দুই নারী জ্যোতির্বিদের নামে দুই গ্রহাণুর নামকরণ
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!/ বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ ভেদাভেদ না থাকলেও বিজ্ঞানের দুনিয়াতে নারীদের উপস্থিত বেশ কম। তার ওপর স্বীকৃতি না দেওয়ার চেষ্টা তো রয়েছে হাজার বছর ধরেই। এই যেমন উনিশ শতকের দুই নারী জ্যোতির্বিদ অ্যানি মাউন্ডার ও অ্যালিস এভারেটের নাম যেন হারিয়ে গিয়েছিল অনেকটা। ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য অ্যানি মাউন্ডার ও অ্যালিস এভারেট ছিলেন প্রথম পেশাদার জ্যোতির্বিদ, যাঁরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই দুই নারী জ্যোতির্বিদ অসংখ্য তারা ও মহাজাগতিক ঘটনা তালিকাবদ্ধ করেছেন। উনিশ শতকের আশির দশকে কেমব্রিজের গিরটন কলেজে গণিত বিভাগে পড়ার সময় পরিচিত হন এই দুই নারী জ্যোতির্বিদ। পরবর্তী সময়ে বন্ধুত্বে পরিণত হয় তাঁদের সম্পর্ক। ক্যাটালিনা স্কাই সার্ভে নামের বিখ্যাত গবেষণার জন্য এই দুই জ্যোতির্বিদ আলোচিত ছিলেন। আর তাই দেরিতে হলেও ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন দুই নারীর নামে দুটি গ্রহাণুর নামকরণ করেছে।
মহাকাশ বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে দুই নারীর ভূমিকা এখন নতুন করে গুরুত্ব পাচ্ছে। ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ইতিহাস বিভাগের প্রধান মাইক ফ্রস জানান, এই দুই নারী দারুণ সব কাজ করেছেন। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজের নারী শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি পেতেন না, শুধু পরীক্ষায় পাস করার সুযোগ পেতেন। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে রয়েল অবজারভেটরিতে “লেডি কম্পিউটার” পদে যোগ দেন তাঁরা। লেডি কম্পিউটারদের কাজ ছিল তারার অবস্থানের তথ্য জ্যোতিবিজ্ঞানের টেবিলে নথিবদ্ধ করা। সেই সময় অনেক মেধাবী নারী এ ধরনের কাজ করেছেন, যাঁদের সম্মানী ছিল বেশ কম।
গ্রিনিচ থেকে সবচেয়ে বড় সানস্পটের ঘটনা ধারণের পরে অ্যানি মাউন্ডার বিয়ে করেন আরেক জ্যোতির্বিদ এডওয়ার্ড ওয়াল্টার মাউন্ডারকে, যিনি গ্রিনিচ মানমন্দিরের কর্মকর্তা ছিলেন। বিয়ের কারণে অ্যানি মাউন্ডারকে বাধ্যতামূলকভাবে চাকরি ছাড়তে হয়। তবে স্বামীর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানান কাজে যুক্ত হন তিনি। সূর্যগ্রহণের নানান ছবি তোলার জন্য খ্যাতি পান অ্যানি মাউন্ডার। শুধু তা–ই নয়, স্বামীর সঙ্গে বিখ্যাত বাটারফ্লাই চার্ট তৈরি করেন তিনি, যার মাধ্যমে সানস্পট শনাক্ত করা যেত; যদিও সেই চার্টের উদ্ভাবক হিসেবে তাঁর নাম নেই। দুজন মিলে এ বিষয়ে বই লিখলেও লেখক হিসেবে অ্যানি মাউন্ডারের স্বীকৃতি জোটেনি।
নারী হওয়ার কারণে ১৯১৬ সালে রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সামনে বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রও উপস্থাপন করতে পারেননি অ্যানি মাউন্ডার। তবে নিজগুণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এই নারী। চাঁদের ক্যাটার মাউন্ডারের নামকরণ করা হয়েছে অ্যানি মাউন্ডার ও তাঁর স্বামীর নামে। ২০১৬ সালে রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি অ্যানি মাউন্ডারের নামে মেডেল চালু করেছে। শুধু তা–ই নয়, ২০১৮ সালে তাঁর নামে একটি টেলিস্কোপ স্থাপন করে রয়েল অবজারভেটরি মানমন্দির। অবশেষ ‘গ্রহাণু ৫০৭২৬’–এর নামকরণও করা হয়েছে অ্যানি মাউন্ডারের নামে।
অন্যদিকে, অ্যালিস এভারেট মাত্র এক বছরে ২২ হাজারের বেশি তারকার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেন। মানমন্দিরে তাঁর চাকরির সুযোগ মিললেও বাদ পড়েন তিনি। নারীরা কী কাজ করবেন—এ যুক্তিতে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে অপটিকস নিয়ে গবেষণা করেন অ্যালিস এভারেট। প্রথম নারী হিসেবে জার্নাল অব ফিজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনে ১৯০৩ সালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ সালে পদার্থবিদ হিসেবে কাজ শুরু করা অ্যালিস এভারেট পরবর্তী সময়ে বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এ সময় টেলিভিশনের উদ্ভাবক জন লজি বেয়ার্ডের সঙ্গে কাজ করেন তিনি। আর তাই টেলিভিশন অপটিকসের মেধাস্বত্বে যৌথ মালিকানা রয়েছে বেয়ার্ড ও অ্যালিস এভারেটের। বর্তমানের টেলিভিশনশিল্পের বিকাশে অ্যালিস এভারেটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ‘গ্রহাণু ৫০৭২৭’–এর নামও তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান ও ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন