শনি গ্রহের বলয় আসলে কী দিয়ে তৈরি
আমাদের সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ শনির কথা উঠলেই চোখের সামনে উজ্জ্বল বলয়বেষ্টিত এক গ্রহের ছবি ভেসে ওঠে। এই বলয় হাজার হাজার কিলোমিটার চওড়া হলেও উচ্চতায় মাত্র ১০ মিটারের মতো পুরু। এই জ্যামিতিক কাঠামোর কারণেই শনির সৌন্দর্য এত আকর্ষণীয়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শনির বলয় যতটা পাতলা আমরা ভাবি, আসলে তা নয়। বলয় থেকে ছিটকে আসা ধূলিকণা মূল সমতলের অনেক ওপরে ও নিচে ভাসছে। বলয় গ্রহটির চারপাশে এক বিশাল ও রহস্যময় আভা বা হ্যালো তৈরি করেছে।
এই আবিষ্কারের ফলে শনির বলয় ব্যবস্থার চিরাচরিত চিত্রটি বদলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, শনিকে এখন আর কেবল একটি চ্যাপটা রেকর্ড প্লেয়ারের মতো নয়; বরং একটি বিশাল ধুলার ডোনাটের মতো দেখাচ্ছে।
শনি গ্রহের বলয় নিয়ে রহস্যের সূত্রপাত ২০১৭ সালে, নাসার ক্যাসিনির মিশনের শেষ বছরে। সে সময় ক্যাসিনি মহাকাশযানটিকে শনির বলয়ের অত্যন্ত কাছ দিয়ে ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ কক্ষপথে ঘোরানো হয়েছিল। প্রতিটি চক্করে ক্যাসিনি বলয়ের সমতল থেকে শনির ব্যাসার্ধের প্রায় তিন গুণ উচ্চতা পর্যন্ত ওপরে ও নিচে যাতায়াত করেছিল।
এই অভিযানের সময় ক্যাসিনির কসমিক ডাস্ট অ্যানালাইজার বলয়ের মূল সমতল থেকে অনেক উঁচুতে শত শত ক্ষুদ্র ধূলিকণার অস্তিত্ব রেকর্ড করে। রাসায়নিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই কণাতে আয়রনের পরিমাণ খুব কম, যা ঠিক শনির মূল বলয়ের ধূলিকণার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়। শনির সিস্টেমের অন্য কোথাও এমন বৈশিষ্ট্যযুক্ত কণা পাওয়া যায় না। ধূলিকণা আসলে বলয় থেকেই এসেছে, কিন্তু নিজ জায়গা ছেড়ে অনেক দূরে পাড়ি জমিয়েছে।
শনির বলয়ের সমতল থেকে এক লাখ কিলোমিটারেরও বেশি উচ্চতায় এই ধূলিকণার উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের অবাক করেছে। মহাকর্ষ বল, কণার পারস্পরিক সংঘর্ষ ও তড়িৎ-চুম্বকীয় শক্তি সাধারণত সব কণাকে বলয়ের মূল সমতলেই আটকে রাখে। সাধারণ পদার্থবিজ্ঞানের তথ্যমতে, কোনো কণাকে এই মহাকর্ষীয় বাঁধন ছিঁড়ে এত উঁচুতে উঠতে হলে সেকেন্ডে অন্তত ২৫ কিলোমিটার গতিবেগ প্রয়োজন। সাধারণ কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ধূলিকণার পক্ষে এত গতি অর্জন করা প্রায় অসম্ভব।
গবেষকদের তথ্যমতে, ক্ষুদ্র উল্কাপিণ্ড বা মাইক্রো-মেটিওরাইট প্রতিনিয়ত শনির বলয়কে আঘাত করছে। এই সংঘর্ষের কারণে যে ধুলাবালু ছিটকে বের হয়, তা ওপরে উঠে যেতে পারে। তবে কেবল কঠিন বস্তুর সংঘর্ষে প্রয়োজনীয় গতি পাওয়া কঠিন। তবে নতুন একটি তত্ত্ব বলছে, শনির বলয়ের বরফ খণ্ডে আটকে থাকা পাথুরে কণা যখন অতি উচ্চ গতির উল্কার আঘাত পায়, তখন সেখানকার তাপমাত্রা প্রচণ্ড বেড়ে যায়। এ কারণে বরফ ও পাথর মুহূর্তের মধ্যে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। এই বাষ্প কঠিন টুকরার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। পরবর্তী সময় সেই বাষ্প শীতল হয়ে সূক্ষ্ম ধূলিকণায় পরিণত হয় ও বলয়ের অনেক ওপরে একটি বিশাল আভা তৈরি করে।
বিজ্ঞানীরা আগে ভাবতেন, শনি গ্রহের বলয় একটি স্থির ও নাজুক কাঠামো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এগুলো আসলে অত্যন্ত গতিশীল ও ছিদ্রযুক্ত কাঠামো, যেখানে প্রতিনিয়ত পদার্থগুলো স্থান পরিবর্তন করছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ শক্তির সংঘর্ষ বলয় থেকে সামান্য পরিমাণ পদার্থকে ওপরের দিকে ও বাইরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা গ্রহের আকারের সমান একটি ধুলার কুয়াশা তৈরি করছে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই একই পদার্থবিজ্ঞান ইউরেনাস বা নেপচুনের মতো অন্যান্য বলয়ধারী গ্রহের ক্ষেত্রেও সত্য হতে পারে। সরাসরি দেখা না গেলেও ক্যাসিনির মতো সূক্ষ্ম পরিমাপের মাধ্যমে হয়তো মহাবিশ্বের অন্য গ্রহগুলোতেও এমন রহস্যময় ধুলোর আভার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে।
সূত্র: আর্থ ডট কম