বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে প্রোটিনভিত্তিক ওষুধ তৈরির নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন

মস্তিষ্কে কৃত্রিম পেপটাইড কাজ করার ত্রিমাত্রিক অলংকরণ
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লোরে ল্যাবের সৌজন্যে

মানবদেহে থাকা প্রোটিনের পেপটাইডভিত্তিক ওষুধ তৈরির নতুন এক রাসায়নিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লোরে নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। প্রোটিনের গঠনের সঙ্গে আকৃতিতে মিলে যায়, গবেষণাগারে এমন কৃত্রিম পেপটাইড তৈরির নতুন রাসায়নিক পদ্ধতি তাঁরা উদ্ভাবন করেছেন। এই পদ্ধতির নাম ‘নন-কোভ্যালেন্ট পেপটাইড স্ট্যাপলিং’। এই পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে কৃত্রিম পেপটাইড তৈরি করা যাবে, যা প্রোটিনের মতো কার্যকর। এই পেপটাইড স্নায়ুরোগসহ মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগানো যাবে। এই গবেষণা দলের নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আখতার হোছাইন। তিনি ফ্লোরে ল্যাবের দি ইনসুলিন পেপটাইডস গ্রুপের প্রধান এবং এই গবেষণা দলের নেতা।

গবেষণার ফলাফলসহ আখতার হোছাইন ও তাঁর দলের গবেষণাপত্রটি ১৩ জুলাই বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক সাময়িকী ‘জার্নাল অব দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি’ প্রকাশ করেছে। এই প্রকাশনার মাধ্যমেই ফ্লোরে ল্যাবের বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণার জানান দিলেন। ফ্লোর ল্যাব থেকে আজ ১৭ জুলাই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই গবেষণার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে সবাইকে জানানো হবে। গতকাল রোববার মুঠোফোনে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতার হোছাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন দেশের ১৬ জন গবেষক এই গবেষণায় কাজ করেছি। সাড়ে পাঁচ বছর পর কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেয়েছি।’  

আখতার হোছাইনদের আবিষ্কারটা একটু বোঝা যাক। মানুষের শরীরে অনেক প্রোটিন তৈরি হয়, যেগুলো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। এই সব প্রোটিনের রাসায়নিক গঠন অনেক জটিল, গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সময়সাপেক্ষ, ওষুধ হিসেবে সেসবের ব্যবহার খুবই ব্যয়বহুল।

এই সময় ও ব্যয় কমিয়ে আনতে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। মানবদেহের শরীরে থাকা প্রোটিনের একটি ক্ষুদ্র কিন্তু অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো ‘আলফা হেলিক্যাল পেপটাইড’। এটি মূলত প্রোটিনের সব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। রসায়নবিজ্ঞানে অনেক দিন ধরেই গবেষণা চলছে, কী করে কম সময়ে ও কম খরচে আলফা হেলিক্যাল পেপটাইড গবেষণাগারে তৈরি করা যায়।

এই চেষ্টার অংশ হিসেবে আখতার হোছাইন ও তাঁর গবেষক দল ফ্লোরে ল্যাবে গবেষণা শুরু করে। তারা প্রোটিনের সেই ‘ক্ষুদ্র কিন্তু প্রয়োজনীয় অংশ’ গবেষণাগারে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আখতার হোছাইন বলেন, ‘আমরা এই প্রকাশনায় দেখিয়েছি, গবেষণাগারে রাসায়নিক পদ্ধতিতে অত্যন্ত স্বল্প সময়ে ও সুলভে আলফা হেলিক্যাল পেপটাইড ওষুধ তৈরি করা সম্ভব। মাত্র এক দিনে কৃত্রিম আলফা হেলিক্যাল পেপটাইড সুলভে তৈরি করা যায়।’  

