার জন্য দুই বছর পর, মানে ১৯২৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান রবার্ট মিলিকান। দেখতেই পাচ্ছেন, একদিন সত্যি সত্যি নামকরা পদার্থবিদ হয়েছিলেন মিলিকান। তবে আইনস্টাইনকে ভুল প্রমাণ করে নয়, সঠিক প্রমাণ করে। হোক তা নিতান্ত অনিচ্ছায়।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: দ্য অ্যামেইজিং স্টোরি অব কোয়ান্টাম মেকানিকস/ জেমস কাকালিওস
কোয়ান্টাম/ মনজিৎ কুমার
টু বিগ ফর আ সিঙ্গেল মাইন্ড/ টোবিয়াস হুটার
দ্য ম্যাটার অব এভরিথিং/ সুজি শিলি
আইনস্টাইন’স কসমস/মিচিও কাকু
কোয়ান্টাম থিওরি/ ব্রায়ান ক্লেগ
পদার্থবিজ্ঞানের কয়েকজন স্রষ্টা/ এ এম হারুন-অর-রশীদ
কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক: ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক/ আবুল বাসার