ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে ২০২৩ সালের সেরা ছবি

‘পিকচার অব দ্য ইয়ার’ নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সাময়িকীর ডিসেম্বর ২০২৩ সংখ্যার প্রচ্ছদন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক প্রতিবছর প্রাণ-প্রতিবেশ, পৃথিবী, বন্য প্রাণী, বিজ্ঞান, সমুদ্র থেকে শুরু করে অভিযান, মহাকাশ, ভ্রমণসহ নানা বিষয়ে শ্বাসরুদ্ধকর ছবি প্রকাশ করে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের নানা অভিযান ও অভিযাত্রায় যুক্ত আলোকচিত্রীদের তোলা ২০২৩ সালের সেরা সব ছবি নিয়ে ‘পিকচার অব দ্য ইয়ার’ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের বার্ষিক পিকচার অব দ্য ইয়ার তালিকায় বিশ্বের নানা প্রান্তের আলোকচিত্রীদের তোলা শ্বাসরুদ্ধকর ও পৃথিবীর প্রাণ-পরিবেশ বৈচিত্র্যের প্রাসঙ্গিক ছবি দেখা যায়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সম্পাদকেরা আলোকচিত্রীদের তোলা ছবি ও ছবির গল্প প্রকাশ করেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রধান সম্পাদক নাথান লাম্প বলেন, ‘এই ছবিগুলো শুধু তথ্যই প্রকাশ করে না, আপনাকে নতুন কিছু অনুভব করতে উৎসাহ দেয়। সত্যিই সত্যিই আপনাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাবে। ২০ লাখের বেশি ছবির মধ্য থেকে আলোচিত ছবিগুলো নির্বাচন করা হয়েছে। ৭ মহাদেশে নানা প্রান্তে নানা কাজে যুক্ত ১৬৫ আলোকচিত্রীর ছবি থেকে বছরের সেরা ছবিগুলো বাছাই করা হয়েছে।’

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ডেপুটি ডিরেক্টর, ফটোগ্রাফি স্যাডি কোয়ারিয়ার বলেন, ‘আমাদের পৃথিবীর নানা আনন্দদায়ক, আকর্ষণীয় আর আশ্চর্যজনক ছবি এই তালিকায় আছে। ফটোগ্রাফি চোখে বন্য প্রাণী, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, স্থান, সংস্কৃতি, ভ্রমণ আর দুঃসাহসিক সব কাজের ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছি আমরা। আলোচিত সব ছবি আমাদের মানসিক চিন্তাকে নাড়া দেয়। ছবির গল্প আমাদের আলোকিত করে। এমন জায়গা বা বিষয়ের ছবি আমরা দেখতে পাই, যা আপনি হয়তো কখনোই দেখেননি। এসব ছবি আপনাকে বিজ্ঞানী, অন্বেষণকারী, পরিবর্তনকারী ও বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এসব ছবির মাধ্যমে আপনি নানা বিশ্বাস, অনন্য সব প্রাণীর আচরণ ও অনেক কিছু সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি অর্জন করতে পারবেন। অনুপ্রেরণামূলক, শিক্ষামূলক ও সৃজনশীল এসব ছবি আমাদের নতুন করে ভাবনার সুযোগ তৈরি করে দেয়।’ আলোচিত সব ছবি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের ডিসেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে। অনলাইনে এই ওয়েবসাইটে ছবিগুলো দেখা যাবে। তালিকায় স্থান পাওয়া কয়েকটি ছবির কথা থাকছে এই প্রতিবেদনে।

সিংহের কেশরের মতো দেখতে লায়ন মেন জেলিফিশ
আলেক্সান্ডার সেমেনভ/ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

১. ভিনগ্রহের ফুলের খোঁজে

সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার সেমেনভের তোলা বিশেষ ধরনের জেলিফিশের ছবিটি এবারের তালিকায় সবচেয়ে আলোচিত। সিংহের কেশরের মতো দেখতে জেলিফিশ লায়ন মেন জেলিফিশ হিসেবে পরিবিত। এই জেলিফিশ আর্কটিক সমুদ্রের রানি হিসেবে আলোচিত। আলেক্সান্ডার সেমেনভ যখন ছবিটি তোলেন, তখন জেলিফিশটি জীবনের শেষ সময় বা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল। এই সময়ে জেলিফিশ আকারে সংকুচিত হয়ে যায়। দেখতে ফুলের মতো মনে হয় তখন। সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার সেমেনভের ভাষ্যে তখন জেলিফিশকে এলিয়েন ফ্লাওয়ার বা ভিনগ্রহের ফুল মনে হয়। এই জেলিফিশ দৈত্যাকার জেলিফিশ, আর্কটিক রেড জেলিফিশ বা হেয়ার হেলি নামেও আলোচিত। প্রশান্ত সাগরের উত্তর অংশে এদের বেশি দেখা যায়। মাত্র ১২ মাসের আয়ুষ্কাল এদের। সমুদ্রের ওপরের দিকে এদের বেশি দেখা যায়।

