বিকল্প চর্বি ও তেল তৈরিতে বিল গেটসের বিনিয়োগ কেন?

বিল গেটসরয়টার্স

অবসর নেওয়ার পর মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করছেন। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব রোধে বিকল্প চর্বি ও তেল উৎপাদনের দুটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠান দুটির কাজের ধরন ও পরিকল্পনার খবর নিজের ব্লগ গেটস নোটস ডটকমে প্রকাশও করেছেন তিনি। লেখাটি সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো।

চিজ বার্গার আমার প্রিয় খাবার। যদিও চিজ বার্গার পরিবেশের ওপর অনেক প্রভাব ফেলে। সেই বিবেচনায় চিজ বার্গার আমার প্রিয় না হলে ভালো হতো। আমি অনেক ধরনের বিকল্প মাংস খেয়ে দেখেছি। বর্তমানে বাজারে এমন কোনো বিকল্প মাংস নেই, যা আমার মতো বার্গারপ্রেমীকে বোকা বানাতে পারে। স্বাদ প্রায় কাছাকাছি হলেও এসব বিকল্প উপাদানে অনেক কিছু অনুপস্থিত থাকে। চর্বিযুক্ত তৈলাক্ত সিজল স্যান্ডউইচকে মজাদার করে তোলে। এত সুস্বাদু হয় যে বিকল্প কোনো কিছু দিয়ে এসব তৈরি করা কঠিন। প্রাণিজ চর্বিতেই সব স্বাদ লুকিয়ে আছে। চর্বির কারণেই বিভিন্ন খাবার স্বাদ হয়।

দুর্ভাগ্যক্রমে প্রাণিজ চর্বি জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৫ হাজার ১০০ টন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। প্রাণী ও গাছপালা থেকে চর্বি ও তেল সংগ্রহের সময়ই নির্গত হয় প্রায় সাত শতাংশ গ্যাস। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের এই সংখ্যা শূন্যে নামাতে হবে। আমাদের পরিকল্পনায় শুধু মানুষকে পছন্দের খাবার বাদ দেওয়ার বিষয়টি আনলে চলবে না, মানুষ বড় একটি কারণে প্রাণিজ চর্বি খায়। এই চর্বি সবচেয়ে পুষ্টিকর ও ক্যালরিযুক্ত ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট। একইভাবে আমরা তাৎক্ষণিক শক্তির জন্য চিনি খেতে চাই। আমাদের প্রয়োজন প্রাণিজাত পণ্যে পাওয়া চর্বি অণু তৈরির নতুন উপায়। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, প্রাণীর দুর্ভোগ বা বিপজ্জনক রাসায়নিক ছাড়াই নতুন উপায় বের করতে হবে। আর সব বিকল্পকে সাশ্রয়ী মূল্যের হতে হবে।  

আরও পড়ুন

স্বপ্নের মতো শোনাতে পারে, সেভর নামক একটি কোম্পানি বিকল্প চর্বি তৈরি করতে কাজ করছে। যেখানে আমি বিনিয়োগ করেছি। প্রতিষ্ঠানটিতে তৈরি সব চর্বি কার্বন ও হাইড্রোজেন পরমাণুর বিভিন্ন মিশ্রণ দিয়ে তৈরি করা হয়। এ জন্য প্রথমে বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও পানি থেকে হাইড্রোজেন সংগ্রহ করা হয়। তারপর তা গরম করে ফ্যাটি অ্যাসিডকে ভেঙে চর্বি গঠনের জন্য অক্সিডাইজ করা হয়। যার ফলে চর্বির অণু তৈরি করা যায়। একই অণু আমরা দুধ, পনির, গরুর মাংস ও উদ্ভিজ্জ তেল থেকে পাই। এই প্রক্রিয়ায় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বা কোনো কৃষিজমি ব্যবহার হয় না। কৃষিকাজে যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করা হয়, তার এক হাজার ভাগের এক ভাগ কম পানি ব্যবহার হয় না এই প্রক্রিয়ায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নতুন বিকল্প চর্বির স্বাদ সত্যিই ভালো।

আরও পড়ুন

আমি সেভারের অনেক পণ্যের স্বাদ নিয়েছি। প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে আমি সত্যিকারের মাখন খাচ্ছি না। বার্গারের স্বাদও প্রায় আসল বার্গারের মতো। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দাম। চর্বির বিকল্প পণ্য জনসাধারণের কাছে সাশ্রয়ী হওয়া প্রয়োজন। প্রাণিজ চর্বির ওপর নজর দেওয়ার কারণ আছে। প্রাণিজ চর্বি জলবায়ুর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। অনেক প্রিয় খাবার তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাতারাতি সব প্রাণিজ চর্বি উৎপাদন কমানো যাবে না। উদ্ভিজ্জ চর্বি ও তেল জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য নতুন সমস্যা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে পাম তেল, যা এখন বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত উদ্ভিজ্জ চর্বি। পাম তেল নিয়ে সমস্যা অন্য ধরনের। পামগাছ মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার স্থানীয় গাছ। সর্বত্র জন্মায় না। গাছটি বিষুবরেখার পাঁচ থেকে দশ ডিগ্রির মধ্যেই ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। সারা বিশ্বে নিরক্ষীয় অঞ্চলে রেইনফরেস্টের বন উজাড় করে তৈরি হচ্ছে পামবাগান।

বন পোড়ানোর কারণে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। যে জলাভূমিতে বন থাকে, তা ধ্বংস হলে জলাভূমি সঞ্চিত কার্বনমুক্ত করে দেয়। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন করে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী বিমানশিল্পের প্রায় সমান কার্বন নির্গত হয় বন উজাড়ের কারণ। দুর্ভাগ্যক্রমে পাম তেলের বিকল্প খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। পাম সস্তা, গন্ধহীন এবং প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। বেশির ভাগ উদ্ভিজ্জ তেল ঘরের তাপমাত্রায় তরল থাকে। পাম তেল কিছুটা কঠিন আর গলিতভাবে থাকে। পাম তেল প্রাকৃতিক সংরক্ষণকারী হিসেবে কাজ করে। দোকানে অনেক দিন রাখা যায়। পাম তেল একমাত্র উদ্ভিজ্জ তেল, যার মধ্যে স্যাচুরেটেড ও অসম্পৃক্ত চর্বি প্রায় সমান ভারসাম্যে থাকে।

সি১৬ বায়োসায়েন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সাল থেকে পাম তেলের বিকল্প খুঁজছে। এখানে আমি বিনিয়োগ করেছি। প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে বন্য ইয়েস্টের জীবাণু থেকে নতুন তেল তৈরি করেছে। নতুন বিকল্প তেলটি প্রচলিত পাম তেল থেকে আলাদা এবং উৎপাদনের সময় কোনো গ্যাস নির্গত হয় না। নতুন বিকল্প তেলে পাম তেলের মতোই ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। ফলে পাম তেলের পরিবর্তে সহজেই ব্যবহার করা যায়। পাম তেলের মতো নতুন তেল প্রাকৃতিক। গাছের পরিবর্তে ছত্রাকের ওপর জন্মায় নতুন তেল। এখানে পুরো প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে কৃষিমুক্ত। মিডটাউন ম্যানহাটনের একটি ল্যাবে এই তেল তৈরি হচ্ছে। গত বছর সংস্থাটি প্রথম পণ্য চালু করে।

গবেষণাগারে তৈরি চর্বি ও তেল ব্যবহারের ধারণাটি প্রথমে অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। আসলে আমাদের কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো প্রয়োজন। প্রযুক্তি ও নতুন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জলবায়ু রক্ষার লক্ষ্য অর্জনে এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।