স্টেথোস্কোপের কাজও কি এআইয়ের দখলে চলে যাবে

ছবি: পেক্সেলস ডটকম

চিকিৎসকের কথা মাথায় এলেই আমরা তাঁর পরনে সাদা অ্যাপ্রন আর গলায় স্টেথোস্কোপের এক চিরায়ত ছবি কল্পনা করি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির (এআই) কারণে সেই স্টেথোস্কোপের বিদায়ঘণ্টা বাজার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এআই লেজারের মাধ্যমে হৃৎস্পন্দন পাঠ করার নতুন এক কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে, যা স্টেথোস্কোপকে প্রতিস্থাপন করতে পারে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

এআই লেজারনির্ভর নতুন এই উদ্ভাবন যেকোনো বাড়িতে বসানো যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা একটি লেজার ক্যামেরা তৈরি করেছেন, যা দূর থেকে ব্যক্তির হৃৎস্পন্দন (হার্টবিট) পড়তে পারে। হৃদ্‌যন্ত্রের কোনো সমস্যা বা কার্ডিওভাসকুলার সংকটের লক্ষণ চিহ্নিত করতে পারে।

যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এআই ও কোয়ান্টাম প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্যের নিরীক্ষণের উপায়কে পরিবর্তনের কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের অধ্যাপক ড্যানিয়েল ফ্যাসিও বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর এই প্রযুক্তি খুবই কার্যকর। নানাভাবে ব্যবহারের সুযোগ আছে। আমরা শপিং মলের বুথেও এটা স্থাপন করতে পারি। দ্রুত হার্টবিট রিডিং দেখে যেকোনো অনলাইন চিকিৎসা নথিতে নিজের হৃদ্‌যন্ত্রের তথ্য যোগ করতে পারবে।’

লেজার হার্ট মনিটর বাড়িতেই রাখা যাবে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার তথ্য জানতে ব্যক্তির বাড়িতে ইনস্টল করা যাবে। এর সঙ্গে অন্য যন্ত্র, যা রক্তচাপের অস্বাভাবিকতা বা চলাফেরার সূক্ষ্ম পরিবর্তন অনুসন্ধান করতে পারে, আলঝেইমার রোগের প্রাথমিক চিহ্নও সন্ধান করতে পারবে।

দূর থেকে লেজারের মাধ্যমে ব্যক্তির হৃৎস্পন্দন নিরীক্ষণ করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হৃৎস্পন্দনের মাত্রা বুঝে সতর্কতা প্রদান করতে পারে এই যন্ত্র। কোনো ব্যক্তি স্ট্রোক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ঝুঁকিতে রয়েছেন কি না, তা সহজে বোঝা যাবে। বর্তমানে চিকিৎসকেরা হৃৎস্পন্দন নিরীক্ষণের জন্য স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করেন।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ফরাসি সার্জন রেনে ল্যানেক স্টোথোস্কোপ উদ্ভাবন করেন। তখন চিকিৎসকেরা বুকে কান পেতে হৃদ্‌যন্ত্রের অবস্থা বুঝতেন। একজন নারী রোগীর আপত্তির কারণে সার্জন রেনে বিকল্প উপায় বের করেন। স্টেথোস্কোপে ডিস্ক-আকৃতির অনুরণন যন্ত্র থাকে, যা শরীরে হৃৎশব্দ বা ধমনির কম্পন বুঝতে সহায়তা করে। টিউব ও ইয়ারপিসের মাধ্যমে যে চিকিৎসক স্পষ্টভাবে শরীরের কম্পন ও শব্দ শুনতে পারেন।

সাধারণভাবে সঠিকভাবে স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করার জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। যদি রোগীর বুকে খুব জোরে চাপ দেওয়া হয়, তবে হৃৎস্পন্দনের সংকেত কমে যায়। একই সময়ে হৃৎপিণ্ডের আশপাশে অন্য কোনো শব্দ ব কম্পন থাকলে হৃদ্‌যন্ত্রের শব্দ বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে।