ইতালির ফ্রাসসি গুহায় এই ছবি তোলা হয়
কারস্টেন পিটার/ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

২. বিষাক্ত জলে প্রাণের খোঁজে

আরেকটি আলোচিত ছবি তুলেছেন কারস্টেন পিটার। ইতালির ফ্রাসসি গুহায় এই ছবি তোলা হয়। ছবিতে দেখা যায় তিনজন অভিযাত্রী ক্যাভার ভ্যালেন্টিনা মারিয়ানি, কেনি ব্রড ও নাদির কোয়ার্টা অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতালির ফ্রাসসি গুহার লাগো ভার্দে নামের হ্রদের অন্ধকার আর বিষাক্ত জলে ডুব দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। এই গুহায় সূর্যালোক প্রবেশ করে না। সূর্যালোকের অভাবে বিশেষ ধরনের বাস্তুতন্ত্র দেখা যায় এখানে। অপরিচিত এক দুনিয়ার আভাসে অভিযাত্রীরা রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করছেন। গভীর ভূগর্ভে বসবাসকারী জীবাণু বা প্রাণ ভূপৃষ্ঠে আমরা যা দেখি, তার চেয়ে আলাদা। তাদের জীবনযাত্রা ভিন্ন। পৃথিবী প্রথম দিকে যেমন ছিল, তেমন পরিবেশের আবহ সেখানে দেখা যায়। কম অক্সিজেন আর সূর্যের আলোর অভাবে কীভাবে প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়, তার রহস্য উন্মোচনের এই ছবি এবারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।

শেড অ্যাকুয়ারিয়ামে জেব্রা হাঙর
ডেভিড ডাবিলেট/ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

৩. জেব্রা হাঙরের সন্ধানে

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে শেড অ্যাকুয়ারিয়ামের অবস্থান। এখানে ৭ ফুট লম্বা জেব্রা হাঙরের দেখা মেলে। এই হাঙর বিলুপ্তির পথে, যে কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ডেভিড ডাবিলেট এই ছবি তুলেছেন। ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে এই হাঙরের দেখা মেলে। গড়ে পানির ৬২ মিটার নিচে এদের দেখা মেলে। দৈর্ঘ্যে প্রায় ৮ ফুট ২ ইঞ্চি এই হাঙর। এটি প্রকৃতিতে নিশাচর হয়। সমুদ্রে দিনের বেলায় আলস্যে দিন কাটায় আর রাত হলেই শিকারির রূপ ধারণ করে।

নাইজারে মিলেছে বিশালাকার সাউরাপড ডাইনোসরের কঙ্কাল বা জীবাশ্মের খোঁজ
কিথ ল্যাজনিস্কি/ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

৪. দৈত্যাকার ডাইনোসরের খোঁজে

সেরা ছবির তালিকায় কিথ ল্যাজনিস্কির তোলা একটি ছবি দেখা যায়। নাইজারের টেনেরে এলাকায় ছবিটি তোলা। সেখানে অভিযাত্রী পল সেরেনো বিশালাকার সাউরাপড ডাইনোসরের কঙ্কাল বা জীবাশ্মের খোঁজ পান। এই জীবাশ্ম প্রাথমিকভাবে গবেষণার জন্য পাঠানো হবে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। অভিযাত্রী পল ১৯৮৮ সাল থেকে ডাইনোসরদের খোঁজে আছেন। ১৯৮৮ সালে তিনি পৃথিবীর প্রথম দিককার ডাইনোসর ইওরাপটরের খোঁজ পান। ভারতের মুম্বাইতে এশিয়া অঞ্চলের প্রথম ডাইনোসরের খোঁজ পান তিনি। পৃথিবীর পাঁচ মহাদেশেই ডাইনোসরের খোঁজে সাফল্য আছে তাঁর।

বাদুড় নিয়ে গবেষণা
নিকোল সোবেকি/ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

