কচুরিপানা দিয়ে জুতার অনুষঙ্গ তৈরি করেছেন বুটেক্সের ৪ শিক্ষার্থী

কচুরিপানা ও ডেনিমের সমন্বয়ে তৈরি পরিবেশবান্ধব জুতাসংগৃহীত

বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে কচুরিপানা একটি পরিচিত সমস্যা। এই সাধারণ জলজ উদ্ভিদ উপদ্রব হিসেবে বিবেচিত হলেও একদল শিক্ষার্থী নতুন এক উদ্ভাবনী উপায়ে টেকসই পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে কচুরিপানাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছেন। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) শিক্ষার্থী অন্বয় দেবনাথ, অর্ণব হালদার, ফারদীন বিন মনির ও তাশফিক হোসাইন কচুরিপানা দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে জুতার ইনসোল (ভেতরের সোল) ও বাইরের সোল তৈরি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মার্জিয়া দুলালের তত্ত্বাবধানে কচুরিপানা ও ফেলে দেওয়া ডেনিমের সমন্বয়ে পরিবেশবান্ধব এসব অনুষঙ্গ তৈরি করেছেন তাঁরা।

সমস্যা থেকে সমাধান

অন্বয় দেবনাথের বেড়ে ওঠা গ্রামীণ পরিবেশে। বাবা ব্যাংকার হওয়ার কারণে দেশের নানা প্রান্তে থেকেছেন। গ্রামের পরিবেশে থাকার কারণে কচুরিপানার সমস্যাটি কাছ থেকে দেখেছেন। কচুরিপানা সম্পর্কে অন্বয় বলেন, ‘এই অপ্রয়োজনীয় উদ্ভিদটি খাল–বিলের পানির চলাচলই ব্যাহত করে। একই সঙ্গে দ্রুত বর্ধনশীল বলে প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কাজের শুরুর দিকে এই বিষয় আমাদের মাথায় ছিল। একই সঙ্গে আধুনিক ফ্যাশনশিল্পে ডেনিম উৎপাদনে বিপুল পরিমাণ পানির ব্যবহার ও পরিবেশের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে আমরা ক্লাসে পড়েছি। এই দুটি সমস্যার মধ্যে একটি যোগসূত্র খুঁজে বের করার পাশাপাশি বর্জ্য থেকে কার্যকরী ও টেকসই পণ্য তৈরির জন্য কাজ শুরু করি আমরা।’

মার্জিয়া দুলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের এমন টেকসই উদ্যোগ অনুপ্রেরণার। পড়ালেখার অংশ হলেও শিক্ষার্থীরা বেশ আগ্রহ নিয়ে এই কাজ করেছে। ল্যাব থেকে এখন পুরো কাজটি বাণিজ্যিক আকারে তৈরির জন্য আরও কাজ করতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ থেকে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ উদ্ভাবনের জন্য অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছি আমরা। শিক্ষার্থীদের এমন টেকসই উদ্ভাবন আমাদের স্থানীয় ও বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের নতুন সুযোগ করে দিচ্ছে।’

কচুরিপানা দিয়ে তৈরি জুতার সোল
সংগৃহীত

কচুরিপানা ও ডেনিমের মেলবন্ধন

বুটেক্সের এই শিক্ষার্থীরা ল্যাব কোর্সের অংশ হিসেবে প্রথমে গন্ধহীন মোজা তৈরির কাজ হাতে নেন। শেষ পর্যন্ত শিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করে কচুরিপানা দিয়ে জুতার অনুষঙ্গ তৈরি করার কাজ শুরু করেন। এরপর দীর্ঘ গবেষণা শেষে জুতার ইনসোল ও বাইরের সোল কচুরিপানা থেকে তৈরির পাশাপাশি ফেলে দেওয়া ডেনিম কাজে লাগিয়ে জুতার ওপরের বহিরাবরণ তৈরি করেন তাঁরা।