বিজ্ঞানী ফ্যাসিওর নেতৃত্বে একটি বিশেষ সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। অধ্যাপক ড্যানিয়েল ফ্যাসিও বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর এই পদ্ধতিতে উচ্চ গতির ক্যামেরা যুক্ত করা হয়েছে, যা প্রতি সেকেন্ডে দুই হাজার ফ্রেম গতিতে ছবি রেকর্ড করতে পারে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে ব্যক্তির গলার নিচের ত্বকে একটি লেজার রশ্মি ফেলা হয়। রোগীর মূল ধমনির প্রসারণ ও রক্ত প্রবাহের কারণে ত্বকের সংকোচন পরিমাপ করতে লেজার ব্যবহৃত হচ্ছে।

‘লেজারের মাধ্যমে অনেক সূক্ষ্ম পরিবর্তন পরিমাপ করা হচ্ছে। এক মিটারের কয়েক বিলিয়ন ভাগ পরিবর্তনের গতিবিধি খেয়াল করা যায়। তীক্ষ্ণ পরিবর্তন, হৃদ্‌যন্ত্রের ক্ষুদ্র কম্পন ট্র্যাকিং থেকে শুরু করে হৃৎস্পন্দনের মাত্রা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে অনুসরণ করা যাচ্ছে। ব্যক্তির বুকে অন্য অনেক কারণে নড়াচড়া হয়। শ্বাসপ্রশ্বাসের কারণে নড়াচড়া প্রচলিত স্টেথোস্কোপে আলাদা করা কিছুটা কঠিন। হৃৎস্পন্দন খুঁজে বের করতে এআই লেজার বেশ দক্ষ। এখানে এআই বেশ কার্যকর। আমরা উন্নত কম্পিউটিং সিস্টেম ব্যবহার করছি, যা একজন ব্যক্তির হার্টবিটের কম্পন ছাড়া সবকিছু ফিল্টার করতে পারে। ব্যক্তির বুক থেকে নির্গত অন্যান্য শব্দের দুর্বল সংকেত সন্ধান করতে পারে। আমরা মানুষের হৃৎস্পন্দনের ফ্রিকোয়েন্সির পরিসীমা জানি, এআই সেই মাত্রা ধরেই শব্দের ওপর মনোযোগ দেয়।’

এআই সংকেত বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর হৃৎস্পন্দনের পরিবর্তনগুলো শনাক্ত করতে পারে। ব্যক্তির নিজস্ব নির্দিষ্ট কার্ডিয়াক আচরণ বুঝতে সহায়তা করছে। নির্দিষ্ট ত্রুটি বুঝতে এআই লেজারের ব্যবহার বেশ কার্যকর। গবেষকেরা একটি স্টার্টআপ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। লাইটহার্টেড এআই নামের প্রতিষ্ঠানটি বড় আকারে ডিভাইস তৈরির জন্য কাজ করছে। অধ্যাপক ড্যানিয়েল ফ্যাসিও বলেন, ‘এই সিস্টেমের ফলাফল বেশ সঠিক। আপনি যদি ১০ জনের সঙ্গে একটি বাড়িতে থাকেন, আর আপনার গলায় লেজার জ্বালিয়ে প্রতিফলনের তথ্য আলাদাভাবে নেওয়া যাচ্ছে। আপনার হৃৎস্পন্দন বিশ্লেষণ করতে পারে এককভাবে।’

প্রকৃতপক্ষে এই যন্ত্র বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণের মতো কাজ করে। ২০২৪ সালে সাধারণ মানুষের জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ মিলবে। হাসপাতালের বাইরে কিংবা প্রাথমিক চিকিৎসায় দ্রুত হৃৎস্পন্দন পরিমাপ করতে ব্যাপক আকারে ব্যবহারের সুবিধা তৈরি হবে।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান