সূর্যগ্রহণ দেখতে ছুটছেন লাখো মানুষ

দ্য গ্রেট আমেরিকান এক্লিপ্সে সূর্যের ছবি তোলার জন্য নিজের ক্যামেরা নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে ছবি তোলার চর্চা করেন মুনীম রানা। ৪ মার্চ সূর্যের এই ছবি তোলেন, যেখানে ভালো করে তাকালে সৌরদাগ দেখা যায়সংগৃহীত

মহাজাগতিক অনেক ঘটনা সারা বিশ্বের মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। এমনই এক ঘটনা দেখা যাবে আজ ৮ এপ্রিল। যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডার নির্দিষ্ট কিছু স্থান থেকে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, স্পেন, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল ও আইসল্যান্ডের নির্দিষ্ট স্থান থেকে আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। বিবিসি জানিয়েছে, পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখতে উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন শহরে কয়েক লাখ মানুষ ভিড় করছেন।

বিরল অভিজ্ঞতার টানে সবাই ছুটছেন

সেই ভিড়ের গল্প জানতে প্রথম আলোর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসপ্রবাসী পদার্থবিদ মুনীম রানার সঙ্গে। তিনিও ছুটছেন সূর্যগ্রহণ প্রত্যক্ষ করতে। আজ বিকালে মুনীম রানা জানান, বিশালাকার সূর্যকে সেই সময় দেখতে পাতলা রিংয়ের মতো লাগে। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণে চাঁদের ছায়া পড়ে সূর্য পুরোপুরি ঢেকে যায়। দিনের বেলায় কিছু সময়ের জন্য ভুতুড়ে রাতের আঁধার নেমে আসে। বিরল এই অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য লাখো মানুষ ছুটে আসছেন টেক্সাসসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে। যেসব শহর বা রাস্তায় সূর্যের ওপর চাঁদের ছায়া পড়ার বিরল অভিজ্ঞতা দেখা যাবে, সেখানে অনেক ভিড় জমছে। এই সূর্যগ্রহণ দেখতে অন্য শহর থেকে শুধু আরকানসাস অঙ্গরাজ্যে সাড়ে সাত লাখের বেশি গাড়ি প্রবেশ করেছে।

যে কারণে অনন্য এই সূর্যগ্রহণ

সময়ের কারণে এরই মধ্যে এই সূর্যগ্রহণকে ‘গ্রেট আমেরিকান সূর্যগ্রহণ ২০২৪’ বলে ডাকছেন শৌখিন জ্যোতির্বিদেরা। মুনীম রানা বলেন, সূর্যগ্রহণ যে পথে (প্রায় ২০০ মাইল) দেখা যাবে, সেই নির্দিষ্ট এলাকায় ৩ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ এই গ্রহণ সরাসরি দেখতে পাবেন। আর বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ও দেশ থেকে আরও ৫০ লাখের বেশি মানুষ এসব এলাকায় এই সূর্যগ্রহণ দেখতে ভিড় করেছেন। সব মিলিয়ে এই সূর্যগ্রহণ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় ৮০মিনিট ধরে বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখা যাবে। স্থানভেদে সর্বোচ্চ ৪ মিনিট ২৭ সেকেন্ড সময় ধরে দেখা যাবে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে দেখার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। গ্রহণ দেখার জন্য বিশেষ রোদচশমা আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে সবাই প্রস্তুত। সূর্যগ্রহণের মানচিত্রটি খেয়াল করলে একটি সবুজ রেখা দেখা যাবে। সেই বরাবর জায়গাগুলোতে নিচ থেকে ওপরে পশ্চিম থেকে পূর্বে যেতে থাকলে সর্বোচ্চ ৪ মিনিট ২৭ সেকেন্ড রাতের মতো অন্ধকার নেমে আসবে। কিছুক্ষণের জন্য এসব এলাকায় আকাশে তারার দেখাও মিলবে ভরদুপুরে।