গ্রামীণ ও বৈশ্বিক সমস্যার সংযোগ

ডেনিম এখন বিশ্বজুড়ে বস্ত্রশিল্পের একটি বড় অংশ। অন্বয় জানান, এর পরিবেশগত প্রভাব বিশাল। একটি জিনস প্যান্ট তৈরিতে গড়ে ৩ হাজার ৭৮১ লিটার পর্যন্ত পানি প্রয়োজন হতে পারে। তুলা চাষ থেকে শুরু করে রং করা ও প্রক্রিয়াকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে এই পানির প্রয়োজন হচ্ছে। এর ফলে পানির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে রাসায়নিক দূষণের ঝুঁকি থাকে। বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী, বস্ত্রশিল্প বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দূষণকারী শিল্প। এই পটভূমিতে, ফেলে দেওয়া ডেনিমকে নতুন পণ্যে পুনর্ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে কচুরিপানা বিশ্বের অন্যতম আক্রমণাত্মক জলজ উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। এরা অত্যন্ত দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। বিভিন্ন গ্রামীণ জলাশয়ের উপরিভাগজুড়ে একটি পুরু স্তর তৈরি করে। কচুরিপানা পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করে। খাল, বিল, নদী ও পুকুরে এটি পানির চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে। কচুরিপানার কারণে পানির নিচে সূর্যালোক পৌঁছাতে পারে না। এতে জলজ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ ব্যাহত হয়, অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, কচুরিপানার দ্রুত বৃদ্ধি স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে।

কচুরিপানা দিয়ে পরিবেশবান্ধব জুতার অনুষঙ্গ তৈরি করা বুটেক্সের শিক্ষার্থীরা
সংগৃহীত

ব্যবহারিক চ্যালেঞ্জ

পুরো কাজটি তাঁরা বুটেক্সের ল্যাব কোর্সের অংশ হিসেবে প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট ল্যাবে তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন করেছেন। তাঁদের এই কাজে কচুরিপানা সংগ্রহের বিষয়টি ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই প্রকল্পের আরেক সদস্য অর্ণব হালদার জানান, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানের কচুরিপানা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করি। এসবের আকার ছিল ছোট, যা জুতা তৈরির জন্য উপযুক্ত নয়। পরে আমরা পটুয়াখালীতে প্রায় দুই হাত লম্বা কচুরিপানার খোঁজ পাই। যেহেতু আমার বাসা পটুয়াখালীতেই, তাই সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কচুরিপানা সংগ্রহ করি। বাসার ছাদে কচুরিপানা শুকাই আমরা। শুকানোর পর চার থেকে পাঁচ কেজি কচুরিপানা ঢাকায় নিয়ে এসে ল্যাবে জুতা তৈরির কাজ শুরু করি।’

নতুন পথে যাত্রা

এই জুতার একটা বিশেষত্ব হচ্ছে ব্যবহারের পরে সোল ৩ থেকে ৪ মাস ও ডেনিম অংশ ১০ থেকে ১২ মাসের মধ্যে মাটিতে মিশে যাবে। দলের আরেক সদস্য তাশফিক হোসাইন জানান, ‘শুরুর দিকে বেশ কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা ছিল আমাদের। প্রাথমিকভাবে গন্ধহীন মোজা তৈরির চেষ্টা করছিলাম আমরা। সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে সেই পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়। চার বন্ধুর সমন্বয়ে গঠিত দলটি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে বলে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল। একসঙ্গে কাজ করার জন্য আমাদের ভৌগোলিক দূরত্ব একটি চ্যালেঞ্জ ছিল—কেউ থাকেন মিরপুর, কেউ থাকেন ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডে। সব মিলিয়ে টানা তিন মাসের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অবশেষে দারুণ একটা পণ্য উদ্ভাবন করতে পেরে আমরা আনন্দিত।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

সারা বিশ্বে টেকসই ফ্যাশন পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা সেই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই কাজ করছেন। অর্ণব জানান, ‘ভবিষ্যতে কচুরিপানার জুতা নিয়মিত ব্যবহার উপযোগী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট ও স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এতে জুতার স্থায়িত্ব ও ব্যবহারিক গুণাগুণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। এই উদ্ভাবন শুধু একটি পণ্য তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে আগ্রহী নই আমরা। কচুরিপানাকে একটি মূল্যবান সম্পদে রূপান্তরিত করার সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্রশিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি কার্যকর সমাধানের পথ তৈরি করতে চাই আমরা।’ দলের আরেক সদস্য ফারদীন বিন মনির জানান, ‘আমরা শুধু কোনো পণ্য বানানোর জন্যই কাজটি শুরু করিনি, টেকসই একটা পণ্য তৈরির লক্ষ্যে এই কাজ করেছি। ভবিষ্যতে আমরা এই কাজ আরও সামনে নিয়ে যেতে চাই।’