গ্রাফিন থেকে তৈরি হলো প্রথম কার্যকর সেমিকন্ডাক্টর

গ্রাফিন থেকে তৈরি করা হয়েছে সেমিকন্ডাক্টরছবি: জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি

সেমিকন্ডাক্টর বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর সময়ের চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। সেমিকন্ডাক্টর নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালনা করে, যা ইলেকট্রনিক যন্ত্রের অন্যতম মৌলিক উপাদান। গ্রাফিনের সেমিকন্ডাক্টর নতুন ইলেকট্রনিকস পণ্য তৈরির নতুন দরজা খুলে দিয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন।

বর্তমান সেমিকন্ডাক্টর শিল্প সিলিকননির্ভর। সিলিকন থেকে প্রায় সব আধুনিক ইলেকট্রনিকস পণ্য বা উপকরণ তৈরি করা হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান দ্রুতগতির কম্পিউটিং আর ছোট ইলেকট্রনিক যন্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে সিলিকন অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (জর্জিয়া টেক) গবেষকেরা গ্রাফিন থেকে বিশ্বের প্রথম কার্যকর সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করেছেন। গ্রাফিনে কার্বন পরমাণু একক শিট আকারে শক্তিশালী বন্ধন দ্বারা আবদ্ধ থাকে।

জর্জিয়া টেকের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিজ্ঞানী ওয়াল্টার ডি হিয়ার যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে নিয়ে নতুন ধরনের সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করেছেন। গ্রাফিন থেকে তৈরি সেমিকন্ডাক্টর প্রচলিত মাইক্রোইলেকট্রনিকস পণ্য তৈরির পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সিলিকনের কার্যকর বিকল্প বলা যায় গ্রাফিন।

নেচার সাময়িকীতে নতুন ধরনের সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। গ্রাফিন নিয়ে গবেষণায় অনেক বছরের একটি বাধাকে অতিক্রম করেছেন বিজ্ঞানীরা। অনেকের ধারণা ছিল, গ্রাফিন ইলেকট্রনিকস শিল্পে কখনোই ব্যবহার করা যাবে না। ব্যান্ড গ্যাপ নামের বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সেমিকন্ডাক্টর গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাফিনের এখন পর্যন্ত কোনো ব্যান্ড গ্যাপ ছিল না।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘আমাদের কাছে সিলিকনের চেয়ে ১০ গুণ গতিশীলতার অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রাফিন সেমিকন্ডাক্টর রয়েছে। এর অনন্য বৈশিষ্ট্য সিলিকননির্ভর সেমিকন্ডাক্টরেও পাওয়া যায় না। গত ১০ বছরে আমরা এই উপাদানটি নিয়ে ভালো কাজের সুযোগ খুঁজছিলাম। অনেক আগে থেকেই আমরা জানতাম গ্রাফিনকে ইলেকট্রনিকস দুনিয়ায় ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা ইলেকট্রনিকস শিল্পে গ্রাফিনের তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রবর্তনের আশায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। গ্রাফিন অত্যন্ত মজবুত উপাদান। গ্রাফিন উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ শক্তি পরিবহন করতে পারে কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়াই। বিশেষ চুল্লি ব্যবহার করে সিলিকন কার্বাইড ওয়েফারে গ্রাফিন কীভাবে বাড়ানো যায়, তা বের করেছি আমরা। আমরা বিশেষ ধরনের চিকন বা এপিটাক্সিয়াল গ্রাফিন তৈরি করেছি। এটি একক স্তরবিশিষ্ট, যা সিলিকন কার্বাইডের স্ফটিকের তৈরি হয়। সঠিকভাবে তৈরি করা হলে এপিটাক্সিয়াল গ্রাফিন রাসায়নিকভাবে সিলিকন কার্বাইডের সঙ্গে আবদ্ধ হয়। তখন এর মধ্যে অর্ধপরিবাহী বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এক দশকের মতো সময় নিয়ে উপাদান নিখুঁত করার জন্য কাজ করেছি আমরা। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে গ্রাফিন কোনো অর্ধপরিবাহী বা ধাতু নয়। এটি একটি সেমিমেটাল বা অর্ধ-ধাতু। ব্যান্ড গ্যাপ উপাদানের কারণে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র চালু ও বন্ধ হয়। সমস্ত ট্রানজিস্টর ও সিলিকননির্ভর ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এই নীতিতে কাজ করে। গ্রাফিন নির্ভর ইলেকট্রনিকস গবেষণার শুরুতে অনেক প্রশ্ন ছিল। গ্রাফিনে ব্যান্ড গ্যাপের মতো বৈশিষ্ট্য ও সিলিকনের মতো কাজ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। গ্রাফিনে আলাদা পরমাণু যুক্ত করে ইলেকট্রন উপস্থিত করা হয়। ডোপিং নামের এই কৌশল ভালো পরিবাহীতে পরিণত হয়। গ্রাফিন সেমিকন্ডাক্টর সিলিকনের চেয়ে ১০ গুণ বেশি গতিশীল। অন্য কথায়, গ্রাফিনে ইলেকট্রন খুব কম প্রতিরোধের সঙ্গে প্রবাহিত হয়। পুরো বিষয়টিকে একটি নুড়ি পাথর রাস্তা ও মসৃণ রাস্তায় গাড়ি চালানোর সঙ্গে তুলনা করা যায়। গ্রাফিনের সেমিকন্ডাক্টর বেশি দক্ষ। তেমন গরম হয় না। এই সেমিকন্ডাক্টরে ইলেকট্রন দ্রুত প্রবাহিত হতে পারে।

