নগর কৃষির ‘ভার্টিক্যাল ফার্মিং’ কি ঝুঁকিতে?

সম্ভাবনা থাকলেও ঝুঁকির মুখে পড়ছে বিভিন্ন আরবান ফার্মিং প্রতিষ্ঠান।রয়টার্স

নগরায়ণ, আধুনিক শহর ব্যবস্থাপনা, জলবায়ুসংকটসহ নানান কারণে আবাদি জমির চাষ কমছে। আবাদি জমির পাশাপাশি শহরের মানুষ কৃষির প্রতি অনাগ্রহী হয়ে উঠছেন। এই সংকটে নগর কৃষি বা আরবান ফার্মিং ধারণা জনপ্রিয়তা পায়। নগর কৃষির ধারণার সঙ্গে সঙ্গে উলম্ব চাষাবাদ বা ভার্টিক্যাল ফার্মিং ধারণা জনপ্রিয়তা পায়। ভার্টিক্যাল ফার্মিং এমন একটি ধারণা, যেখানে ভবনের উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে কৃষিপণ্য উৎপাদনের চেষ্টা করা হয়। বিভিন্ন স্থাপনায় তাকের পর তাক স্থাপন করে বিভিন্ন সবজি ও ফল চাষের ধারণা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। উঁচু অট্টালিকা, আবাসিক এলাকা কৃষিতে যুক্ত করে এ ধারণা বিস্তৃতি পায়। মার্কিন কৃষিপ্রযুক্তি স্টার্টআপ (উদ্ভাবনী উদ্যোগ) অ্যারোফার্মস এই ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার কাজ করছে। ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে অ্যারোফার্মস। শুরুতে সবাই বিষয়টি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো ভীষণ রোমাঞ্চকর বলে মনে করেছিল। কিন্তু সম্ভাবনা থাকলেও ঝুঁকির মুখে পড়ছে এমন কৃষিপ্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো।

সব জায়গায় সব চাষ হয় না

২০১৭ সালে নিউইয়র্কে যাত্রা শুরু করে অ্যারোফার্মস। গত বছরের জুনে ব্যাংকে দেউলিয়ার হাত থেকে বাঁচতে বিশেষ আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। পণ্যের চাহিদা থাকলেও বাজার ধরতে সংকটে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাষ্ট্রে ঘরের মধ্যে কৃষিব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে অ্যারোফার্মস। শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠানটি খুব বেশি সাফল্য প্রত্যাশা করলেও এখন সংকটে আছে। যুক্তরাষ্ট্রে জার্সি সিটি, নিউজার্সিসহ বিভিন্ন শহরের নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীর মধ্যে বিষয়টি জনপ্রিয় করার চেষ্টা করে অ্যারোফার্মস। সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মার্ক ওশিমা জানান, ‘সুযোগ থাকার পরও গ্রাহকসংকটের কারণে আমরা পিছয়ে পড়ছি। শুধু অ্যারোফার্মস নয়, ফরাসি প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রিকুল চলতি বছরের শুরুতে কাজ সীমিত করে ফেলেছে।’ অন্যদিকে পেনসিলভানিয়ার ফিফথ সিজন ২০২২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। আরেক প্রতিষ্ঠান ইনফার্ম ইউরোপের অফিস বন্ধ করে দিয়েছে, যেখানে কাজ করতেন প্রায় ৫০০ কর্মী।

ইনফার্ম ইউরোপের কার্যক্রম সীমিত করার কারণ হিসেবে অনেক বিষয়কে দায়ী করেছে। ইউরোপের সব দেশ ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ের জন্য উপযোগী নয়। আবার বাজারের চাহিদা সব জায়গায় নেই বলে বিষয়টি ‘সবুজ’ হলেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না।

সব শস্য কিংবা গাছপালা ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ের জন্য উপযোগী নয়।
রয়টার্স