যাত্রা পথে মুনীম রানা
সংগৃহীত

লোকে লোকারণ্য সব

টেক্সাস থেকে মুনীম রানা বলেন, এখানে এখন অনেক মানুষের ভিড়। যে হোটেলকক্ষের ভাড়া ছিল ৬০ ডলার করে, সেটির ভাড়া এখন এক হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গ্যাস স্টেশনসহ খাবারের বিভিন্ন দোকানে অনেক মানুষের ভিড়। ভিড় সামলাতে রাস্তায় বড় বড় বিলবোর্ডে কর্তৃপক্ষ সতর্কতা নোটিশ জারি করেছে। যেখানে–সেখানে গাড়ি থামিয়ে সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সাধারণভাবে সূর্যগ্রহণ হয়তো কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু এবারের গ্রহণটি একটু বেশিই আলাদা।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তথ্যমতে, বিভিন্ন এলাকা থেকে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ ১ থেকে সাড়ে ৪ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হবে। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। ৪ মিনিট ২৭ সেকেন্ড পর্যন্ত দেখা যাবে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ। মুনীম রানা বললেন, ‘যদিও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ার কারণে সেই সুযোগ থেকে কিছুটা বঞ্চিত হচ্ছি আমরা। এত লোকের ভিড়ে মোবাইল ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক কিছুটা ধীর হয়ে গেছে। প্রায় ৫০০ মাইল পেরিয়ে ডালাস থেকে আরকানসাসের মাউন্টেন হোম এলাকায় আমরা ছুটে এসেছি। সব মিলিয়ে ১০ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালিয়ে আমরা তিনজন চলে এসেছি। এখানে অনেকেই হাজার হাজার মাইল ছুটে সূর্যগ্রহণ দেখতে আসছেন।’

মুনীম রানা সূর্যগ্রহণ দেখতে সঙ্গে নিয়েছেন নেক্সটার ৮এসই কম্পিউটারাইজড টেলিস্কোপ
সংগৃহীত

ছবি তোলার প্রস্তুতি

শৌখিন জ্যোতির্বিদেরা নিজেদের আগ্রহ অনুসারে সূর্যগ্রহণের ছবি তোলার প্রস্তুতি নিয়েছেন। মুনীম রানাও সূর্যগ্রহণের ছবি তুলতে চান। তিনি বলেন, ‘এরপরের সূর্যগ্রহণ আরও ২০ বছর পরে দেখা যাবে। দারুণ এই মুহূর্ত আমি ধরে রাখতে চাই। সূর্যগ্রহণের ছবি তোলার জন্য বেশ কিছু যন্ত্রপাতি আমি সংগ্রহ করেছি বেশ কয়েক মাস ধরে। আমার আছে আধুনিক একটি টেলিস্কোপ আছে। এই টেলিস্কোপ অটোমেটিক ট্র্যাক করতে পারে। নেক্সটার ৮এসই কম্পিউটারাইজড টেলিস্কোপ ব্যবহার করছি। ২০৩২ মিলিমিটার শ্মিডিট-ক্যাসাগ্রিন অপটিক্যাল ডিজাইনের এই টেলিস্কোপের ফোকাল লেন্থ ২০৩২ মিলিমিটার। এর সঙ্গে এক্লিপস স্মার্ট নামের ফ্লিটার ব্যবহার করব। এ ছাড়া ছবি তোলার জন্য ৬০০ মিলিমিটার লেন্সের ডিএসএলআর ক্যামেরা ব্যবহার করব। ক্যামেরার সঙ্গে থাকবে ফিল্টার। নর্থ স্টারকে অনুসরণ করা একটা মাউন্ট ব্যবহার করব। আমার ৬ পাউন্ডের ক্যামেরা ও ৫ পাউন্ডের ট্র্যাকারের মোট ওজন হবে ১১ পাউন্ডের (প্রায়া ৫ কেজি) মতো।’

মানচিত্রে সবুজ রেখা বরাবর জায়গাগুলোতে সর্বোচ্চ ৪ মিনিট ২৭ সেকেন্ড রাতের মতো অন্ধকার নেমে আসবে
সংগৃহীত

সূর্যের পেছনে ছুটে চলা

লাখো মানুষ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন সূর্যগ্রহণের অভিজ্ঞতা নিতে। মুনীম রানা বলেন, ‘প্রথমে পরিকল্পনা ছিল বাড়ির পাশের একটি হ্রদের পাড় থেকে আমি সূর্যগ্রহণ দেখব। কিন্তু টেক্সাসের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন বলে দেখার সুযোগ নেই। এ জন্য আমরা বাড়ি থেকে কয়েক ঘণ্টা দূরের আরকানসাসের পাহাড়ি এলাকায় সূর্যগ্রহণ দেখতে যাচ্ছি। আমি আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাচ্ছি। আমি চাই, আমার সন্তানেরা যখন পরেরবার সূর্যগ্রহণ দেখবে, তখন আমার এই অভিযাত্রার কথা মনে রাখবে।’

অন্যদের জন্য যে সুযোগ আছে

সবাই এই বিরল সূর্যগ্রহণ সরাসরি দেখার সুযোগ পাচ্ছে না। তাঁদের জন্য মুনীম রানা বলেন, বাংলাদেশ থেকে সূর্যগ্রহণ দেখা না গেলেও চাইলে নাসার ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। ফলে সূর্যগ্রহণ দেখতে আগ্রহী ব্যক্তিরা সহজেই স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের মাধ্যমে অনলাইনে সরাসরি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখতে পারবেন।