বর্তমানে পৃথিবীর একমাত্র দ্বিমাত্রিক সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করা হয়েছে। বিজ্ঞানী ওয়াল্টার ডি হিয়ার বলেন, এতে ন্যানোইলেকট্রনিকসে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অন্য সব দ্বিমাত্রিক সেমিকন্ডাক্টরের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত। গ্রাফিননির্ভর ইলেকট্রনিকসে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা ছিল অনেক দিন ধরে।

গ্রাফিনের সঠিক ব্যান্ড গ্যাপ ছিল না। সঠিক অনুপাতে চালু ও বন্ধ করতে পারে না। বছরের পর বছর ধরে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করছেন। সেই প্রচেষ্টায় নতুন দরজা খুলল। গ্রাফিনভিত্তিক ইলেকট্রনিকস শিল্প বিকাশের সুযোগ বাড়বে। নতুন ধরনের এপিটাক্সিয়াল গ্রাফিন ইলেকট্রনিকস শিল্পক্ষেত্রে পরিবর্তন আনবে বলে বিজ্ঞানীরা প্রত্যাশা করছেন। কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের জন্য নতুন সুযোগ বাড়বে। গ্রাফিননির্ভর ইলেকট্রনিকস তৈরির জন্য অনেক বছর কাজের পর ফলাফল মিলল।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ইলেকট্রনিকসের আরেকটি প্রজন্মের জন্য পথ উন্মুক্ত হলো। সিলিকনের আগে ভ্যাকুয়াম টিউব ছিল। তার আগে ছিল বৈদ্যুতিক তার ও টেলিগ্রাফ। ইলেকট্রনিকসের ইতিহাসে সিলিকন অনেকটা সময় জুড়ে আছে। পরবর্তী ইতিহাসে গ্রাফিন নতুন ভূমিকায় আসতে পারে।

বিজ্ঞানী ওয়াল্টার ডি হিয়ার আরও বলেন, ‘আমরা এই আবিষ্কারকে প্রথম বিমান তৈরির সঙ্গে তুলনা করতে পারি। প্রথম বিমান বাতাসের মধ্য দিয়ে ৩০০ ফুট উড়ে গিয়েছিল। সন্দেহবাদীদের তখন জিজ্ঞাসা ছিল আদৌ পৃথিবীতে বিমানের প্রয়োজন হবে কি না। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় নিজেদের আবিষ্কার নিয়ে অবিচল ছিলেন। তাঁদের সেই বিমান এখন মহাসাগর অতিক্রম করছে।
সূত্র: টেক এক্সপ্লোর