শুধু সবজি চাষে সম্ভাবনা হারাচ্ছে

অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ দেখা যায়। ভার্টিক্যাল ফার্মের জন্য নানান অনুষঙ্গ তৈরি করে ইন্টেলিজেন্ট গ্রোথ সলিউশন্স। প্রতিষ্ঠানটি বিবিসিকে জানিয়েছে, অনেক মানুষ আসলে ভুল শস্য উৎপাদন করে বলেই বিষয়টি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। সব শস্য কিংবা গাছপালা কিন্তু ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ের জন্য উপযোগী নয়। গ্রাহকেরা শুধু সবুজ পাতাযুক্ত গাছে বা সবজিজাতীয় শস্য উৎপাদনে আগ্রহী বলে বিষয়টি গুরুত্ব হারাচ্ছে। আবার অনেক সময় প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারে বিষয়টি জটিলতর হয়ে উঠেছে। যেমন রোবটের মাধ্যমে গাছের যত্ন নেওয়ার ধারণা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো সুন্দর হলেও বিষয়টি অকার্যকর এখনো। কৃষি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর যেন কৃষির চেয়ে বেশি প্রযুক্তি নিয়েই আগ্রহ বেশি। এমনও প্রতিষ্ঠানের তিনি দেখা পান, যেখানে নিজেদের উদ্ভাবিত পানির পাইপ কয়েকবার আবার উদ্ভাবনের চেষ্টা করা হচ্ছে।

সবকিছুতে প্রযুক্তি ভালো নয়

সাধারণ মানুষ আবার প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহী নন বলে মনে করেন ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্ক লেফসরাড। তাঁর ভাষ্য, সবার আগ্রহ থাকে গাছের যত্ন নিয়ে, প্রযুক্তির রহস্য তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কয়েক বছর ধরে ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ে কৃষির চেয়ে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ বেশি হচ্ছে বলেই সংকট বেশি দেখা যাচ্ছে। মানুষ সবজি বা শস্য চাষ করতে চায়, গেজেট নিয়ে ভাবতে চায় না। টমেটো, শসা কিংবা স্ট্রবেরির মতো জনপ্রিয় সবজি ও ফলের পাশাপাশি নতুন উপযোগিতাসম্পন্ন সবজি-ফসল-ফলের চাষ বাড়াতে হবে।

ডাচ কৃষি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান স্মার্টকাস যুক্তরাজ্যের এসেক্সে ২৭ হাজার বর্গফুটের বিশাল ভার্টিক্যাল ফার্মের উদ্যোক্তা। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড মেসজারোস বলেন, শুধু সবজি চাষ করে ভার্টিক্যাল ফার্মিং বিষয়টিকে টেকানো যাবে না। আমরা প্রচুর পরিমাণে স্ট্রবেরি চাষে মনোযোগ দিচ্ছি। আর প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু সবজি চাষের প্রযুক্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবে না। গ্রিনহাউসসহ বিকল্প চাষাবাদের সুযোগ নিয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনে মনোযোগ দিতে হবে। স্মার্টকাস এ বছরের শুরুতে চিপের অভাবে কিছুদিন কাজ বন্ধ রাখে। স্ট্রবেরি চাষে বিশেষ ধরনের রোবট ব্যবহার করা হয়। চিপের সংকট দেখা দেওয়াতে কাজ বন্ধ রাখতে হয়। কাজ বন্ধ রাখলেও এই ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ের ভবিষ্যৎ ভালো বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি।

লিভারপুলের ফার্ম আরবানের পরিচালক পল মেয়ার্সের মতে, ঘরের মধ্যে কৃষিপণ্য উৎপাদনের বিষয়টি খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। এ বছরের শুরুতে লন্ডনে সবজিসংকট ছিল, আরবান ফার্মিংয়ে সমস্যা সমাধানের সুযোগ আছে। ল্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জেসিকা ডেভিয়েস জানান, শহরে কৃষিকাজের বিস্তৃতি ঘটাতে ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ের গুরুত্ব আছে। কিন্তু কৃষিপ্রযুক্তির জগতে কৃষি নিয়ে বেশি কাজ করতে হবে, নতুবা রোবটরা থাকবে, কৃষি হারিয়ে যাবে।
সূত্র: বিবিসি