কৃত্রিম পেপটাইড উদ্ভাবন দলের কয়েকজন বিজ্ঞানী
সংগৃহীত

‘হিউম্যান রিলাক্সিন-৩’ নামের জটিল একটি প্রোটিন নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক দিন থেকেই কাজ করছেন। এটি মূলত মানুষের মস্তিষ্কে তৈরি হয়, ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। আখতার হোছাইন বলেন, ‘আমাদের নতুন রাসায়নিক পদ্ধতিতে মাত্র এক দিনে হিউম্যান রিলাক্সিন-৩ প্রোটিনের ক্ষুদ্র অংশ গবেষণাগারে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এই ক্ষুদ্র অংশ অর্থাৎ আলফা হেলিক্যাল পেপটাইড ইঁদুরের মস্তিষ্কে প্রয়োগ করে আমার দেখিয়েছি যে হিউম্যান রিলাক্সিন-৩ প্রোটিনের মতো নতুন এই ক্ষুদ্র পেপটাইডটি ইঁদুরের ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। এই নতুন রাসায়নিক পদ্ধতিটির আমরা পেটেন্ট করেছি এবং আশা করছি, আমাদের এই নতুন রাসায়নিক পদ্ধতি বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।’

পাঁচ বছর আগে আখতার হোছাইন নতুন এক ধরনের ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন। সেই ইনসুলিন ফ্রিজ ছাড়াও সংরক্ষণ করা যাবে। আখতার হোছাইেনর আরেকটি আবিষ্কার হচ্ছে গবেষণাগারে ‘ইনসুলিন পেপটাইড-৫’ নামের কৃত্রিম হরমোন, যা ক্ষুধা নিরাময়ে ভূমিকা রাখবে। হাঁপানির মতো ফুসফুসঘটিত নানা রোগের নিরাময়ে সম্ভাব্য ওষুধও বানিয়েছেন আখতার হোছাইন। যেকোনো রসায়নবিদের জন্য ‘জার্নাল অব দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি’ একটি স্বপ্নের প্রকাশনা। এবার এই গবেষণাপত্রসহ এই জার্নালে আখতার হোছাইনের প্রকাশিত এটি পঞ্চম গবেষণাপত্র।

নিজ কর্মস্থল ফ্লোরে ল্যাবে অধ্যাপক ড. আখতার হোছাইন
সংগৃহীত

মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে খ্যাতি ও সাফল্য পাওয়া আখতার হোছাইন ১৯৭৪ সালের ১ মার্চ কুমিল্লা সদর উপজেলার অলিপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুর রহমান ও মা ফাতিমা রহমান। দুই বছর বয়সে মাকে হারান।

কুমিল্লার ধনুয়াখলা মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় কুমিল্লা জেলায় প্রথম হন আখতার। এরপর কুমিল্লা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন। আলিম পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর (৯০১) নিয়ে মেধাতালিকায় আবারও প্রথম স্থান অর্জন করেন আখতার।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন বিভাগে ভর্তি হন তিনি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর—দুই পরীক্ষাতেই অর্জন করেন প্রথম শ্রেণি। জাপান সরকারের মনবুসো বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করতে যান টোকিওর ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। আখতার হোছাইনের অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘পেপটাইড ড্রাগ সিন্থেসিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’। এরপর পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেন ফ্রান্সের জোসেফ ফুরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে।  

২০০৫ সালে আখতার অস্ট্রেলিয়ায় মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ২০০১ সালে বিয়ে করেন ফারহানা ফওজিয়াকে। এই দম্পতির দুই সন্তান—আফরাহ তাহসিন ও আরিয়ান হোছাইন।

আখতার হোছাইন মনে করেন তাঁদের উদ্ভাবিত নন-কোভ্যালেন্ট পেপটাইড স্ট্যাপলিং রাসায়নিক পদ্ধতি কৃত্রিম আলফা হেলিক্যাল পেপটাইড তৈরি সহজ করবে। ফলে স্নায়ুরোগসহ মানুষের বিভিন্ন রোগের পেপটাইড জাতীয় ওষুধ তৈরিও সহজ হয়ে যাবে। আখতার হোছাইনদের গবেষণাপত্রটি পাওয়া যাবে দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির ওয়েবসাইটে