জোনাকি রক্ষায় জাপানের বিশেষ উদ্যোগ

জোনাকির আলোরয়টার্স

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে গেয়েছিলেন, ‘ও জোনাকি, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ/ আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ।’ আবার কবি আহসান হাবীব ‘জোনাকিরা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘তারা—একটি দুটি তিনটি করে এলো/তখন—বৃষ্টি-ভেজা শীতের হাওয়া/বইছে এলোমেলো/তারা—একটি দুটি তিনটি করে এলো।’

সেই জোনাকিরা আর সুখে নেই। নগরায়ণের কারণে জোনাকিরা হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়ার নানা দেশেও এমন সংকট তৈরি হয়েছে। এই যেমন জাপানের মরিয়ামা শহরের নামডাক আমাদের আশপাশে তেমন আসে না। এই শহর জাপানে বেশ পরিচিত জোনাকি পোকার জন্য। গেনজি ফায়ারফ্লাই জাপানে জনপ্রিয়, এই জোনাকির বৈজ্ঞানিক নাম নিপ্পোনোলুসিওলা ক্রসিয়াটা। এই জোনাকি একেবারে ৫০০-এর মতো ডিম পাড়ে। এই জোনাকিরা নদীর তীরে ডিম পাড়ে। নদীর পানি ও পরিবেশ ডিম নিষেকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নদীদূষণের কারণে পানির গুণগত মান কমে যাচ্ছে। খাদ্যশৃঙ্খলে তারা শামুকের ওপর নির্ভরশীল। নদীদূষণে শামুকও কমে যাচ্ছে। আবার রাতের বেলা শহরে আলো ব্যবহার আগের চেয়ে বেশ বেড়েছে বলে জোনাকিরা রাতে শহরমুখী হতে আগ্রহী হচ্ছে না আর।

একসময় জাপানের গ্রীষ্ম মানেই ছিল জোনাকি পোকার আগমন। জুন-জুলাইতে বাড়ির উঠানে জমত জোনাকির মেলা। গেনজি জোনাকি তাদের উজ্জ্বল আলোর জন্য বিখ্যাত। এই জোনাকির ডাকে অসংখ্য পর্যটক জাপানে যেতেন একসময়। জনপ্রিয়তার জন্য এই পোকা বোতলে ধরে ওসাকা, কিয়োটা আর টোকিও শহরবাসীর কাছে বিক্রি করা হতো। জোনাকি পোকা বিক্রি রীতিমতো শিল্প হিসেবে বিবেচিত হতো। শিকারিরা বিশেষ প্রক্রিয়ায় এক রাতে তিন হাজারের মতো পোকা ধরতে পারত। সেই পোকা বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় শোভাবর্ধনে ব্যবহৃত হতো। বড়লোকদের বসার ঘরে অ্যাকুরিয়ামে মাছের মতো জোনাকি পোকা রাখা হতো।

যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী সারা লুইস জানান, জোনাকি পোকা চাষ ছিল সেই সময়ের বড় ব্যবসা। শহরে বোতলে জোনাকি রাখা হতো। এসব কারণে জোনাকিরা ডিম পাড়ার সুযোগ পেত না। যে কারণে জোনাক পোকা জাপান থেকে বিদায় নিতে শুরু করে।

জাপানে জোনাকি পোকা রক্ষায় রীতিমতো ক্লাস চালু করা হয়েছে। প্রায় ৬০ বছর আগে জাপান থেকে গেনজি জোনাকি হারিয়ে যেতে শুরু করে। তাদের রক্ষায় প্রায় ৩০ বছর আগে জাদুঘর চালু হয়। মরিয়ামা সিটি ফায়ারফ্লাই ফরেস্ট মিউজিয়াম থেকে আট সপ্তাহের কোর্স চালু করা হয়েছে। আপনি ঠিক পড়েছেন। ইংরেজি শেখার জন্য এখন ঢাকাতে চার সপ্তাহের কোর্স চালু আছে, জোনাকি রক্ষায় আট সপ্তাহের কোর্স জাপানে চালু আছে। এই কোর্সে জোনাকির ডিম পাড়া থেকে শুরু করে ডিম সংগ্রহের নানা কৌশল শেখানো হচ্ছে। জাদুঘরে কৃত্রিমভাবে জোনাকির ডিম নিষেকের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আপাতত প্রতি মাসে ১০ জন প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। জাদুঘরের পরিচালক ও জোনাকি কোর্সের প্রশিক্ষক মিচিও ফুরুকাওয়া জানান, জোনাকি টিকিয়ে রাখতে আমাদের হাজার হাজার শামুক প্রয়োজন। শামুকের কাছ থেকে জোনাকির লার্ভা খাবার সংগ্রহ করে। শামুকের কারণে লার্ভা অবস্থা থেকে বিকশিত হয় জোনাকি পোকা। এসব পোকা প্রথমে চালের আকারের মতো দেখায়। পোকাগুলোর এক টাকার পয়সার সমান বৃদ্ধি হতে শামুকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

 উনিশ শতকের নগরায়ণের কারণে মরিয়ামা শহরের প্রকৃতি বদলে যায়। ইয়াসু নদীর পানি দূষণের মুখে পড়ে। আবাস হারিয়ে বিলুপ্ত হতে শুরু করে জোনাকি পোকা। এখন জাদুঘরে কৃত্রিমভাবে বনের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। সেই পরিবেশে কৃত্রিমভাবে জোনাকির ডিম উৎপাদন করা হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে পাঁচ হাজারের মতো ডিম নিষেক করা হয় জাদুঘরে। নিষেকের পর তা জাদুঘরের কৃত্রিম নদীতে ছাড়া হয়।

জাদুঘরের পরিচালক ও জোনাকি প্রশিক্ষক মিচিও ফুরুকাওয়া জানান, জোনাকির ডিম উৎপাদনের বিজ্ঞান খুবই সরল, কিন্তু কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করলেও প্রকৃতিতে জোনাকির সংখ্যা কমছে। শহরের পরিধি বাড়ার কারণে গ্রামীণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। ভবিষ্যতে জোনাকিরা কোথায় যাবে, তা আমরা জানি না। জাদুঘরের নানা প্রচেষ্টা থাকার পরও কমে যাচ্ছে জোনাকি। চুবু বিশ্ববিদ্যালয়ে জোনাকি নিয়ে গবেষণা করেন পরিবেশবিদ ইউচি ওবা। তিনি জানান, সবাই জোনাকির সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এর সঙ্গে নদীর পানি কিংবা পরিবেশ নিয়েও ভাবতে হবে। যে নদীর পানিতে জোনাকির ডিমের নিষেক হয়, তা কিন্তু এখনো দূষিত। সেখানে লার্ভা টিকে থাকতে পারছে না।

প্রকৃতি ও পরিবেশ উন্নয়নে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। সারা বছর ধরেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক বক্তৃতার আয়োজন করা হচ্ছে। এমনই এক স্কুল ওকাজাকি সিটি ফায়ারফ্লাই স্কুল, যা সচেতনতার কাজ করছে। এই স্কুলের শিক্ষার্থী ওটোগাওয়া নদীর পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে। জাপানের কাগোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের জোনাকি গবেষক দাই-ইতিরো কাতো জানান, ‘যদি সাধারণ মানুষদের সচেতন করা যায়, তাহলে ১০-২০ বছর পর আমরা সামগ্রিকভাবে পরিবর্তন দেখতে পারব।’

সূত্র: ওয়্যার্ড ডটকম