৫. বাদুড়ের ওড়ার কৌশল

যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ব্রুক কুইন ও শ্যারন সাওয়ার্ট। বাদুড় নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা। বাদুড়ের স্নায়ু কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে গবেষণা তাঁদের। এই গবেষণার ছবি তুলেছেন নিকোল সোবেকি। মার্কিন আলোকচিত্রী নিকোল সোবেকি বেশির ভাগ সময় থাকেন কেনিয়ার নাইরোবিতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে টাফটস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করলেও জলবায়ু-পরিবেশ নিয়ে ছবি তোলায় আগ্রহ তাঁর।

মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণার ছবি স্থান পেয়েছে সেরার তালিকায়
ম্যাক অ্যাগুইলেরা-হেলেউইগ/ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

৬. মৃত কোষে প্রাণের সঞ্চার

মস্তিষ্কের কোষ নিয়ে অনেক রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি। মস্তিষ্কের এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের যোগাযোগের কৌশল নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা মৃত মস্তিষ্কের কোষকে সক্রিয় করার কৌশল আয়ত্ত করেছেন। সেই গবেষণার একটি ছবি তুলেছে ম্যাক অ্যাগুইলেরা-হেলেউইগ।

নাসার ইউরোপা ক্লিপার খেয়াযানের কাজ চলছে
ক্রিস গান/ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

৭. খেয়াযানের মস্তিষ্কে

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় জেট প্রোপালসন সেন্টারে নানা ধরনের খেয়াযানের গবেষণা চলে। সেখানে কাজ চলছে নাসার ইউরোপা ক্লিপার খেয়াযানের। বৃহস্পতি গ্রহের সবচেয়ে বড় চাঁদের অভিযানে নেতৃত্ব দেবে এই খেয়াযান। সেই চাঁদের লবণাক্ত ও বরফাচ্ছন্ন সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করবে এই যান। জেট প্রোপালসন সেন্টারের ছবি তুলেছেন ক্রিস গান।

সি ক্রাইট সাপ
কিলি ইউয়ান/ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

৮. প্রচ্ছদে সাপের ছবি

প্রাণবৈচিত্র্যের ভিন্নতা দেখা যায় পালাউ দ্বীপাঞ্চলে। ২০১৫ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপাঞ্চলে প্রায় ২ লাখ বর্গমাইলের সামুদ্রিক অভয়ারণ্য তৈরি করা হয়। নানা বিপন্ন প্রজাতির প্রাণের দেখা মেলে এখানে। সেই এলাকার রক আইল্যান্ড সাউদার্ন লেগুন থেকে একটি সামুদ্রিক সাপের ছবি তুলেছেন কিলি ইউয়ান। সি ক্রাইট নামের এই সামুদ্রিক সাপকে দূর থেকে সাদা–কালো রশির মতো মনে হয়। সামুদ্রিক হলেও এই সাপ ডিম পাড়তে সৈকতে আসে। এই ছবি দিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ডিসেম্বের ২০২৩ সংখ্যার প্রচ্ছদ করা হয়েছে।

দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে তোলা ছবি
রেনান ওজতুর্ক/ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

৯. লাভা হ্রদের খোঁজে

দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে তোলা আরেকটি ছবি তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। আগ্নেয়গিরি–বিশেষজ্ঞ ও পর্বতারোহীরা দক্ষিণ স্যান্ডউইচ দ্বীপপুঞ্জের দূরবর্তী আগ্নেয়গিরি মাউন্ট মাইকেলে প্রায় অভিযান পরিচালনা করেন। সফলভাবে সেই আগ্নেয়গিরিতে প্রথমবারের মতো আরোহণ করেন অভিযাত্রীরা। পৃথিবীতে যে কয়েকটি লাভা হ্রদ আছে, তার মধ্যে একটির অবস্থান এখানে। সেই অভিযানের ছবি তুলেছেন রেনান ওজতুর্ক। এই আগ্নেয়গিরির উচ্চতা ৮৪৩ মিটার। ১৭৭৫ সালে অভিযাত্রী জেমস কুক এই আগ্নেয়গিরির খোঁজ পান। ২০১৯ সালে এই আগ্নেয়গিরিতে লাভা হৃদের খোঁজ মেলে। সারা পৃথিবীতে মাত্র আটটি আগ্নেয়গিরিতে এমন হ্রদের দেখা মেলে।

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ও ইউএস টুডে