দূর মহাকাশে রহস্যময় নতুন বস্তুর খোঁজ
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে নিয়মিতই মহাকাশ সম্পর্কে নতুন তথ্য মিলছে। এবার জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তথ্য পরীক্ষা করে দূর মহাকাশে তিনটি অদ্ভুত বস্তু খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এসব বস্তুকে ডার্ক স্টার বলা হচ্ছে। নতুন খোঁজ পাওয়া এসব বস্তু মহাবিশ্বের প্রথম তারার জন্ম সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারণাকে পরিবর্তন করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক স্টারের ধারণাটি বহু বছর ধরে বিদ্যমান থাকলেও নতুন তথ্য প্রথমবারের মতো ডার্ক স্টারকে আবার আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।
নামে ডার্ক বা অন্ধকার শব্দটি থাকলেও ডার্ক স্টার সত্যিকার অর্থে অন্ধকার বা সাধারণ তারার মতো নয়। এখানে ডার্ক শব্দটির তাদের রং বা উজ্জ্বলতাকে বোঝায় না, বরং এটি এক ভিন্ন ধরনের শক্তিকে নির্দেশ করে যা তারা নির্গত করে। এসব তারা থেকে ডার্ক ম্যাটার শক্তি আসে। বিজ্ঞানীদের মতে, ডার্ক স্টার বিশালাকারের হয়। শুধু তা–ই নয়, এগুলো সাধারণ তারার মতো নিউক্লিয়ার ফিউশন থেকে নয়, বরং ডার্ক ম্যাটার থেকে নির্গত শক্তি দিয়ে আলো ছড়ায়।
ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্বের প্রায় ২৭ শতাংশ গঠন করলেও তা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় না। সাধারণ পদার্থ দৃশ্যমান হয় কারণ এগুলোতে বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত কণা থাকে। অন্যদিকে, ডার্ক ম্যাটার বৈদ্যুতিক চার্জবিহীন কণা দিয়ে গঠিত হওয়ায় অদৃশ্য থাকে। ফলে ডার্ক ম্যাটার আলো শোষণ বা প্রতিফলিত করে না, নিজের থেকেও আলো নির্গত করে না। কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অনুসারে, ডার্ক ম্যাটার কণা তাদের নিজস্ব প্রতিকণা। যখন একটি কণা তার প্রতিকণার সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়, তখন উভয়ই ধ্বংস হয়ে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করে। যদি ডার্ক ম্যাটার কণা এভাবে আচরণ করে, তবে ঘন অঞ্চলে তাদের সংঘর্ষ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শক্তি মুক্ত করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, এই শক্তি ডার্ক স্টার গঠনের মূল চাবিকাঠি। এই সব বস্তুর মধ্যে ডার্ক ম্যাটার খুব ঘন পরিমাণে উপস্থিত থাকে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাধারণভাবে মনে করা হয় বিগ ব্যাংয়ের পরে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের মেঘ মহাকর্ষের প্রভাবে ভেঙে পড়েছিল। সেসময় নিউক্লিয়ার ফিউশনর মাধ্যমে প্রথম তারা গঠিত হয়েছিল। ডার্ক স্টার এই চিন্তাভাবনা থেকে একটি ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। ২০০৮ সালে বিজ্ঞানীরা প্রস্তাব করেন, ডার্ক ম্যাটার প্রাথমিক মহাবিশ্বের কেবল একটি নিষ্ক্রিয় উপাদান ছিল না, বরং এটি একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারত। যখন ডার্ক ম্যাটার কণা সংঘর্ষ করে শক্তি মুক্ত করত, তখন উৎপন্ন তাপ গ্যাস মেঘকে পুরোপুরি ভেঙে পড়তে বাধা দিত। ফলে এমন একটি বস্তু তৈরি হতো যা ফিউশনের পরিবর্তে ডার্ক ম্যাটার শক্তির মাধ্যমে উজ্জ্বল হয়। এই কারণে, ডার্ক স্টার সাধারণ তারার চেয়ে অনেক বেশি দিন স্থায়ী হতে পারে। এদের তাদের পৃষ্ঠ তুলনামূলকভাবে শীতল হয়, যা তাদের আলোকে একটি ভিন্ন রূপ দেয়।
ডার্ক স্টারের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এসব তারা খুব প্রাচীন ও শক্তিশালী রেডশিফট প্রদর্শন করে। মহাবিশ্বের প্রসারণের কারণে তাদের আলো ইনফ্রারেড তরঙ্গদৈর্ঘ্যে স্থানান্তরিত হয়। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ডেটা কিছু অত্যন্ত দূরবর্তী বস্তু প্রকাশ করেছে যা প্রাথমিক তারা বা গ্যালাক্সির তুলনায় অনেক বেশি উজ্জ্বল আর সম্ভবত আরও বিশাল। অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, এসব ডার্ক স্টার হতে পারে এবং তারা এদের অস্তিত্বের প্রথম প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
একটি ডার্ক স্টারের শেষ অবস্থা নির্ভর করে তার আকারের ওপর। ছোট ডার্ক স্টারে ডার্ক ম্যাটার ফুরিয়ে গেলে, সাধারণ নিউক্লিয়ার ফিউশন শুরু হয়ে ধীরে ধীরে সাধারণ তারায় পরিণত হয়। তবে সব বিজ্ঞানী একমত নন এই বিষয়ে। কেউ কেউ বলছেন, এসব কেবল অস্বাভাবিক গ্যালাক্সি বা অত্যন্ত বিশাল সাধারণ তারা হতে পারে, যা আশপাশের পদার্থ টেনে নিয়ে গঠিত হয়েছে। এই ধাঁধা সমাধানের জন্য আরও পর্যবেক্ষণ ও উন্নত তত্ত্ব প্রয়োজন।
সূত্র: এনডিটিভি